কুয়াশার রেলগাড়ি
হেমন্তের সকালে পুরো গ্রাম কুয়াশার সাদা চাদরে ঢাকা। মাঠের ঘাসে শিশির জমে ঝিলমিল করছে, যেন ছোট ছোট হীরা ছড়িয়ে আছে। গ্রামের ছোট্ট রেলস্টেশন মধুপাড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোনো রেলগাড়ি, যার নাম ‘কুয়াশার রেলগাড়ি’। সবাই বলে, এই ট্রেনটা অন্য ট্রেনের মতো নয়-এর হৃদয় আছে, মন আছে, আর আছে এক গোপন দায়িত্ব।
প্রতিদিন সকালে ট্রেনটা কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটে চলে, দূরের গ্রামগুলোতে চিঠি, জিনিসপত্র এবং ছোটগল্প পৌঁছে দিতে। ইঞ্জিনের নাম ধোঁয়া মামা, আর সঙ্গে তিনটি বগি-ঘন্টু, ফুলু, আর চম্পা। তিনটি বগিই দুই কিন্তু দায়িত্বশীল।
একদিন সকালে ট্রেন চলার সময় কুয়াশার ভেতর থেকে হঠাৎ এক মৃদু কান্নার শব্দ শোনা গেল। ধোঁয়া মামা হুইসেল বাজিয়ে থেমে গেল। দেখা গেল, এক ছোট্ট ছাগলছানা লাইনের ধারে বসে কাঁদছে। সে হারিয়ে গেছে।
ধোঁয়া মামা নরম গলায় বলল,
-‘বাবু, তুমি একা কেন?’
ছাগলছানা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘আমি দুধু। কুয়াশায় পথ ভুলে গেছি। আমার খামার কোথায় খুঁজে পাচ্ছি না।’
ঘন্টু বলল,
-‘চিন্তা করো না, আমরা কুয়াশার রেলগাড়ি। পথ খুঁজে দিতে পারি!’
ফুলু বলল,
-‘আমাদের বগিতে উঠো, আমরা তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।’
ট্রেনটা আবার চলল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে, মাঠের ওপর দিয়ে, নদীর ধারে ধীরে ধীরে তারা এগোল। ঘন কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ ট্রেনের মাথায় বসা এক বুড়ো পেঁচা ডাক দিলো,
-‘হু-হু! নদীর ধারে নামো, ওখানেই দুধুর বাড়ি।’ পেঁচা ছিল ট্রেনের গোপন পথপ্রদর্শক। ধোঁয়া মামা হাসলো-‘ধন্যবাদ, বুড়ো বন্ধু!’
দুধু অবশেষে তার খামারে পৌঁছে গেল। মা ছাগল দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। দুধু কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘তোমরা না থাকলে আমি কখনোই বাড়ি ফিরতে পারতাম না!’
রেলগাড়ি হুইসেল বাজিয়ে বলল,
-‘হেমন্তের কুয়াশা যতই ঘন হোক, মন যদি ভালো থাকে, পথ হারিয়ে যায় না।’
এরপর তারা আবার রওনা হলো। এবার বগিতে উঠল কিছু স্কুলপড়ুয়া শিশু, যারা প্রতিদিন এই ট্রেনে চড়ে স্কুলে যায়। শিশুরা হাসতে হাসতে বলল,
-‘কুয়াশার রেলগাড়ি আমাদের বন্ধু! এটি আমাদের শেখায়, কুয়াশা মানে ভয় নয়, বরং ধৈর্যের পরীক্ষা।’
ধোঁয়া মামা মৃদু হুইসেল বাজাল, আর কুয়াশার ভেতর দিয়ে সূর্যের প্রথম আলো দেখা দিল।
রেলস্টেশনের সবাই হাত নাড়িয়ে বলল-
‘বিদায় কুয়াশার রেলগাড়ি! আবার দেখা হবে কাল!’
ট্রেনটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল রূপালি কুয়াশার ভেতর। তবে তার গল্প ছড়িয়ে গেল গ্রাম জুড়ে-শেখালো সবাইকে, পথ অন্ধকার হলেও, সৎ ইচ্ছা থাকলে আলো আপনিই পথ দেখায়।