মামুন সরকার
শরতের সকাল। আকাশটা যেন আজ রঙিন খাতার প্রথম পাতা। নীলের ভাঁজে সাদা তুলোর মতো মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে, যেন কেউ আকাশজুড়ে তুলো মিছরি ছড়িয়ে দিয়েছে।
শ্রুতি আর আতিকা দু’জন চাচাতো বোন। বয়স বারো ছুঁইছুঁই করছে। দু’জনই ক্লাস সেভেনে পড়ে। শ্রুতি থাকে ঢাকার উত্তরাতে আর আতিকা থাকে পুরান ঢাকার সদরঘাটে। দু’জনের জন্মই ঢাকাতে। এই প্রথম ওরা এক সাথে গ্রামে দাদার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। পথের দু’পাশে সারি সারি গাছ, খোলামেলা ফসলের মাঠ, সান বাঁধানো পুকুর ঘাট সবকিছুই ওদের মনকে আন্দোলিত করে। এমন সবুজ ছায়া নীরব পরিবেশ ঢাকাতে নেই। আকাশছোঁয়া ইটের দালান আর গাড়ির বেপরোয়া হর্ণের শব্দে ক্লান্তিকর এক জীবন। দু’জন একসাথে গ্রামের এদিক-সেদিক ছুটে বেড়ায়। নীলের ওপর সেই মেঘেদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু ছুঁতে পারে না। রাস্তার ধারে হাঁটুজলে শাপলা শালুক ভাসছে। ওদিকে নজর পড়তেই দু’জনেই শাপলাফুল তুলতে হাঁটুজলে নেমে গেল। শাপলা শালুক যেন ওদের হাত বাড়িয়ে ডাকছে। ফুলগুলো বাতাসের কম্পনে জলের বুকে হাসিমুখে মাথা দুলিয়ে নাচছে। শ্রুতি হাত বাড়িয়ে একটি শাপলা তুলে নিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে আতিকার নজর কাড়তে বলে, দেখ্ দেখ্ , শাপলা পাতার নৌকা। ফুলগুলো যেন নৌকার পাল। আতিকা কোনোকিছু না বলে সেও শাপলাফুল মুঠি চেপে টেনে আনে। মৃদু বাতাসে জলে ঢেউ খেলতে থাকে। তাদের পা কাদার মধ্যে একটু ডেবে যায়। শাপলাসহ উপরে উঠে আসতে একটু কষ্টই হয়। তবু তাদের চোখে আনন্দ। ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। হাঁটুজলে নেমে শাপলা তুলতে পেরেছে।
বিকেলবেলা বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে নদীর পাড়ে গিয়ে অবাক। বিশাল একালা জুড়ে কাশ বন। কাশবনের ভেতর ঢুকে পড়ে দু’বোন। সাথে সঙ্গী-সাথীরাও। কাশফুলগুলো সাদা রাজহাঁসের পালকের মতো উড়ে উড়ে দুলছে। হালকা বাতাসে কাশফুলের পাপড়িগুলো যেন হাসছে, আর ফিসফিস করে গল্প করছে।
হঠাৎ মাথার ওপর রঙবেরঙের ফড়িং উড়তে শুরু করে। লাল, সবুজ, হলুদ যেন রঙতুলি দিয়ে কেউ আকাশে আঁকিবুকি করে দিয়েছে। শ্রুতি হাত বাড়াল ধরতে, কিন্তু ফড়িংগুলো ধরা দিল না। ওরা যেন দুষ্টুপরী, যারা শুধু আনন্দ দিয়ে উড়ে বেড়ায়।
মাঠের ধারে সবুজ ধানের চারা ঝুঁকে পড়েছে। এখনো শীষ বের হয়নি। সারা মাঠ জুড়ে এ যেন এক সবুজের গালিচা। আতিকা বলে উঠল, দেখ্ শ্রুতি পুরো মাঠটা যেন সবুজের গালিচা।
শূন্যে কিছু বাজপাখি উড়ে উড়ে চক্কর দিচ্ছে। আবার কোথাও শালিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। চারদিকে সূর্যের আলো চিকমিক করছে। ছোট ছোট কিছু পাখি ছোঁ মেরে ফড়িং ধরে অন্যত্র চলে যায় আবার ফিরে আসে। মাথার ওপরে সাদাকালো মেঘের রাশি উড়ে যায় আর কয়েক সেকেন্ড ঝরে পড়ে। এ যেন মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা।
দু’জনেই দৌড়ে গিয়ে ধানক্ষেতের আলে পা রাখে। তাদের পায়ের শব্দে একজোড়া সাদা বক উড়ে যায়। বিকেলের নরম রোদ। নদীর পাড়ে গাছের পাতার ফাঁকে অদ্ভুত আলোছায়ার খেলা চলে। দেখে মনে হয় যেন শরৎ নিজে এসে ছবি এঁকে দিয়েছে।
দু’জনের চোখের তারায় শুধু শরতের ছবি। নীলে সাদাকালো মেঘের ভেলা। বাতাসে কাশফুলের দুল। মাথার ওপর ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি। সবুজ ধানক্ষেত, সব মিলিয়ে একটা চিত্রকল্প মনের মাঝে গেঁথে আছে।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে খেয়াল করল, আকাশের মেঘগুলো ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে। সোনালি সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধানখেতের ওপারে দিগন্তরেখা ঘেঁষে। আর লালচে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে নদীর বুকে। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নীড়ে।
শ্রুতি মৃদু কন্ঠে বলে, শরৎ শুধু ঋতু নয়, এটা যেন আমাদের খেলার রঙিন বই।
আতিকা মাথা নেড়ে বলে, “হুম”।
তারা দু’জনেই ভাবে, শহরে শরৎ বলে কিছু নেই। ঋতু যায় আর আসে। কিন্তু ঋতু-বৈচিত্র্যের কোন রঙ চোখে ধরা পড়ে না। আজ গ্রামে না এলে বুঝতেই পারত না শরৎ ঋতুর বৈচিত্র্য কত সুন্দর এবং নান্দনিক। ওরা বাড়ির দিকে হাঁটে আর ক্ষণে ক্ষণে পিছু ফিরে চায়। দেখে বাতাসে কাশফুলেরা মাথা দুলিয়ে ওদের বিদায় শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক সাদা বক উড়ে যায়। দু’বোনের মনে লেগে থাকে কাশফুলের নরম ছোঁয়া।