মোহাম্মদ লিয়াকত আলী

বাঁকা আঙ্গুল

শহরাঞ্চলে কোথাও ঢেঁকি কি না থাকলেও ঢেঁকি চিনে না, এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে।

গ্রামাঞ্চলের ছেলে মেয়েরা খেলার সময় ধাঁ ধাঁ বলেঃ

- শুঁড় দিয়ে কাজ করি, নই আমি হাতি,

উপকার করি তবু খাই শুধু লাথি।

স্কুলে ছাত্রদের এখনো পড়ানো হয় বাংলা প্রবাদঃ

- ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।

কবি জসীমউদদীনের “বেদের মেয়ে “ কবিতা নিয়ে পরিচালিত সিনেমা এক সময় প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিল। সিনেমায় একটি গান ছিলঃ

- ও ধান ভানুরে, ঢেঁকিতে পার দিয়া

ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া।

গ্রামাঞ্চলে অনেক বাড়িতে এখনো ঢেঁকিতে ধান ভানা হয়। ঢেঁকিতে কাজের সময় অনেক দুর্ঘটনা ও ঘটে। সংসারে হয় অনেক অনিষ্ট। এমনই এক দুর্ঘটনার খতচিহ্ন বয়ে চলেছেন অফিসের ছোট স্যার, শিশুকাল থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত।

তার বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল বড়শির মতো বাঁকা। তাই সব সময় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখেন। তাই সাধারণত কারো নজর কাড়ে না। বিয়ের কনে দেখার সময় পাত্রী পক্ষের লোকেরা ও টের পায়নি, ছেলের এতবড় খুঁত আছে। পেলে হয়তো কোরবানির পশুর অবস্থা হতো।

একটি ইসলামি দলের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কের অজুহাতে তাকে বিগত সরকারের আমলে বেশ কিছু দিন জেলের ভাত খেতে হয়েছিল। কারাগার কর্তৃপক্ষ খাতায় নাম লেখার সময় আসামীদের শরীরের তিনটি বিশেষ চিহ্ন নোট করেন। একই নামের একাধিক আসামী থাকলে যাতে অদলবদল না হয়ে যায়। শরীরের চিহ্ন শনাক্তের সময় স্যার বলেনঃ

এতো কিছু দেখার দরকার নাই। আমার হাতে যে চিহ্ন আছে, সারা দুনিয়ার কারো সাথে তা মিলবে না। মুছাফা করার সময় স্যার শুধু ডান হাত বাড়ান। অতো বড়ো খুঁত আর কতো লুকিয়ে রাখা যায়। মাঝে মাঝে ধরা পড়েই যায়।

- স্যার, আপনার আঙুলের এ-ই অবস্থা কি জন্মগত?

- না ভাই, জন্ম পরগত।

- কেমন করে এমন হলো।

- ঢেঁকির চিপায় ঢুকে গিয়েছলো। একেবারে অরিজিনাল মাইনকার চিপায়।

অনেকই বলেছিলোঃ

-ডাক্তারের কাছে যাননি কেন? ছোট্ট একটি অপারেশন করলেই হয়তো ঠিক হয়ে যেতো।

স্যার রাজি হননি। ছোট হউক, বড়ো হউক, অপারেশনের রিয়েকশন আছেই। কি দরকার অযথা ঝামেলার। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠে না। কথাটি চালু থাকলেও এখন কেউ আঙুল দিয়ে ঘি উঠায় না। আধুনিক প্রযুক্তি ঘি খাওয়া অনেক সহজ করে দিয়েছে।

কিন্তু স্যার এখন আর ঘি খান না। ফ্যাট জাতীয় খাবার স্যারের পেটে হজম হয় না।

ছোট ছোট ঘটনা অনেক সময় বড়সড় সুবিধা বয়ে আনে। ভাগ্যের চাকা ঘুরতে সময় লাগে না। স্যার ও অপেক্ষায় আছে। যদি লাইগা যায়। বাঁকা আঙ্গুলের কেরামতি দেখে হয়তো হতবাক হবে বিশ্ববাসী। ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে ছোট স্যারের কনিষ্ঠ বাঁকা আঙ্গুল।।

খেটে খাওয়া মানুষ

লোকে বলে, গরীবেরা খেটে খায়, বড়ো লোকে চেটে খায়। চাটতে চাটতে জিহবা এতো লম্বা হয়ে গেছে, এখন চা-টা ছাড়া আর কিছু বুঝে না। চাটতে চাটতে দে-শ উজাড়। তাদের চাটাচাটি দেখলে মনে পড়ে রফিক আজাদের সেই কবিতা,

-ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।

তার সমর্থনে কবি এনাম আহমদ লিখেছিলেন,

-ভাত দিতে কইলি কে হারামজাদা। কোন সাহসে ভাত ভাত করে চিল্লাস। মাঠে ঘাস

আছে, ডোবা নর্দমায় কচুরিপানা আছে।

খেতে তো নিষেধ নেই।

কবিকে জেলের ভাত খেতে হয়েছিল কিছু দিন।

এদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় নেতা আফসোস করে বলেছিলেন:

-রাজত্ব পেয়ে মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে বামে সামনে পিছনে শুধু চোর। আমি বিদেশ থেকে রিলিফ আনি, চাটার দল সব চেটে পুঁটে খেয়ে ফেলে।

এ-ই চা-টার দল সব সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। তাদের নিয়েই তিনি দে-শ শাসন করেছেন। তাদেরকেই এমপি মন্ত্রী বানিয়েছেন। চা-টার দলকেই সুযোগ দিয়েছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে সিরাজ শিকদারের ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। উর্দু সাহিত্যে একটি গল্প পড়েছিলাম,

এক পীর সাহেব তার খাদেমকে নিয়ে সফরে বের হয়েছেন। গন্তব্যে পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে খেতে বসেছেন। খাদেম বললেন: - হুজুর, রাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি।

- স্বপ্ন সবাই দেখে। তুই কি দেখেছিস?

- দেখলাম, আমার হাত ময়লা আবর্জনায় মাখা।

- ঠিকই দেখেছিস। তুই একজন সাধারণ খাদেম। ময়লা আবর্জনা লাগতেই পারে।

- হুজুর, আমার স্বপ্ন এখনো শেষ হয়নি। - তাড়াতাড়ি শেষ কর।

- তারপর দেখি, আমি আপনার হাত চাটছি, আপনি আমার হাত চাটছেন।

- চুপকর বেয়াদব। দোয়া দরুদ পড়ে ঘুমাছ না?

যারা চেটেপুটে খায়,তারা কোনো সমালোচনা সইতে পারে না। জেল,জুলুম, হুলিয়া নিয়ে চলতে হয়। গরীবরা খেটেই মরে চিরকাল। বড়লোকরা চেটেই খায় আজীবন। কবরের মাটি ছাড়া এদের পেট ভরে না

কেরামত আলীর মেরামত

দুনিয়াটা মস্ত বড়ো, খাও দাও আর ফুর্তি করো। এ-ই নীতিতে বিশ্বাসী শিল্পপতি কেরামত আলী। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাই, বনানী গুলশানে বাড়ি চাই। সময় মতো না পেলে আফসোসের অন্ত নাই। হায়রে টাকা তুমি সময় মতো আইলা না। খাই খাই স্বভাবের মানুষের পেটের পরিধি খুব দীর্ঘ। সহজে ভরে না। শুধু আরও চাই, আরও চাই জিকির। আল্লাহ পাক সুন্দর বলেছেন “কবরের মাটি ছাড়া এমন পেট ভরে না। কবরে যাওয়ার চিন্তা কেরামত আলীরা করে না। এসব হুজুরদের টাকা কামানের ফন্দি। নগদ যা পা-ও, হাত পেতে নাও। কেরামত আলীরা এটাই মেনে চলে। আজ আজিমপুর কবরস্থানের পাশে যানজটে আটকে যায় গাড়ি। হঠাৎ চোখ পড়ে কবরস্থানের ভিতরে। একটি শিশু কাগজ হাতে একটা কবরের পাশে বসে আছে। কেরামত আলী সাহেবের কৌতূহল হলো একটু খতিয়ে দেখার। গাড়ি থেকে নেমে চলে যায় ভিতরে।

- এখানে কি করেছো?

- মা’কে চিঠি পাঠাচ্ছি।

- তোমার মা নিশ্চয় পচে গলে মাটিতে মিশে গেছে। তোমার চিঠি কিভাবে পাবে।

আল্লাহ পাক সবই পারে। তা-ই আল্লাহকে লিখেছি, আল্লাহ যেন মাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে

আরামে রাখেন।

কেরামত আলী সাহেব বাচ্চাটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকেন:

-হায়রে পোড়া কপাল, আমি এমনই,নাদান, একটা শিশুর বুদ্ধি ও নেই।

আমার বাবাকেও মাফ করো। জান্নাতুল ফেরদৌস দান করো।