জোবায়ের রাজু
নুর হোসেনের মাথায় পানি ঢালছেন স্ত্রী ফাহমিদা। ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে আনার পথে সেগুলো হারিয়ে যাবার পর তারতো হার্ট এ্যাটাক করার কথা। যখন নুর হোসেন দেখলেন যে তার পকেটে টাকাগুলি ও মানিব্যাগটা নেই, তখন তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। পরে হাইস্কুল পড়ুয়া দুটো ছেলে নুর হোসেনকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। স্বামীর এই অবস্থা দেখে চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ফাহমিদা। বড় মেয়ে রুবিও হা করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বাবার জন্যে লেবুর শরবত নিয়ে এল ছোট মেয়ে তামান্না।
তোমার কি হইছে গো! এমন লাগছে কেন তোমায়?
ফাহমিদা, পাঁচ লাখ টাকা হারিয়ে পেলেছি গো। এখন আমার রুবি মা’র কিভাবে বিয়েটা হবে?
বাবার কথা শুনে তামান্নার হাত থেকে লেবুর শরবতের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেল। চিৎকার দিলেন ফাহমিদা।
পাঁচ লাখ টাকা হারিয়ে পেললে কিভাবে? এখন রুবির বিয়েটা কিভাবে হবে? আগামি মাসের ষোল তারিখে তো রুবির বিয়ে! কি হবে এখন ! আরতো মাত্র একুশ দিন বাকি।
রুবি মলিন মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে নিজে সে অপয়া বলে গালি দিচ্ছে। কিছুদিন পর তার বিয়ে হবে শীল পাড়ার আকমল মাষ্টারের মেজো ছেলে মেহরাবের সাথে। অনেক জোর করে রুবিকে এই বিয়েতে রাজি করানো হয়েছে।
নুর হোসেন রুবিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রুবি বললÑ
বাবা, আমি আসলে একটা অপয়া, অলক্ষি। তাই না? আমার বিয়ে উপলক্ষে টাকা তুলেছো। বিয়ের আগেই সে টাকা হারিয়ে গেছে। এটা কোন বিপদের সংকেত বাবা?
নারে মা, তুই অপয়া না। তুই আমার লক্ষি মেয়ে। তোর জন্মের পর দিনই আনোয়ারা গ্রুপের মতো এতবড় এক প্রতিষ্ঠানে আমার চাকরি হয়ে গেল।
রুবি কাঁদছে। ভেজা চোখে বাবা ও বোনের দিকে তাকিয়ে আছে তামান্না। তামান্নার চোখে জল এলে তাকে দেখতে বাজে লাগে। অতি সুন্দরী মেয়েদের চোখে জল মানায় না। তামান্না এক আশ্চর্য রুপসি। তা না হলে রশিদ হায়দারের মতো এক চল্লিশ বছর বয়সি কলেজের প্রফেসর তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিবেন কেন। যিনি কিনা এখনো বিয়ে করেননি। জীবনে আর বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেও তামান্নাকে দেখার পর তার মতো পাল্টে গেল। কিন্তু তামান্না মনে মনে ভালোবাসে আহসানকে। সে কথা আহসান এখনো জানে না। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, আহসান আর প্রফেসর রশিদ হায়দারের বয়সে বিস্তর ব্যবধান হলেও দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। একত্রে বসে দুজনে চা খায়।
২. কলিংবেল বাজার পর তামান্না দরজা খুলল। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। তার এক একটা ব্যাগ ও অন্য হাতে একটা মানিব্যাগ। মানিব্যাগটা তামান্নার বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই রকম একটা মানিব্যাগ তার বাবারও আছে।
এটা কি নুর হোসেন সাহেবের বাসা? জ্বি। উনি আমার বাবা। বাবার কাছে এসেছেন বুঝি? বাবাতো বাসায় নেই। বড় আপু বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।
-থাক লাগবে না। আপনার আম্মাকে ডাকবেন একটু?
তাঁতের শাড়িতে ঘোমটা দিয়ে ফাহমিদা এসে ছেলেটিকে দেখার পর বললÑ
-আরে! মাসুদ তুমি? কেন এসেছো? জানো না রুবির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সেতো তোমাকে এখন আর ভালোবাসে না।
-ও আচ্ছা। এটা তাহলে আপনাদের বাসা? নুর হোসেন কি রুবির বাবা?
- হ্যাঁ। কেন, কি হয়েছে আমার স্বামীর?
-না মানে, কাল সকালে এই পাঁচ লাখ টাকার বান্ডিল আর এই মনিব্যাগটা কলেজ রোডের মোড়ে পড়ে থাকতে দেখে বুঝলাম এটা কেউ হারিয়ে ফেলেছে। মানিব্যাগ খুলে দেখি একটা কাগজে এই বাসার ঠিকানা লেখা আছে। এখনতো এসে দেখি এটা আপনাদের বাসা।
ফাহমিদা হা করে তাকিয়ে রইলো। একি! মাসুদের কর্মকান্ড দেখে অবাক ফাহমিদা। ছেলেটা এত সৎ?
মাসুদ ভালোবাসতো রুবিকে। রুবিও জীবন দিয়ে মাসুদকে ভালোবাসতো। তারা বিয়ে করবে বলে পরিকল্পনাও করে।
রুবির বাবা গোপনে মাসুদদের এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে মাসুদের নামে উদ্ভট নিউজ শুনেছেন। মাসুদ নাকি খারাপ ছেলে। মদÑগাঁজা খায়। এলাকার কারো কিছু হারিয়ে গেলে মাসুদকেই সন্দেহ করা হয়। পাশের বাড়ির এক মেয়ের সাথে নাকি তার অবৈধ সম্পর্ক আছে। এক রাতে সেই মেয়ের বিছানায় ধরা পড়ে মাসুদ। পরে বিচার হয়।
এসব খবর শুনে নুর হোসেন ওই লম্পটের সাথে কিছুতেই বিয়ে দিবেন না বলে রুবিকে সাফ জানিয়ে দেয়। রুবিতো কেঁদে কেটে অস্থির। ফোন করে মাসুদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করার কথা জানিয়ে দেয়। মাসুদ অনেক বিনয় করে বলেছেÑ‘ এগুলো সবই চক্রান্ত। কেউ আমার নামে তোমার বাবার কাছে বদনাম রটিয়েছে। বিশ্বাস কর রুবি...!’ কথা শেষ না হতেই রুবি লাইন কেটে দেয়।
ফাহমিদা মাসুদের দিকে তাকিয়ে আছেন। এখন তিনি বুঝতে পারছেন, তার স্বামীকে মাসুদ সম্পর্কে সেদিন মিথ্যে তথ্য দেয়া হয়েছে। সে যদি সত্যিই খারাপ হতো, তাহলে এই টাকা নিয়ে আজ এখানে আসতো না। কিন্তু সে এসেছে, সৎ বলে এসেছে।
৩. রুবি আর নুর হোসেন ফাহমিদার কাছ থেকে বিস্তারিত সব জানলো।
-শোন রুবির বাবা, আমি বলি কি, তুমি রুবির এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়ে মাসুদের কথা একটু ভাবো। ছেলেটা আসলেই ভালো। পাঁচ লাখ টাকার লোভ কে সামলাতে পারে, কিন্তু মাসুদ পেরেছে। আর এই সৎ ছেলেটার হাতে রুবিকে তুলে দিলে দোষ কি। - কিন্তু মাসুদ কি এখন রাজি হবে? তাছাড়া মুরাদকেও বা কিভাবে ফিরিয়ে দিব, বড়ই চিন্তার বিষয়।
রুবি বলল-
- না বাবা, আমি মাসুদকে অনেক অপমান করেছি। কোন মুখে এখন আবার তার সামনে দাঁড়াবো। তোমরা মুরাদের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করার পর মুরাদকে নিয়ে আমি নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।
ফাহমিদা লক্ষ্য করল, রুবি কথাগুলি বলার সময় তার গলা কেমন যেন কাঁপছে। কাঁদছেও বোধ হয়! তামান্না পাশে দাঁড়িয়ে আছে।