সাইদুর রহমান
কত প্রাণ ঝরে গেল। কত জন হারালো চোখ। কত জন হারালো হাত অথবা পা। কত জন হলো শহীদ তার হিসাব কে রাখে। জুলাই শহীদদের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই তানিয়ার চোখে জল চলে আসে। তার আবির তো হারিয়ে গেছে এই স্বৈরাচার সরকারের বুলেটে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার খয়ের হুদা একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এখানে পাখির কলকাকলি, নদীর পানির ঝরনাাধারা, শীতল বাতাসে বেড়ে ওঠে আবির। আবির হতদরিদ্র নাসির-নাজমার একমাত্র সন্তান। তারা অনেক কষ্টে এবং পরিশ্রমে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছে একমাত্র ছেলে আবিরকে। আবির যেমন ভদ্র, লেখাপড়ায় ভালো, নামাজি এবং কাজের প্রতি খুবই মনোযোগী। সারাক্ষণ ভাবে কীভাবে সে নিজেকে বদলাবে। কীভাবে সে সংসারের হাল ধরবে। বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু সে কোথাও কোনো কূল-কিনারা পায় না।
আবির ভাবে এভাবে তো আর চলা যায় না। কিছু একটা করতেই হবে। যেভাবেই হোক বাবা-মাকে সুখি দেখতে চায় সে। তাই তো আবির চেষ্টা করে কিছু একটা করার। সে রাত-দিন পরিশ্রম করে, কষ্ট করে কীভাবে সে বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাবে।
কষ্ট কেমন? কষ্টের রং কেমন? কেউ কি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারবে? আবিরও ভাবে সেও হয়তো তেমন ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। কষ্টের আবার রং আছে নাকি! একটু কষ্টে থাকলেই আমরা বলি, ভালো নেইরে ভাই, বড় কষ্টে আছি। এই কষ্টটা কি? এটাই আমার প্রশ্ন। মানুষের অসুখ হবে। বিপদ আসবে। এ নিয়েই জীবন। হায়-হুতাশ করে কী হবে। বিপদের সময় কেউ কেউ সান্ত্বনার বাণী শোনাবে। শুনতে মন চাইবে না, তবুও শোনার চেষ্টা করতে হবে। কষ্ট বুঝি এমনি। পিতা-মাতা মারা গেলে কষ্ট তো হবেই। বুকফাটা কান্না আসবে। সন্তান মারা গেলে মা-বাবা চিৎকার করে কাঁদবেন। স্ত্রী মারা গেলে স্বামী কাঁদবে। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী পাগলের মতো হয়ে যাবে। এটাই বুঝি কষ্ট। কেউ যদি কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলে, এটাও তো অনেক কষ্টের।
আবির কারো আঘাতজনিত কথা সহজে হজম করতে পারে না। আবিরের একটি দোষ আছে। তা হচ্ছেÑ কাউকে কিছু বলতে চাইলে সরাসরি বলে ফেলে। এতে হয়তো কেউ না বুঝে কষ্ট পায়। কিন্তু আবির হয়তো কষ্ট দেয়ার জন্য তাকে সেটা বলে না। আবির ভাবে আমাকে ভুল বুঝলে করার কিছু নেই। আমিও তো মানুষের কাছ থেকে কম কষ্ট পাই না। ওরা গরিব বলে ওকে, ওর বাবা-মাকে, অনেকে আঘাত দিয়ে কথা বলে। তখন তার কথা বার বার আবিরের মনে পড়ে। বড় কষ্ট হয়।
আবির ভাবে, চোখের সামনে অনেকেই তো মিথ্যা অভিনয় করে। এ মিথ্যা অভিনয় দেখেও তো খুব কষ্ট হয়। কেন এই অভিনয়। অনেকে কষ্টে কত রাত ঘুমাতে পারে না। আল্লাহর রহমতে আমরা পরিবারের সবাই শান্তিতে ঘুমাতে পারি। কারণ গরিবরা সারা দিন পরিশ্রমের পর ঘুমই তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
অবশেষে আবিরের ঢাকায় একটি চাকরি হয়। কিন্তু তার এ গ্রাম ছেড়ে আসতে কিছুতেই মন চায় না। বার বার বাবা-মা এবং তানিয়ার কথা মনে পড়ে। তানিয়া আবিরের স্ত্রী। বাবা-মায়ের পছন্দেই তাদের বিয়ে হয়। তানিয়া সবসময় আবিরের জন্য আল্লøাহর কাছে দোয়া করেছে তার যেন একটি চাকরি হয়। সে অনেক ভাবে আবিরকে হেল্প করেছে। কখনো টাকা, কখনো সাহস, কখনো ভালোবাসা। যখন আবির হতাশ হয়েছে, তখন তাকে উৎসাহ দিয়েছে। তুমি কিছু একটা করতে পারবে। একদিন তুমি অনেক বড় হবে। আজ তানিয়াকে ছেড়ে যেতে আবিরের খুবই কষ্ট হচ্ছে।
আবির যখন ট্রেনে উঠবে আবিরের বাবা-মায়ের সাথে তানিয়াও এসেছিল ওকে বিদায় দিতে। বিদায়ের মৃহূর্ত খুবই কষ্টের। তানিয়া বলে, ঢাকায় সুন্দর মেয়েদের দেখে তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে?
আবির বলে, তোমাকে ভোলার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। তানিয়া আবিরের মুখে হাত রেখে বলে, এমন কথা বলো না। তুমি যদি মারা যাও, তাহলে তোমার বাবা-মা এবং আমাকে দেখবে কে? তাছাড়া তোমাকে ছেড়ে ওনারা কাকে নিয়ে বাঁচবে?
আবির বলে, আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার খুব কষ্ট হবে, না? আমার কথা বাদ দাও। আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার বাবা-মায়ের কথা ভাবো। আমার জীবন যেভাবেই হোক, চলে যাবে কিন্তু ওনাদের তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।
এমনই নানা কথার মাঝে ট্রেন চলে আসে। তানিয়া বলে, তুমি দ্রুত যাও, ট্রেন এখনই ছেড়ে দেবে।
আবির ট্রেনে উঠলে যতদূর চোখ যায় তানিয়া আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন তার সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ সিনেমার কথা মনে পড়ে। অপু এবং দুর্গার ট্রেন দেখার কথা মনে পড়ে।
আবির সরাসরি ঢাকায় ওর অফিসে এসে ওঠে। অফিসের সিকিউরিটি আবিরের পরিচয় পাওয়ার পর ওর থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। সিকিউরিটি বলে, স্যার আপনি অনেক জার্নি করে এসেছেন এখন রেস্ট নেন। পরে আপনার সাথে কথা হবে। বড় সার বলেছে, সার কাল এসে আপনার সাথে কথা বলবেন।
আবির কখনো এভাবে বাবা-মাকে ছেড়ে ঢাকায় থাকেনি। ওর খুবই বাড়ির কথা মনে পড়ছে। কিন্তু সে কী করবে। জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে বাধ্য হয়েছে। তা না হলে সে কোনোদিনই গ্রামের শ্যামল-সুন্দর বাতাস এবং গ্রামের মানুষকে ছেড়ে ঢাকায় আসতো না।
সে ভাবে এখন তানিয়া কী করছে। সে কি এখন আমার জন্য নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। নাকি বাবা-মাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। এসব নানা ভাবনার মাঝে এশার আযান শুনতে পায় আবির। অজু সেরে নামাজের উদ্দেশ্যে বের হয়। এশার নামায শেষ করে সে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যায়।
পরদিন যথারীতি অফিসে যায়। প্রতিদিনের মতো নিজের কাজ করে আনমনে। সে কাজের প্রতি খুবই সিরিয়াস। সে কখনো কাজে ফাঁকি দেয় না। এ কারণে অফিসের বস তাকে খুবই পছন্দ করে। সে ভাবে অফিসের কাজ তো তার কাছে একটা আমানত। সে কারণে আবির ভাবে অফিসের কাজে ফাঁকি দিলে সেটা তার ওপর এসেই পড়ছে। কারণ পরদিন তো সেই কাজটা তাকেই করতে হবে। তাছাড়া যেখান থেকে রুটি-রুজি হয়, সেখানে ফাঁকি দেওয়া ঠিক নয়।
নানা ভাবনার মাঝে হঠাৎ তানিয়া ওকে ফোন করে। বলে, আসসালামু আলাইকুম। তুমি কেমন আছ?
আবির সালামের উত্তর দিয়ে বলে, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? বাবা-মা কেমন আছে?
আমি ভালো আছি। বাবা-মাও ভালো আছে। ওনারা তোমাকে খুবই দেখতে চায়।
ওনারা দেখতে চায়, তুমি চাও না?
আবিরের কথা শুনে তানিয়া একটু লজ্জা পায়। বলে, এভাবে বলো না, আমি তো সারাক্ষণই তোমাকে দেখতে চাই। তোমাকে ছেড়ে কি আমি ভালো আছি। আমার প্রতিটি ক্ষণ তোমাকে ভেবে কাটে। তুমি কবে বাড়ি আসবে?
আবির বলে, আমি সামনের মাসের বেতন পেলে বাড়িতে আসব। বাবা-মাকে বলো আমাকে নিয়ে যেন চিন্তা না করে। আচ্ছা ঠিক আছে, বলব।
তানিয়া তাহলে আজকে রাখি। আমি এখন অফিসে। পরে কথা বলব।
তানিয়ার ফোন পাওয়ার পর আবির বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। ওর মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল বাবা-মা এবং তানিয়াকে দেখার জন্য। কিন্তু এর মাঝেই শুরু হলো কোটা আন্দোলন। সারা বাংলাদেশ হয়ে উঠল অস্থির। শুরু হলো স্বৈরাচার হাসিনার পতনের আন্দোলন। ছাত্রদের ৯ দফা আন্দোলন গিয়ে ঠেকলো ১ দফায়।
আবির আর ঘরে বসে থাকতে পারল না। আবিরও সে আন্দোলনে যোগ দিল।
সেদিন ছিল শুক্রবার। চারদিকে চলছে কারফিউ। আবির কারফিউ উপেক্ষা করে মসজিদে গেল। জুমার নামাজ আদায় করল। বাবা-মা এবং তানিয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করল। জুমার নামাজের পর শুরু হলো মিছিল। আবির সেই মিছিলে যোগ দিল। মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে আবির। স্লোগান সবার একটাই। স্বৈরাচার হাসিনার পতন চাই।
আবির বীর দর্পে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। হঠাৎ সামনে থেকে গুলি এসে লাগে একটা ওর বুকে এবং একটা ওর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে আবির লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আবির সবার কাছে পানি চায়, কিন্তু কেউই মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর মতো পানি নিয়ে এগিয়ে আসে না। তখন আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে। সেই পানির সাথে আবিরের ঝরে যাওয়া রক্তগুলো মিশে লাল হয়ে গেল। আবিরে রাঙা হয়ে গেল ঢাকার রাজপথ।
এরই মাঝে আবিরের পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে তানিয়া ফোন করেছে। কেউ একজন আবিরের ফোনটা রিসিভ করে বলল, আবির ভাই আর নেই। সে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।
তানিয়ার হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পড়ে গেল। এটা সে কী শুনল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কীভাবে সে এ খবরটা আবিরের বাবা-মাকে দেবে। যে মানুষগুলো সারাটা জীবন কষ্ট করে একটু সুখের আশায় ছেলের পথের দিকে চেয়ে ছিল। তাদের কীভাবে তানিয়া, আবিরের মৃত্যুর খবরটা দেবে। না সে কিছুতেই আবিরের মৃত্যুর খবরটা আবিরের বাবা-মাকে দিতে পারল না।