আব্দুস সালাম
গালিব সাহেবের নাম শুনলেই আজও গ্রামের মানুষ শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায়। এমন মানুষ বিরলধর্মে দৃঢ়, আচরণে শান্ত, আর হৃদয়ে যেন এক অপার দয়ার উৎস। গ্রামের গরিব-দুঃখীদের তিনি নিজের সন্তান বলেই মনে করতেন। কিন্তু তাঁর জীবনের এক গোপন অধ্যায় নিয়ে আজও কানাঘুষা চলে।
সে এক বর্ষার সকাল। আকাশে কালো মেঘের আসর, চারদিক ভিজে একাকার। এমন সময় গ্রামের বাঁশঝাড়ের নিচে এক নবজাতকের কান্না ভেসে আসে। কাঁপতে কাঁপতে লোকেরা সেখানে গিয়ে দেখে, এক ছোট্ট শিশুমাটির ওপরে কাঁথা জড়িয়ে পড়ে আছে। সবাই অবাক, কিন্তু কেউই হাত বাড়াল না। মানুষের মন কত তুচ্ছ ভয় আর সমাজের দোহাইয়ে বন্ধ হয়ে যায়!
সেই মুহূর্তে গালিব সাহেব এগিয়ে এলেন। মাটির ওপর থেকে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন, বুকে চেপে বললেন,
“মানুষ যদি মানুষকে না তোলে, তবে আল্লাহ কাকে পাঠাবেন?”
গালিব সাহেব মেয়েটিকে তার স্ত্রীর কোলে তুলে দিলেন। তার নাম রাখলেন খুশবু। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন, “ও আমার মেয়ে। তুমি নিজের মেয়ের মতো করেই লালন-পালন করো। তার যেন কোন অযত্ন না হয়।”। সেই দিন থেকেই খুশবু হয়ে উঠল তাঁর ঘরের আলো, তাঁর জীবনের অনন্ত মমতার প্রতীক।
বছর গড়াল। খুশবু বড় হতে লাগল যেন সকালবেলার শিশিরভেজা ফুল ফুটছে ধীরে ধীরে। গ্রামের লোকেরা বলত, “রূপে গুণে সে যেন অপ্সরা।” কেউ আবার ঈর্ষায় বলত, “বাঁশঝাড়ের কন্যা আজ রূপে রানি!” কিন্তু গালিব সাহেব এসব কথায় কর্ণপাত করতেন না। তাঁর চোখে খুশবু ছিল মমতার প্রতিমূর্তি, তাঁর হৃদয়েরই প্রতিধ্বনি।
খুশবু মাদরাসা থেকে স্কুল সবখানেই প্রথম সারির ছাত্রী। তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, বিনয়, আর চোখে যেন স্নিগ্ধ আলোর ছায়া। গালিব সাহেব প্রার্থনা করতেন, “হে আল্লাহ, যাকে তুমি আমার কোলে দিয়েছ, তার ভাগ্যে যেন কষ্ট না থাকে।”
সময় এল। গালিব সাহেবের ছোট ভাইয়ের ছেলে, নাহিয়ান রূপে, শিক্ষায়, বংশে সমৃদ্ধ। তাকেই বেছে নেওয়া হলো খুশবুর স্বামী হিসেবে। বিয়ের প্রথম দিকে নাহিয়ান স্ত্রীর সৌন্দর্যে বিমোহিত ছিল। তার চোখে খুশবু ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। কিন্তু মানুষের মন বড়ই চঞ্চল। ধীরে ধীরে রূপের পেছনের আত্মাটাকে সে ভুলে গেল।
একদিন রাগের উন্মত্ততায় সে বলেছিল
“তুই তো কুড়োনো মেয়ে! আমাদের বংশে কলঙ্ক এনেছিস!”
খুশবু নীরবে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদুস্বরে বলল
“আমি তো কারও ক্ষতি করিনি, নাহিয়ান। আমি শুধু ভালোবাসতে শিখেছি। এতে আমার কী অপরাধ বলো?”
তারপর থেকেই তার জীবনে নেমে এল দীর্ঘ নীরবতা। চোখে অশ্রু, মুখে হাসি -এই ছিল তার প্রতিদিনের মুখোশ।
অল্পদিনের মধ্যেই নাহিয়ান দ্বিতীয় বিয়ে করল রোজিনা নামের এক মেয়েকে। রোজিনা এক আধুনিক শহুরে মেয়ে। পোশাকে, কথায়, আচরণে সে যেন ঝড়ের মতো। সামাজিক মাধ্যমে খুশবুকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত, গালিগালাজ দিত। তবুও খুশবু নীরব।
খুশবুর এক ছেলে, এক মেয়ে ওদের ভবিষ্যৎই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। একবার একটি স্কুলে খুশবু চাকরি পেয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিল, এ হয়তো আল্লাহর দান। কিন্তু নাহিয়ান ভয় পেয়ে বলল
“তুমি বাইরে গেলে, অন্য পুরুষেরা তোমায় দেখবে। আমি সেটা সহ্য করব না। তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য আর চাষাবাদে যা আয় হয় তা আমাদের সংসারের জন্য যথেষ্ট।”
খুশবু শান্ত গলায় বলেছিল
“ তোমার মনে যদি শান্তি আসে, আমি চাকরি ছাড়ব।”
এভাবেই সে জীবনের এক একটি স্বপ্ন ত্যাগ করল, যেন নীরব পুষ্প নিজের গন্ধ বিলিয়ে নিঃশেষ হয়।
পঞ্চাশের আগেই নাহিয়ানের ক্যান্সার ধরা পড়ল। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যে রোজিনাকে সে ভালোবেসে সংসার গড়েছিল, সেই রোজিনাই প্রথমে পালাল অন্য এক পুরুষের হাত ধরে।
তখন পাশে রইল শুধু খুশবু যে নারীকে একদিন সে অস্বীকার করেছিল, অপমান করেছিল, অবজ্ঞা করেছিল।
হাসপাতালের শয্যায় কৃশদেহ নাহিয়ান খুশবুর দিকে তাকিয়ে বলল
“তুমি কেন এলে, খুশবু? আমি তো তোমায় দূরে ঠেলেছিলাম।”
খুশবু ধীরস্বরে বলল
“তুমি অসুস্থ, তাই এসেছি। আমি তোমার সন্তানদের মা। তোমার সংসারের ছায়া আমি কখনও সরাইনি।”
দিন গড়াতে লাগল। নাহিয়ানের দেহ ক্ষয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু অন্তর জেগে উঠল তীব্র অনুতাপে। এক রাতে কাঁপা হাতে খুশবুর হাত ধরে বলল
“খুশবু, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করো, না হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না।”
খুশবু তখন তার দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল-
“নাহিয়ান, আমি অনেক আগেই তোমায় ক্ষমা করেছি। আমি জানতাম, আমি এই পৃথিবীতে কারও সন্তান নই।
যেদিন তুমি আমাকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করলে, সেদিনই ভেবেছিলাম, আমি আশ্রয় পেয়েছি। তোমার সন্তানদের আমি জন্ম দিয়েছি- এটাই আমার গর্ব। তোমার ভালোবাসা না পেলেও, তোমার নামের মর্যাদা পেয়েছি। এটাই আমার তৃপ্তি।”
নাহিয়ানের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে বলল-
“তুমি মানুষ নও, খুশবু, তুমি আল্লাহর পাঠানো এক মমতার ফুল।”
শেষ বয়সে নাহিয়ান কুরআনের আয়াত মুখস্থ করতে লাগল, আর প্রতিদিন নামাজ শেষে দোয়া করত-
“হে আল্লাহ, আমি যাকে কষ্ট দিয়েছি, তাকে তুমি সুখ দিও।”
এক সন্ধ্যায় খুশবু নামাজ শেষে এসে দেখে- নাহিয়ান শান্ত মুখে চিরনিদ্রায় শায়িত। ঠোঁটে এক হালকা হাসি, যেন অনেকদিনের ভার নামিয়ে রেখেছে।
খুশবু জানালার ধারে গিয়ে বলল
“তুমি ক্ষমা পেয়ে গেছো, নাহিয়ান। কারণ ভালোবাসা কখনও মরে না- ভালোবাসা ক্ষমা করতে জানে।”
এরপর খুশবু আর অন্য কোনো আশ্রয় নেয়নি। দুই সন্তানকে মানুষ করেছে নিজের মতো করে-মা, শিক্ষক, বন্ধু সব ভূমিকায়।
গ্রামের মানুষ তখন বুঝতে শিখেছিল- মানুষের জন্ম নয়, তার মানবতাই তার পরিচয়। ভালোবাসা যদি ক্ষমা করতে জানে, তবে সেই ভালোবাসাই সত্য; আর যে নারী ক্ষমার মহিমা বোঝে, সেই-ই প্রকৃত মহীয়সী।
আজও গ্রামের মানুষ বলে-
“যে বাঁশঝাড়ে একদিন কান্নার শব্দ উঠেছিল, সেখান থেকেই তো মমতার আলো ছড়িয়েছে সারা গ্রামে।”