আব্দুস সালাম
“মা, ভাবছি পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে দেব। এত পরিশ্রম আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তোমাকে যে একটু সময় দেব, সেই সুযোগও পাচ্ছি না। সারাদিন কাজ আর কাজ। ঠিকমতো ঘুমাতেও পারি না।”
মা বললেন, “তোকে চাকরিও ছাড়তে হবে না, আমাকে সময় দিতেও হবে না? চাকরি ছেড়ে দেব বললেই হলো? চাকরি যেন গাছের পাতা, চাইলেই পাওয়া যায়! কবে থেকে বলছি, আমার কথা কানেই তুলছিস না।”
“কোন কথা, মা?”
“হ্যাঁ, আমাকে প্রতিদিন একবার করে মনে করিয়ে দিতে হবে একটা বিয়ে করলেই তো সব সমাধান হয়ে যায়! আচ্ছা, তোর যদি কোনো পছন্দ থাকে, আমাকে তো বলতে পারিস। ভার্সিটিতে পড়ালেখা শেষ করলি, ভালো একটা চাকরি করিস। কত লোকজনের সঙ্গে তোর ওঠাবসা। তারপরও একটা মেয়ে পছন্দ করতে পারলি না? আমি আর তোর জন্য প্রতিদিন এভাবে ভাত রান্না করতে পারবো না।”
“আমাকে কে বিয়ে করবে শুনি? আরে আমি তো বিয়ে করতে চাই। শুধু বলেছি, শহরের কোনো মেয়েকে বিয়ে করবো নাÑগ্রামের মেয়ে বিয়ে করবো।”
মা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “থাক হয়েছে। এখন বলে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবো। একেক দিন একেক কথা।”
প্রায় দিনের মতো আজও খাবার টেবিলে বসে মা-ছেলের মধ্যে খুনসুটি হয়।
ছেলের মেজাজ মর্জি দেখে একদিন মা বললেন, “বাবা রোহান, আমার একটা মেয়ে পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা দেখতে যেমন ভালো, তেমনি শিক্ষিত। ওদের অবস্থাও ভালো। ওর বাবা সরকারি চাকরি করতো। বছর দুয়েক আগে রিটায়ার করেছে। ঢাকাতে এখন ছোটখাটো ব্যবসা করে। তোর সাথে ওর খুব মানাবে।”
“মা, তোমাকে অনেকবার বলেছি, শহরের মেয়ে আমার পছন্দ না।”
“তুই যদি বলিস শহরের মেয়েরা ভালো না, তাহলে আমি ধরে নেব তুই আমাকেও পছন্দ করিস না। কারণ আমিও তো শহরের মেয়ে, তাই না?”
“ছি ছি! এসব কী বলছো? সবাই কী তোমার মতো ভালো হবে নাকি?”
“তোর পছন্দ না হলে বিয়ে করবি না। চল, কোন একদিন ছুটির দিনে মেয়েটাকে দেখে আসি।”
“এত করে যেহেতু বলছো, চলো দেখে আসি।”
রোহান সম্মতি দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। ছেলের সম্মতি পেয়ে মা ভীষণ খুশি। এ কারণে সারাদিনটা তার ভালো যায়।
রোহান মনে মনে ভাবে, মাকে কষ্ট দেওয়া আর ঠিক হবে না। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা স্নেহের চাদরে আগলে রেখেছেন। বাবা না থাকার কষ্টটা মা বুঝতে দেন না। আমার কষ্ট হবেÑএই আশঙ্কায় মা আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি। এখন মায়ের বয়স হয়েছে। গল্প করারও একজন সঙ্গী দরকার। অন্তত মায়ের কথা চিন্তা করেই হলেও আমার একটা বিয়ে করা জরুরি।
একদিন মেয়ে দেখার পালা শেষ হয়। মায়ের পছন্দই শেষপর্যন্ত রোহানের পছন্দ। দুই পরিবারের সম্মতিতেই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শুরু হয় তাদের সংসার জীবনের আলো-আঁধারের পথ পাড়ি দেওয়ার পর্ব। পথের সবটুকু অংশ আলোকিত না হলেও পথের শুরুটা যে আলোই ভরানো থাকে, তা সকলের জানা। রোহানের বেলাতেও তা ব্যতিক্রম হয়নি। জীবনের সাধ যে কতটা মধুর হতে পারে, তা রোহানের জানা ছিল না। স্ত্রী জ্যোতিকে পেয়েই যেন তা পূর্ণতা লাভ করে। জ্যোতির আলোই আলোকিত করে সংসারটা। রোহানের মনটা সবসময় পড়ে থাকে গৃহকোণে। স্ত্রীকে দেখলেই তার কষ্টটা অনেকাংশে লাঘব হয়। অফিসের একঘেয়েমি দূর করতে মাঝে মাঝে দূরে কোথাও ঘুরে আসে তারা। এতে রোহানের মাও মনে মনে অনেক খুশি। এভাবেই চলতে থাকে রোহানের সংসার।
বছর দুয়েক যেতে না যেতেই জ্যোতির জ্যোতির্ময়ে যেমন ভাটা পড়তে শুরু করে, ঠিক তেমনি তার দীপ্তি ক্ষীণ হতে শুরু করে। সংসার মঞ্চে সুখের সুধা পান করতে হলে রক্তকে পানি করতে হয়। পথের কাঁটাকে দু’পায়ে দলতে হয়। কষ্ট সহ্য করেও হাসতে হয়। কষ্টগুলোকে বুকের মাঝে কবর দিতে হয়। এগুলো অনেক আগেই রপ্ত করতে শিখে গেছে রোহান। সংসারের বিশাল মঞ্চে রোহানের চরিত্র অদ্ভুত।
যদিও দুঃখ মানুষের বিভিন্ন অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানসিক যন্ত্রণার এক বিমূর্ত প্রকাশ, তবুও তার আচার-আচরণে যে ছায়া পড়ে, তা থেকে পালিয়ে থাকা যায় না। অন্যরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। মায়ের সামনাসামনি হলেই রোহান তা বুঝতে পারে। অবশ্য এর পেছনের কারণ উদ্ঘাটনে রোহানকে সংগ্রাম করতে হয়নি।
জ্যোতির হাতের মুঠোয় মহাসাগরসম রঙিন জগৎ। সে জগতের মধুরতা স্বামী ও শাশুড়ির মধ্যে যে অনুপস্থিত, তা রোহান বেশ কিছুদিন থেকেই বুঝতে পারে। সে কাছ থেকে দেখেছে, জ্যোতির বেশ খানিকটা সময় কাটে ইউটিউব আর ফেইসবুকে। সেখানে মায়ের গুরুত্ব যে ঢের নয়, তা সহজেই অনুমেয়। এনিয়ে বেশ কয়েকবার মন কষাকষি, কথা কাটাকাটি হয়েছে। শুধু তাই নয়, জ্যোতির মোবাইলটাও ব্যস্ত থাকে। কে বা কারা জ্যোতিকে ব্যস্ত রাখে সারাদিন? সেই প্রশ্নের উত্তরটা জানার অদম্য স্পৃহা রোহানকে তাড়া করে বেড়ায়। তার সকল সুখকে কেড়ে নেয়। অফিসের কাজেও মন বসাতে পারে না।
একদিন রোহান অফিস থেকে দেরিতে বাসায় ফেরে। মাও হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। সে মায়ের খোঁজ-খবর নেয়Ñশরীর খারাপ কিনা, খেয়েছে কিনা ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে জ্যোতিকে।
“শরীর খারাপ কিনা বলতে পারবো না। খাবার তো টেবিলেই আছে। ক্ষুধা লাগলে তো খেয়ে নেয়। খেয়েছে হয়তো।”
রোহান স্ত্রীর উত্তরে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও, তার ভিতরে যে একটা পারমাণবিক বোমার জন্ম নেয়, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর কালবিলম্ব না করে সে ঘুমাতে যায়। সারারাত দু’চোখ বন্ধ করে ছিল ঠিকই, কিন্তু ঘুম তার চোখে ভর করে না। তা যেন ভয়ে হাজার ক্রোশ দূরে পালিয়ে যায়। কী কারণে জ্যোতির আলো নিষ্প্রভ? কী তাদের মধ্যকার সম্পর্কের দূরত্ব বাড়িয়েছে? এমন হাজারও প্রশ্ন তার সামনে এসে হাজির হয়। এর ভেদ উদ্ঘাটন করা যে একজন পুলিশ অফিসারের পক্ষে কঠিন হবে না, তা হয়তো জ্যোতি ভুলে গেছে। সময় অনেকটা গড়িয়েছে। আর নয়। এখন যেভাবেই হোক, একে থামাতে হবে।
সকালে উঠে রোহান জ্যোতিকে বললো, “ও হ্যাঁ, তোমাকে তো বলাই হয়নি। আমার কাল পরশু দুই দিন পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং আছে। আজ দুপুরেই রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। মা ঘুম থেকে উঠলে বোলো।”
রোহান লক্ষ্য করেছেÑট্রেনিংয়ের কথা শুনে জ্যোতির চোখেমুখে কেমন যেন খুশির আভা ফুটে ওঠে। এরকম একটা দিনের জন্যই যেন সে অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষার পালা যেন আজ শেষ হলো!
রোহান মিথ্যার আশ্রয় নেয়। সে রাজশাহীতে যায় না। ঢাকাতেই রয়ে যায়। বিকালে মায়ের সঙ্গে রোহানের কথা হয়। রাজশাহীতে ভালোভাবে পৌঁছেছে জেনে মা খুশি হয়। কথার ফাঁকে সে বলে, “জ্যোতিকে কোথায়? ওকে ফোনটা দাও।” মা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, “ও তো একটু বাইরে গেল। কী যেন কিনবে। এখনই চলে আসবে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে রাখি।”
মা যে কিছু লুকালেন, তা রোহান বুঝতে পারে। ছেলের মনে সন্দেহের দানা বাঁধুক, সংসারে অশান্তি হোকÑমা তা চায় না। মায়ের বুকের অথৈ সাগরে যেটুকু সে দুঃখ দেখেছে, তা উপরে ভেসে থাকা ভাসমান বরফের এক টুকরো মাত্র।
রোহান জ্যোতির মোবাইল ট্র্যাক করে দেখেছে যে সে কখন বাড়ি থেকে বের হয়েছে এবং কোথায় কোথায় সে অবস্থান করছেÑসবই তার নলেজে রয়েছে। পরের দিন একইভাবে জ্যোতি সকালে বের হয়। রোহান ছুটে যায় সেই স্থানে। ছদ্মবেশে রোহান তাকে খুঁজতে থাকে। শেষপর্যন্ত খুঁজে পায়। দেখেÑএকটা বিলাসবহুল রেঁস্তোরায় বসে জ্যোতি তার প্রিয় মানুষটির হাত ধরে গল্প করছে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওরা দম্পতি নয়।
ক্ষীপ্র গতিতে বের হয়ে যায় রোহান। সোজা চলে যায় কাজী অফিসে। সেখানে ডিভোর্স লেটারে সই করে। তারপর সোজা চলে আসে বাড়িতে। দরজা খুলে মা বলেন, “কিরে, এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এলি? কেমন যেন দেখাচ্ছে তোকে? কোনো সমস্যা?”
“মা, আমার কোনো সমস্যা হয়নি। একটু একা থাকতে দাও।”
“বউমা যে কোথায় গেল? কতক্ষণ হয়ে গেল, এখনো ফিরলো না।” মা কথাগুলো বলতে বলতে শোবার ঘরে প্রবেশ করেন।
মিনিট দশেক না হতেই কলিং বেলটা বেজে ওঠে। রোহান নিজেই দরজা খুলতে এগিয়ে যায়। পিছনে মা এসে দাঁড়ায়। রোহানকে দেখেই জ্যোতি চমকে ওঠে।
“তুমি কখন এলে?”
“এটা জানার কোনো প্রয়োজন নেই।”
রোহান খামটা তার দিকে এগিয়ে দেয়।
“কী এটা?”
“মুক্তির সনদ। এটা সকল ভয়-ভীতি থেকে মুক্তি দেবে। প্রিয় মানুষটির সঙ্গে মুক্ত আকাশে বিহঙ্গের মতো ওড়ার শক্তি যোগাবে।”
কথাগুলো বলেই রোহান ঘরের দরজাটি তার জন্য চিরতরে বন্ধ করে দেয়।
কম্পমান হাতে জ্যোতি খামটি খোলে। দেখেÑডিভোর্স লেটার। তপ্ত অশ্রু কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে খামের উপর। গলা শুকিয়ে যায়। চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে সে। চারদিক থেকে ভয়ংকর আঁধার তাকে গ্রাস করার জন্য ধেয়ে আসে।