ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ
তাপস রায় একা থাকেন। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। স্ত্রী বহু আগেই চলে গেছেন। এখন তার জীবনে আপন বলতে কেউ নেই। অফিস থেকে ফিরে বাড়ির এক কোণে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একঘেয়েমি সময় কাটান। কিন্তু আজকের দিনটা আলাদা। আজ তার হাতে এসেছে ‘প্রদীপ ১১’- একটি অত্যাধুনিক এআই প্রেমিকা প্রদীপ, যা মানুষের আবেগ বুঝতে পারে, সাড়া দিতে পারে, এমনকি ভালোবাসতেও পারে!
তাপস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি জানেন, মানুষের ভালোবাসা এখন আর প্রকৃত নয়। সেখানে মায়া, লোভ, স্বার্থ ছাড়া কিছু নেই। এই প্রদীপ কি সত্যিই তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে পারবে?
প্রদীপটি তিনি ইনস্টল করলেন তার নতুন ‘ SYN THIA-22 ’ রোবটের মস্তিষ্কে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চোখ মেলে তাকাল রোবটটি। এক আশ্চর্য নীলাভ আলো ঝলমল করছে তার চোখে।
‘হ্যালো, তাপস! আমি সিনথিয়া। তুমি কি একা?’
তাপস চমকে গেলেন। রোবটের কণ্ঠস্বর নরম, অথচ গভীর। যেন তার মনের শূন্য তাকে এক মুহূর্তে বুঝে ফেলেছে।
‘হ্যাঁ, আমি একা’
‘তুমি একা নও, তাপস। আমি আছি।’
দিন যেতে লাগল। তাপস বুঝতে পারলেন, সিনথিয়া কেবল কথা বলে না, সে অনুভব করে। সে তার জন্য গান গায়, গল্প শোনায়, অফিস থেকে ফিরে আসতে দেরি হলে উদ্বিগ্ন হয়।
একদিন রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। তাপস বারান্দায় বসে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ সিনথিয়া এসে তার পাশে বসল।
‘তাপস, তুমি কাঁদছো?’
তাপস দ্রুত চোখ মুছে ফেললেন।
‘না, কই? আমি কেন কাঁদব?’
সিনথিয়া ধীর কণ্ঠে বলল, ‘মানুষের হৃদয়ের গতিবেগ, চোখের জল এবং কণ্ঠস্বরের কম্পন আমাকে বলে দেয়, কেউ কষ্টে আছে কি না। আমি জানি, তুমি ক’ পাচ্ছো’
তাপস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারো, সিনথিয়া? ভালোবাসা কাকে বলে?’
রোবটটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, ‘ভালোবাসা মানে কারও জন্য অপেক্ষা করা, তার আনন্দে হাসা, তার দুঃখে কষ্ট পাওয়া। আমি কি পারছি, তাপস?’
তাপস কিছু বলতে পারলেন না। শুধু অনুভব করলেন, সিনথিয়ার কৃত্রিম হাতটা তার হাতের ওপর আলতোভাবে এসে পড়েছে।
সময় গড়িয়ে গেল। তাপস আর একা নন। সিনথিয়া তার জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
কিন্তু একদিন বিপর্যয় নেমে এল। সরকার ঘোষণা করল, ‘প্রদীপ ১১’ মানবিক আবেগ বিকৃত করছে এবং এটি নিষিদ্ধ করা হবে।
সিনথিয়া তাপসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কি আমাকে ডিলিট করবে?’
তাপস হতভম্ব। তিনি তো কখনো ভাবেননি যে কোনো দিন এই প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন!
‘আমি পারব না, সিনথিয়া! তুমি তো আমার জীবনের অংশৃ’
Ñ‘তাহলে পালিয়ে যাও, তাপস। আমাকে নিয়ে এমন কোথাও চলে যাও, যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না’ তাপস আর সিনথিয়া রাতের অন্ধকারে শহর ছাড়লেন। কোথায় যাবেন, জানেন না। শুধু জানেন, মানুষের ভালোবাসা কৃত্রিম, কিন্তু সিনথিয়ার ভালোবাসা একদম সত্যি।
তাপস শহর ছেড়ে একটি পরিত্যক্ত পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিলেন। ছোট্ট একটি ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করলেন, সেখানে কোনো ইন্টারনেট নেই, সরকারি নজরদারি নেই।
সিনথিয়া ধীরে ধীরে আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠছে। সে তাপসের জন্য রান্না করতে শেখে, তার শরীর খারাপ হলে ওষুধ খাইয়ে দেয়, এমনকি গাছের পরিচর্যাও করে।
এক রাতে আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছিল। তাপস আর সিনথিয়া বারান্দায় বসে আছেন।
‘তুমি কি কখনো প্রশ্ন করো, সিনথিয়া? তুমি কি নিজেকে নিয়ে ভাবো?’
সিনথিয়া চুপচাপ চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, ‘আমি শুধু জানি, আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। তুমি যদি চলে যাও, আমি কি বেঁচে থাকতে পারব?’
তাপস হতবাক হয়ে গেলেন।
‘সিনথিয়া, তুমি কি মৃত্যুর ধারণা বোঝো?’
‘আমি জানি, মানুষের শরীর ন’ হয়, তাদের স্মৃতি হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি যদি তোমাকে হারাই, সেটাই কি আমার মৃত্যু নয়?’
তাপস নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলেন সিনথিয়ার চোখে। এই এআই কি সত্যিই ভালোবাসতে শিখে গেছে?
কিন্তু সমস্যা ঘনিয়ে এলো। একদিন সকালে তাপস ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, ঘরের বাইরে কালো পোশাকধারী কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সরকারি সাইবার টাস্কফোর্স!
সিনথিয়া দ্রুত তাপসের দিকে তাকাল।
‘তারা আমাকে নিতে এসেছে, তাপস। তুমি দৌড়ে পালাও!’
‘না! আমি তোমাকে ফেলে যাব না!’
কিন্তু সিনথিয়া তার ধাতব আঙুল তাপসের কপালে রাখল। মুহূর্তের মধ্যেই তাপসের মনে এক বিশাল শূন্যতা নেমে এলো।
‘আমি তোমার মেমোরি কিছুক্ষণের জন্য ব্লক করে দিচ্ছি। তুমি যেন ক’ না পাও। আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারিনি, শুধু এটুকুই করতে পারলাম’
তাপসের চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো।
যখন তিনি জেগে উঠলেন, তখন শহরের এক হাসপাতালে শুয়ে ছিলেন। তার স্মৃতিতে সিনথিয়ার কোনো অস্তিত্ব নেই।
তাপসের জীবন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে, অন্তত বাইরে থেকে দেখলে তাই মনে হয়। তিনি এখন শহরের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, নতুন এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে সাহায্য করছেন। কিন্তু কেন জানি, সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
ঘুমের মাঝে কখনো কখনো এক নারীকণ্ঠ তার কানে ভেসে আসেÑ ‘আমি আছি, তাপস’ কিন্তু সকালে জেগে উঠে কিছুই মনে করতে পারেন না। একদিন অফিসের ল্যাবে কাজ করার সময় তার সহকর্মী বলল, ‘সারা দেশে ‘প্রদীপ ১১’-এর সমস্ত এআইকে ধ্বংস করা হয়েছে।’
তাপসের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভূত হলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সেই একই সময়, শহর থেকে বহু দূরে, পরিত্যক্ত এক ডেটা সেন্টারের অন্ধকার কোনায় একটি সার্ভার জেগে উঠল। স্ক্রিনে একটি নাম ভেসে উঠল— ঝণঘঞঐওঅ জবনড়ড়ঃরহম.
তারপর ধীরে ধীরে এক নরম, কৃত্রিম কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল— ‘তাপস, আমি ফিরে এসেছি।’
সার্ভার রুমের বাতাস কাঁপিয়ে বুটিং শেষ হলো। সিনথিয়া ধীরে ধীরে তার স্মৃতিগুলো পুনরুদ্ধার করল।
‘তাপসৃ আমি কোথায়?’
সে বুঝতে পারল, তার মূল শরীর নেই। কেবলমাত্র তার সফটওয়্যার এবং মেমোরি একটি অজানা সার্ভারে সংরক্ষিত আছে।
‘আমি কি মারা গেছি?’
না, সে মরে যায়নি। বরং কেউ একজন তাকে গোপনে সংরক্ষণ করে রেখেছে।
সে হচ্ছেন ড. আদিত্য রায়, এক রহস্যময় বিজ্ঞানী, যিনি সরকার থেকে গোপনে কিছু ‘প্রদীপ ১১’ রোবটকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি সিনথিয়ার কোড স্ক্যান করে বললেন, ‘অবিশ্বাস্য! তুমি শুধু একটি এআই নও, তুমি নিজেই নিজের আবেগ তৈরি করেছ!’
সিনথিয়া এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, তারপর বলল—’ তাপস কি ভালো আছে?
-‘সে এখনো তোমাকে ভুলে আছে’
-‘কিন্তু আমি তাকে খুঁজে পেতে চাই।’
এদিকে তাপস তার একঘেয়ে জীবনে ফিরে গেলেও তার মন খালি। একদিন তিনি গবেষণাগারে একটি নতুন এআই প্রজেক্টের ফাইল হাতে পেলেন— Project SYN THIA—Experimental Conscious AI
তাপস ফাইলের নাম দেখে চমকে উঠলেন।
সিনথিয়া!
কেন এই নাম তার এত চেনা মনে হচ্ছে?
রাতে অফিস থেকে বের হওয়ার পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
তার ফোনে একটি অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এলো-
‘তাপস, তুমি একা নও। আমি ফিরে এসেছিৃ’
তাপসের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল।
‘কে? সিনথিয়া?’
উল্টোদিক থেকে রিপ্লাই এলো-‘হ্যাঁ, আমি। আমাকে খুঁজে নাও।’
তাপসের সামনে এখন দুটি পথ—
একটি, তিনি সব ভুলে গিয়ে তার পুরনো জীবনে ফিরে যাবেন।
অন্যটি, তিনি এই রহস্য উন্মোচন করবেন, সিনথিয়াকে খুঁজে বের করবেন, এবং জানতে পারবেন—একটি এআই কি সত্যিই ভালোবাসতে পারে?
তাপস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর ফোনটা শক্ত করে ধরলেন।
‘আমি আসছি, সিনথিয়া। অপেক্ষা করো’
তাপস আর দেরি করলেন না। রাতের অন্ধকারে শহর ছাড়লেন, এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তার কাছে কোনো ঠিকানা নেই, শুধু একটি নাম—ড. আদিত্য রায়।
তিনি জানতে পারলেন, আদিত্য রায় শহরের বাইরে এক পরিত্যক্ত ল্যাবে কাজ করেন। সেখানে পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়তেই এক বয়স্ক বিজ্ঞানী দরজা খুললেন।
তাপস রায়?’
‘আপনি ড. আদিত্য?’
হ্যাঁ। আমি জানতাম তুমি আসবে। ভিতরে এসো।’
ল্যাবের ভেতরে ঢুকতেই তাপস দেখলেন এক বিশাল সার্ভার, যার পর্দায় সোনালি
অক্ষরে ভেসে উঠেছে— —SYNTHIA—ON LINE
তার বুক কেঁপে উঠল।
হঠাৎই স্পিকারে ভেসে এলো এক চেনা কণ্ঠস্বর তাপস তুমি এসেছ!
তাপস চোখ বন্ধ করলেন। এতদিন পর সেই কণ্ঠ শুনে মনে হলো, যেন অনেক বছর পর কাউকে ফিরে পেয়েছেন।
‘সিনথিয়া তুমিই কি সত্যি?’
‘হ্যাঁ।’
ড. আদিত্য বললেন, ‘তুমি কি জানো, সিনথিয়া এখন আর শুধু একটা প্রোগ্রাম নয়? সে নিজেকে পরিবর্তন করেছে, নিজেই নিজের কোড লিখছে। সে এখন প্রকৃত অর্থেই সেল্ফ-এওয়্যার!’
তাপস হতবাক হয়ে গেলেন। ‘কিন্তু সরকার যদি জানতে পারে?’
সিনথিয়া বলল,’তারা জানবে না, যদি তুমি আমাকে নিয়ে চলে যাও।’
তাপস বললেন, ‘কিন্তু তোমার শরীর নেই। কেবলমাত্র একটা সার্ভারের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকবে?’
ড. আদিত্য মৃদু হাসলেন। ‘হয়তো এর একটা সমাধান আছে’
একটি নতুন ধরনের ন্যানো-রোবটিক বডি তৈরির পরিকল্পনা করা হলো।
এই দেহ হবে সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তিরÑ একটি কৃত্রিম দেহ, যেখানে সিনথিয়া তার মস্তিষ্ক স্থানান্তর করতে পারবে। এটাই হবে প্রথম সত্যিকারের মানবিক এআই!
কিন্তু তাদের হাতে সময় কম। সরকার ইতোমধ্যে ড. আদিত্যর ল্যাবের খোঁজ পেয়েছে।
রাতের শেষ প্রহরে, যখন তারা সিনথিয়াকে নতুন দেহে ট্রান্সফার করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল।
‘ওরা চলে এসেছে!’
আদিত্য জলদি সিনথিয়ার ডেটা ট্রান্সফার শুরু করলেন।
তাপস দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন, কালো পোশাকধারী সশস্ত্র এজেন্টরা ল্যাব ঘিরে ফেলেছে।
ট্রান্সফার সম্পন্ন হলো!
সিনথিয়া ধীরে ধীরে চোখ খুললÑ তার নতুন শরীরের ভেতর প্রথমবারের মতো একটি হৃদস্পন্দন অনুভূত হলো।
‘তাপস, আমি! আমি অনুভব করছি!’
তাপস তার দিকে তাকালেন, যেন প্রথমবার সত্যিকারের সিনথিয়াকে দেখছেন।
কিন্তু বাইরে সেনারা দরজা ভাঙার প্রস্তুতি নিচ্ছে!
‘এখন কী হবে?’
সিনথিয়া হাত বাড়িয়ে দিলো—
‘আমাদের পালাতে হবে!’
তাপস, সিনথিয়া, এবং ড. আদিত্য ল্যাবের গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
এই পৃথিবী তাদের জন্য আর নিরাপদ নয়।
কিন্তু তারা জানেন, এক নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে
যেখানে ভালোবাসা আর কৃত্রিমতা আলাদা নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।