আবু নেসার শাহীন
প্রচণ্ড রোদ পড়ছে। এ গরমে শুটিং করা কষ্ট। তার ওপর ঘামে ম্যাকআপ নষ্ট হয়ে যায়। তার চরিত্রটা ছোট। একজন ফেরিওয়ালার চরিত্র। সকাল দশটায় সেটে এসে বসে আছে। একজন সিনিয়র শিল্পীকে এভাবে বসিয়ে রাখা অপমান ছাড়া আর কিছু না। একটা সময় ছিল যখন তার জন্য প্রযোজক পরিচালকরা লাইন দিয়ে বসে থাকত। যে পরিমাণ ছবি সে করেছে, তারচেয়ে অনেক বেশি ছবির প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিছু সুপার হিট ছবি করেছে সে। যার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অথচ এখন তার হাতে ছবি নেই। কোন পরিচালক তাকে ডাকে না। সে মনে মনে ভাবে বলিউডে সিনিয়র শিল্পীদের মুখ্য চরিত্রে কাষ্ট করে গল্প লেখা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এ দেশে তা হয় না।
চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দুই হাতে টাকা রোজগার করেছে। গাড়ি বাড়ি ফ্ল্যাট কিনছে। স্ত্রী তমা খান ও চলচ্চিত্র নায়িকা ছিল। তাদের ঘিরে এক সময় চলচ্চিত্র পাড়া সরগরম ছিল। পত্র-পত্রিকায় কত লেখালেখি হত। সে সময় দুই হাতে টাকা খরচ করত। একটা সময় স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার চিকিৎসার পেছনে খরচ করতে করতে বাড়ি গাড়ি বিক্রি করতে হয়। সে রক্ষা হল না। স্ত্রী মারা যায়। তাই এ বয়সে এসেও টাকার জন্য কাজ করতে হয়। ছেলের বয়সী পরিচালকদের ধারে ধারে ঘুরে কাজ যোগাড় করতে হয়। শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। রোজ অনেক টাকার ঔষধ খেতে হয়। তবে রুপালী পর্দায় নিজেকে দেখতে এখনও ভালো লাগে তার।
এ সময় তার পাশ ঘেঁষে যাচ্ছিল সহকারী পরিচালক শরীফ জান। সে গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, শরীফ এক কাপ হবে?
শরীফ জান ঘুরে দাঁড়ায়। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। রাগে গজ গজ করতে করতে বলল, শাহাবাজি খান আপনি তো খুব বিরক্ত করেন। একটু পরপর কে আপনাকে চা দিবে। আর আমি কি খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে আছি?
না মানে বড্ড চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। সাথে একটু কিছু হলে আরও ভালো হত।
আরজু আরজু ও আরজু। শরীফ জানের চিৎকার শুনে আরজু ছুটে আসে।
স্যার কিছু লাগবে?
শাহবাজি খানকে চা নাস্তা দে।
এক্ষুনি দিচ্ছি স্যার। আরজু চলে যায়। শরীফ জান স্ক্রিপ্টে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সামনে এগোতে থাকে।
আরজু চা নাস্তা দিয়ে যায়। হঠাৎ মনটা বিষয়ে ওঠে। শূন্য দৃষ্টিতে মেলে অনেকক্ষণ চা নাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মুচকি হাসে। তাচ্ছিল্যের হাসি। একটা সময় ছিল যখন তার শুটিং থাকত, পরিচালক তাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, কি খাবেন? তখন খাবারের মেনু তার মতামত নিয়ে সাজানো হত। চা নাস্তা কিছুই খেল না। ফুরফুরে বাতাস বইছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভেতর শব্দ করে নাক ডাকে। ঘন্টাখানেক পর কে যেন তার শরীরে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকে, শাহবাজি খান শাহাবাজি খান ও শাহবাজি খান।
অনেক কষ্টে চোখ খোলে সে। স্কুলের ড্রেস পরা কিছু বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে এক ধরনের কৌতুহল। সে হাই তুলতে তুলতে বলল, কি চাও?
একটা অটোগ্রাফ দিন, প্লিজ। একটা ছেলে তার দিকে খাতা কলম বাড়িয়ে দিয়ে বলল।
অটোগ্রাফ দিব আমি! তুমি আমাকে চিনো? শাহবাজি খান শব্দ করে হাসে।
হ্যাঁ। একটা চ্যানেলে প্রায় আপনার একটা সিনেমা দেখায়। সিনেমার নাম, সিনেমার নাম, সিনেমার নাম ঝড়। তখন আপনি অনেক সুন্দর ছিলেন। আচ্ছা ঐ গুণ্ডাগুলো কি সত্যি সত্যি মারা যায়?
না না না। আসলে ঐটাত একটা সিনেমা। পুরোটাই অভিনয়।
ও আচ্ছা। আমি আরও ভাবছিলাম।
আচ্ছা ঐসব কথা বাদ দাও। শাহবাজি খান ছেলেটার হাত থেকে খাতা কলম নিয়ে অটোগ্রাফ দেয়। ছেলেগুলো চলে যায়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও চোখ বুজে। বিকট শব্দে নাক ডাকে।
ঘুম থেকে জেগে ওঠে বাম হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে চমকে ওঠে। বিকেল পাঁচটা বাজে। সে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পায়চারি করে। সকাল ছয়টায় সেটে এসেছে। অথচ এখনও তাকে ডাকছে না। না, এভাবে আর না। তারচেয়ে গলির মোড়ে টি-স্টল দেওয়া অনেক ভালো। এ সময় শরীফ জান ছুটে এসে বলল, আপনার কি হয়েছে বলুন তো? আমি আবার কি করলাম? সে সকাল থেকে সেটে এসে বসে আছি। অলরেডি ম্যাকআপও নিয়েছি।
কিছু করেননি, না? ওকে ফাইন। রেডি হন। এখন আপনার শট নেওয়া হবে। আপনি একজন ফেরিওয়ালা। বাদাম বাদাম বলতে বলতে দৃশ্যে ঢুকবেন। আপনার সামনে দিয়ে বিষন্ন মনে নায়ক হেঁটে যাবে। পেছন থেকে আপনি তাকে ডেকে বললেন, ঐ রাজু বাদাম খাইয়া যাও।
না চাচা, মনটা ভীষণ খারাপ। মা’র শইডাটা ভালা না। নায়ক থমকে দাঁড়ায়। এবং পেছনে ঘুরে বলবে।
ক্যান কি অইছে? আপনাকে চিন্তিত দেখাবে।
মা’র দুইডা কিডনিই নষ্ট অই গেছে। নায়কের চোখে জল। নায়ক গামছা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। আপনি অবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখবেন। আফসোস করবেন। ব্যাস এতটুকু।
ঠিক আছে। শরীফ জান অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ম্যাকআপ ম্যান হরিদাস পাল এগিয়ে এসে ধমকিয়ে ওঠে, ঘুমিয়ে চেহারার এ কি হাল করেছেন? নিন বসুন, আবার আপনাকে ম্যাকআপ নিতে হবে।
ম্যাকআপ নিয়ে বসে থাকে শাহবাজি খান। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। প্রায় দুই বছর পর ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে। আবার ও রুপালী পর্দায় দেখা যাবে তাকে। তার ও অনেক পরে প্রধান পরিচালক সেটে আসে, আজ আর শুটিং হবে না। নায়কের ভীষণ মাথা ধরেছে। শাহজাবি খান সরি। কাল আর সেটে এসে অপেক্ষা করতে হবে না।
কিছু টাকা পয়সা দেওয়া যাবে? সে ইতস্তত করে বলল।
কেন দেওয়া যাবে না? ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি। আপনাকে পেমেন্ট দিতে। প্রধান পরিচালক চলে যায়। সে পোশাক পরিবর্তন করে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে।
শুটিং হাউজ থেকে একটু দূরে বাসস্ট্যান্ড। বাস স্ট্যান্ডের কাছে এসে বাম হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে। সন্ধ্যে হতে এখনও অনেক দেরি। সে খুব হতাশ। মাসের শেষ। নিজের ফ্ল্যাটে থাকলে কি হবে, মাস শেষে সার্ভিস চার্জ, বিদুৎ বিল, গ্যাস বিল দিতে হয়। মোবাইল বাজে। সে বড্ড বিরক্ত হয়। তবু রিসিভ করে। শাহবাজি খান বলেছেন?
জি। কে বলেছেন প্লিজ?
সাপ্তাহিক দিনের আলো পত্রিকার শোবিজ সাংবাদিক, মোরশেদ খাঁ। আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। অনেক দিন পর চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
ঠিক আছে। নো প্রবলেম। আজ রাতে আমার বাসায় চলে আসুন। ঠিকানাটা এসএমএস করে দিচ্ছি।
ঠিক আছে। লাইন কেটে যায়। সে গাছের গুঁড়ির ওপর বসে অনেক কিছু ভাবে। কাল আর এদিকে আসবে না। সিডিউল ফাঁসিয়ে দিবে। আবার ভাবে না, সিডিউল ফাঁসানো তার স্বভাবে নেই। আবারও মোবাইল বাজে। সে কল রিসিভ করে, হ্যালো। শাহবাজি খান আমি ফিল্ম ডিরেক্টর প্রত্যেয় আকাশ। আপনাকে চরিত্রে কাস্ট করে একটা চমৎকার গল্প লিখেছি। এবং আপনাকে নিয়ে এ ছবি নির্মাণ করতে চাই।
প্রত্যেয় আকাশের কথা শুনে সে তো থ! বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কি বলছেন এসব? শুনে খুশি হলাম। এখন তো সিনিয়র শিল্পীদের কেউ মূল্যায়ন করে না। ম্যাকআপ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। সম্মানি তো যা ইচ্ছে তাই।
না না আমি সে রকম না। আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে পারেন।
সে রকম হলে আপনি অন্য কাউকে নিয়ে নেন।
সে রকম কিছু হবে না। সে লাইন কেটে দেয়। আবারও মোবাইল বাজে। ইতিমধ্যে তার চারপাশে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। সে ওঠে। বাসস্ট্যান্ড এসে একটা বাসে ওঠে পড়ে। বাসে প্রচন্ড ভিড়। ঠিকমত দাঁড়াতে পারছে না। এদিকে প্রত্যেয় আকাশ একটানা কল করে যাচ্ছে। গাড়ি ধীরে ধীরে চলছে।
একজন যাত্রী বলল, ড্রাইভার শালা বেকুব। ঠিকমত গাড়ি চালাতে পারে না। পেছনের গাড়ি আগে চলে গেছে।
শালা মনে হয় আগে হেলপার ছিল। অন্য একজন যাত্রী বলল
তাদের কথা শুনে ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। গাড়ি পক্সক্ষীরাজের মতো ছুটে চলে। কিছু যাত্রী ভয় পায়। চিৎকার চেঁচামেচি হইচই করে। একজন যাত্রী তার সিট ছেড়ে দেয়, সে বসে। আকাশে মেঘ ডাকে। দমকা বাতাস ছুটে। মুষল ধারে বৃষ্টি নামে। সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনে। আব্দুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত তীব্র যানজট।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। রিসিপশনে মুখ ভার করে বসে আছে মোরশেদ খাঁ। সে দুই হাত জোড় করে বলল, সরি। এক্সট্রিমলি সরি। কি করব বলুন। রাস্তায় তীব্র যানজট। প্রাইভেট গাড়ি থাকলে না হয় একটু আগে আসতে পারতাম।
না না সরি বলতে হবে না। তবে আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
কি? কি সারপ্রাইজ? প্লিজ তাড়াতাড়ি বলুন?
প্রত্যেয় আকাশ আসছে। তার নতুন ছবির গল্প শোনাবে আপনাকে। এক লক্ষ টাকা সাইনিং মানিও দিবে। এ মুহূর্তে আপনার টাকার খুব দরকার, তাই না?
হুঁ। ঠিক এ সময় প্রত্যেয় আকাশ আসে।
সে সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠে। তার পেছন পেছন ওঠে মোরশেদ খাঁ ও প্রত্যেয় আকাশ। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। প্রেসার কুকারে খিচুড়ি রান্না করে। রান্না শেষ হতেই খেতে বসে সবাই। খাবার পর প্রত্যেয় আকাশ তাকে ছবির সিনোপসিস পড়ে শোনায়-
গ্রাম থেকে এক লোক শহরে আসে শূন্য হাতে। শহরে এসে তাকে বেঁচে থাকার জন্য স্ট্রাগল করতে হয়। শুধু মাত্র নিজের চেষ্টায় খ্যাতি অর্জন করে, রোজকার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ। শহরের অভিজাত শ্রেণীর মানুষের সাথে ওঠাবসা করে। প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়। ভালোবেসে বিয়ে করে। এক সময় তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তারপর তার আর কিছুই ভালোলাগে না। অনেক দিন অন্তরালে থাকার পর ফিল্মে ছোট একটা কাজ পায়। এ নিয়ে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সে আবার ও আলোচনায় আসে। এক তরুণ নির্মাতা তাকে কাষ্ট করে গল্প লেখে। এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। এক সময় সিনেমাটা মুক্তি পায়। এবং সারা দেশে হইচই পড়ে যায়। ব্যাস এতটুকু।
তার চোখে জল। নতুন প্রজন্মের কেউ তাকে নিয়ে গল্প লিখেছে। চিত্রনাট্য তৈরি করেছে। তাকে মুখ্য চরিত্রে কাষ্ট করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবে। বাইরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। বিকট শব্দে বাজ পড়ে। গল্পে গল্পে রাত শেষ হয়। মোরশেদ খাঁ ও প্রত্যেয় আকাশ চলে যায়। সে ও প্রাতঃকৃত সেরে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার ঘুম আসে না।