তাহনিয়া তরিক

গতকাল ক্লাসে অহনার সাথে ঝগড়ার কথাটা মনে পড়তেই সাত সকালে মনটা বিষিয়ে গেল। মন সমুদ্রের তিন নম্বর সর্তক সংকেতের মতো সিগন্যাল দিচ্ছে মাথার অনু পরমাণুগুলো যেকোন সময়ে সংর্ঘষ বাধাতে পারে। স্থির হয়ে পড়ার টেবিলে বসতেই পারছে না নিশাত। নাস্তার টেবিলে ওর নিজের জন্য বাছাই করা বড় ডিমপোচ, আর মুচমুচে পরাটার প্লেটটা চেয়ে বসেছে জেরিন। সামনে বাবা বসে না থাকলে কিছুতেই দিত না ওকে। নাস্তা শেষে মাথাটা ঠান্ডা করার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে এনে টেবিলে বসলো ও। এক চুমুক দিয়েছে কি দেয়নি, ‘আপি একাই খাচ্ছ? আমাকেও বানিয়ে দাওনা এককাপ? Ñআদুরে আবদার নিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো জেরিন। ‘পারবোনা পারলে নিজে বানিয়ে খাও গিয়ে।’- ঝাঁঝিয়ে উঠলো নিশাত।

: আমি কফি বানাতে পারি না।

: তাহলে খাওয়ারও দরকার নেই।

: তুমি তো বিরানী রান্না করতে পারো না।

: তো, কি হয়েছে?

: তাহলে মামণি রান্না করলে খাও কেন?

: থাপ্পড় খাবি একটা। যা তো এত ফটফট করিস না।- মেজাজ এবার প্রচন্ড তেতে গেছে নিশাতের। খানিকক্ষণ দাঁড়ালে থাপ্পড়ই ভাগ্যে জুটবে বুঝতে পারলো জেরিন-

:যাচ্ছি, তার আগে বড়’পু প্লিজ! তোমার প্যাস্টেল কালারের বক্সটা দাওনা। কাল ড্রইং পরীক্ষা আছে।

:খবরদার! আমার কালার বক্স ধরবি না। তুই ক্লাস থ্রীর পিচ্চি, তোর পেন্সিল দিয়েই রং করবি। অত প্যাস্টেল কালার লাগবে না। -বক্সটা সেল্ফ থেকে এনে টেবিলে চোখের সামনে রাখল নিশাত।

মুখ গোমড়া করে চলে গেল জেরিন। ধুর! ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে কফিটাই ঠান্ডা হয়ে গেছে। ‘নিশাত, বিছানা গুছিয়ে পড়তে বস।’ Ñদরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন মিসেস সায়মা ইসলাম। ‘মামণি, বিছানায় কি আমি একাই ঘুমাই? আমি গুছাতে পারব না। শ্যামলীকে বলো গুছিয়ে দিতে।’- গলায় শত বিরক্তি ঢেলে বলল নিশাত। ‘শ্যামলীর আরও অনেক কাজ আছে। জেরিন তো ছোট ও কিভাবে গুছাবে? তোমার বিছানা তুমিই গুছাবে। নাও তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও’- ওয়াশিং মেশিনে দেয়ার জন্য আধোয়া কাপড়গুলো বেছে নিতে নিতে বললেন মামণি। মামণি চলে গেলেন। উঠে দাঁড়ালো ও। ’যত্তোসব’-গজগজ করতে করতে কোন রকম বিছানার চাদর ধরে হ্যাচকা টান দিলো। কাজ হওয়ার চেয়ে বাড়লো দ্বিগুণ। বালিশ, কাঁথা সব ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। ক্লাসের ঘটনা নিয়ে বিষিয়ে থাকা মনটা সত্যিই এবার ফুঁসে উঠলো। ছুটির দিনটাতে ভালো করে পড়াশুনা করবে বলে রুটিন করে রেখেছিল। সকালেই সব গুবলেট হয়ে গেল। অবশ্য কাকে দোষ দিবে ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না ও। কারো উপর দোষগুলো সব চাপাতে পারলে মাথা একটু হালকা হত। ফ্রিজ খুলে দু’টো টসটসে কমলা নিয়ে এসে টেবিলে বসলো ও। কমলার কোয়া ছাড়াতে ছাড়াতে রসায়ন বইটা খুলে ধরলো চোখের সামনে। নাহ! কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না ওর। নতুন অধ্যায়টা কাল রাতে আব্বুর কাছে বুঝে নিতে হত। কিন্তু সিরিয়াল ছেড়ে ঐ রসকষহীন রসায়ন বুঝার ধৈর্য্য ওর ছিল না। যাক আজকে বিকালে বসতে হবে। পদার্থ বইটা খুললো। একই অবস্থা। নতুন ক্লাসে ম্যাডাম কি বুঝিয়েছেন মনে পড়ছে না।

ঝিমঝিম করছে মাথাটা। অক্ষরগুলো সব ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের সামনে। অনেক রাত জেগে কাজিন শাওলীর সাথে চ্যাট করার ফল। আর ভালো লাগছে না পড়ার টেবিলে বসে থাকতে। উঠে দাড়ালো নিশাত। একটা শাল জড়িয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো বাইরে। বের হতেই অবাক লাগলো নিশাতের। অনেক সকাল হয়েছে তাও রাস্তাঘাট ফাঁকা। দু’একটা রিকশা টুংটাং বেল বাজিয়ে চলে গেল। তারপর সব নীরব। নির্জন রাস্তায় ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে খুব ভালো লাগছে ওর। শিশিরে ভিজিয়ে দিচ্ছে পা। মনটা অদ্ভুতভাবে ভালো হয়ে গেল। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে আসলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখল চারপাশ। রাস্তার একধার দিয়ে খুব সুন্দর করে ছাটা ফুলের ঝাড়। রং বেরংয়ের ফুলের ছড়াছড়ি তাতে। আরেক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। কাচের মতো স্বচ্ছ তার নীল পানি। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে সোনালী, রূপালী মাছের ঝাঁক। এমন রাস্তা যদি কোনদিনও শেষ না হতো!... আপন মনেই বলে ওঠে নিশাত। এমন নীরব পরিবেশ, মূদুবাতাস, মন মাতানো ফুলের সুরভী, নীলপানির স্বচ্ছ ঢেউ এত্ত সুন্দর! হঠাৎ খেয়াল হলো আগে কখনো এত সুন্দর দৃশ্য জীবনেও দেখেনি কেনও? বাসার কাছে এত মনোহর প্রকৃতি থাকতে কত জায়গায় ঘুরেছে আব্বু আম্মুর সাথে প্রকৃতি দেখার জন্য! আচ্ছা! অবাক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরালো নিশাত-ঢাকা শহরে নদী এল কোথার থেকে? আর তার সাথে সাথেই ও খেয়াল করে দেখল আশেপাশের পরিচিত দৃশ্যপট ছেড়ে ও এখন অচেনা রাস্তায় চলে এসেছে। এটা ভাবতেই কিছুটা ভয় এসে ঘিরে ধরল ওকে-‘পথ হারিয়েছে ও?’ এত সুন্দর পথের শেষ না দেখে ফিরতেও মন চাচ্ছে না. অবশেষে একটা থ্রিলিং ভাব নিয়ে এগিয়ে চলল সামনে। চলতেই আছে ও। মনে হচ্ছে সারা জীবন ধরে চললেও পথ শেষ হবে না। হঠাৎ নাকে তীব্র মিষ্টি সুবাস এসে ঠেকল নিশাতের। আগের চেয়েও হৃদয়কাড়া ঘ্রাণ। সেই সাথে কানে এলো মধুর একটি সুর. আরো খানিকটা হাঁটার পর রাস্তাটা একটা বাগানের দরজায় গিয়ে শেষ হলো। বাগানের ভিতরে প্রবেশ করতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল নিশাত। একসাথে এত ফুল আর এত সৌন্দর্য কখনও দেখেনি ওর চোখ। রাস্তার ফুলগুলো এর কাছে কিছুই না। মিষ্টিসুবাসটা ফুল থেকেই আসছে টের পেল। নীল রংয়ের গোলাপ বাগানটা পার হয়ে সামনে যেতেই দেখলো একসারি ঝাউগাছের তলে সারি দিয়ে বসে আছে অনেকগুলো মেয়ে। বয়সে ওর সমানই হবে। পরনে সাদা ধবধবে লেহেঙ্গার উপর সোনালী জরির ওড়না. সবার সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে সুর করে কি যেন পড়ছে। ও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই বুঝলো কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করছে মেয়েটা। এমন সুমিষ্ট কন্ঠ কখনো শোনেনি নিশাত।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিল মেয়েটার তেলাওয়াত। এমন সময় কয়েকটি মেয়ে হাতের ইশারা করে ডাকলো ওকে। নেশার ঘোরের মতো সামনে এগিয়ে যেয়ে পিছনের সারিতে বসে পড়লো ও। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বসার সাথে সাথেই ওর ড্রেসটাও সাদা আর সোনালী হয়ে গেল। এটাকে ওর কাছে একটা ক্লাস বলে মনে হলো। ‘কত সুন্দর বাগান স্কুল! কত সুন্দর ওদের ড্রেস!’ Ñ মনে মনে ভাবল নিশাত। সামনের তিলাওয়াতকারী মেয়েটার চেহারা পিছন থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। চুপ করে সবাই তিলাওয়াত শুনছে। অনেক্ষণ পরে একসময় থেমে গেল সুমধুর সুর। সামনে মঞ্চের মতো একটা জায়গায় উঠে দাঁড়ালেন সবুজ ঘাঘরা পরা একজন মহিলা। ইনি বোধ হয় টিচার হবেন-মনে মনে বললো নিশাত। ‘প্রথমেই মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। রাসূল (সা.) এর শানে দরুদ পাঠাচ্ছি। শাহজাদী সামিনা সুলতানার কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমাদের আজকের ক্লাসের উদ্বোধনী ঘোষণা করছি।’- উদ্বোধনী ঘোষণার পরে আরো অনেক কিছু পড়ালেন সবুঝ ম্যাডাম। যার কিছুই নিশাতের বোধগম্য হচ্ছিল না। আশপাশের মেয়েরা ঝটপট রেসপন্স করছিল। অথচ ও নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে দেখছিল সব। সবশেষে ম্যাডাম অংকন ক্লাসের ঘোষণা দিয়ে নেমে গেলেন। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল মেয়েরা। বাগানের এধারে ওধারে বসে পড়ল যার যার বোর্ড রংতুলি নিয়ে। সাথে ব্যাগ নেই নিশাতের। কিসে আঁকাবে ও? ইস্ প্যাস্টেল কালার বক্সটা নিয়ে আসলে কত্ত সুন্দর ছবি আঁকাতে পারতো! একটা নাইট কুইন গাছের পাশে বসেছে ৫/৬ জন মেয়ে। ওদের কাছে যেয়ে বসলো নিশাত। তারপর ধীরে ধীরে বললো- ‘আমি নতুন তো, তাই কিছু নিয়ে আসিনি। আমাকে একটু হেল্প করবে? অনেক সুন্দর ছবি আঁকাতে পারি আমি।’ ওর দিকে তাকালো একটা মেয়ে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সঙ্গীদের সাথে কি যেন বলল। তারপর ডানে বায়ে মাথা নাড়লো ‘না আমরা তোমাকে হেল্প করবো না।’ ‘কেন আমি কি তোমাদের তুলি ভেঙে ফেলবো না খেয়ে ফেলবো? -রাগ হচ্ছে নিশাতের। ‘দেখ, এভাবে কথা বলো না। আমরা কেউ এখানে এভাবে কথা বলি না।’ আরেকটি মেয়ে এগিয়ে এসে বলল - ভেঙে ফেলার প্রশ্ন আসছে না এখানে। তুমি যেমন জেরিনকে কিছু দিতে চাও না, তেমনি আমরাও তোমাকে কিছু দিতে চাচ্ছি না।’ বিস্ময়ে আকাশ ভেঙে পড়লো নিশাতের মাথায়। জেরিনকে ওরা কিভাবে চিনলো? জেরিন এখানে এসেছিল? ওদের কাছে বোনের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে? কিভাবে? - কিছুই ভেবে পায় না ও। পায়ের শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকালো। একটি মেয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। যেই মেয়ে দু’টি নিশাতের সাথে কথা বলছিল তাদের কাছে যেয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো- ‘শাহজাদা, নাজওয়া একী?’ চমকে তাকিয়েছে মেয়ে দু’টোÑ ‘বলুন শাহজাদী।’ ‘তোমরা ওর সাথে যে আচরণ করেছ সেটা কি ঠিক হয়েছে? ও ওর বোনের সাথে যেমন তেমন আচরণ করতে পারে, কিন্তু তোমরাও কি তাই শিখেছ?’Ñ হালকা গলায় কথাগুলো বললো মেয়েটা। রাগের গলাও মানুষের এত সুমিষ্ট হয়! লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসছে নিশাতের। জেরিনটা ওর মান ইজ্জত ডোবালো। ‘আসো নিশাত আমার সাথে।’- মেয়েটা ওর হাত ধরলো। একজায়গায় নিয়ে এসে একটা বোর্ড আর রংতুলি এগিয়ে দিল-নাও আমার জিনিস, এগুলি তুমি আগে একে নাও তারপর আমি আঁকবো। কি আঁকতে হবে জানো তো? ক্যালিওগ্রাফি। ক্যালিওগ্রাফি প্রদর্শনীতে আব্বুর সাথে গিয়েছে নিশাত। আঁকা শিখেনি। আমি ক্যালিওগ্রাফি আঁকতে পারি না। তুমিই আঁকো-বলল নিশাত।’ ঠিক আছে আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব’-বলতে বলতে রংতুলি হাতে নিল মেয়েটি। পাশে বসে দেখছে নিশাত। মেয়েটির চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখছে ও। অপরূপা সুন্দরী মেয়েটি। শিল্পীর ভঙ্গিতে আরো মনোহর দেখাচ্ছে। কোথায় যেনো মিষ্টি একটা সুরের লহরী বেজে উঠল। বাগিচায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেয়েগুলো আবার বসে গেল পূর্বের মতো। এগুলো মেয়ে অথচ কোন হৈ চৈ নেই, নেই কোন বিশৃঙ্খলা।

যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে নিশাত। এবার শাহজাদি নামের মেয়েটার পাশে বসেছে নিশাত। একদম প্রথম সারিতে। মঞ্চে এসে উঠলেন নীল ঘাঘরা পরিহিত একজন টিচার। তার ওড়নার কারুকাজে আলো পড়ে মুহূর্মুহূ ঝলকাচ্ছে। চেহারা থেকেও যেনো আলো বের হচ্ছে। পদার্থ পড়ালেন তিনি। তারপর রসায়ণ, তারপর জীববিজ্ঞান। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পরপর এতগুলো বিষয় পড়ালেন তবুও প্রতিটি লাইন হুবহু মনে গেঁথে গেছে নিশাতের। নাইনে উঠার পর এই প্রথম ও উপলব্ধি করল পদার্থের মধ্যেও এত মজা থাকতে পারে। আসলে নীল ম্যাডামের বুঝানোর ধরনটাই অদ্ভুত মনে হলো। গল্পে গল্পে সহজ করে দিচ্ছেন একেকটা কঠিন সংজ্ঞা। সাথে সমানভাবে কুরআনের আয়াত বলে যাচ্ছেন অর্থসহ। নিশাত কখোনো কল্পনাও করেনি কুরআন আর রসায়নের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। এক সময় শেষ হল ক্লাস। বাগানে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন খেলায় মেতে উঠল মেয়েরা। সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করালো সুন্দর জরির কুর্তা পড়া একজন বালক। বয়স ৮/৯ বছর হবে। নিশাতকে নিয়ে একটা দোলনায় চড়লো শাহজাদী। ধীরে ধীরে দোল খেতে খেতে বলল-‘আমার নাম শাহজাদী সামিনা সুলতানা।’

: আমার নাম সাফওয়ানা নিশাত।

: জানি।

: কিভাবে জানো বলতো?

নিশাতের প্রশ্নের জবাবে মুচকি হাসলো সামিনা। মুক্তা ঝড়ে পড়লো যেন। ইস! ওর সবগুলো বান্ধবী যদি মেয়েটার মতো হত! তাহলেই তো আর ক্লাসে গতকালের বিশ্রী ঝগড়াটা হতো না, আপন মনে ভাবছে নিশাত। ওর প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে শাহজাদী সামিনা। একটা ডালিমের দানা ছাড়াচ্ছে। ‘আচ্ছা তুমি কি এখানকার শাহজাদী? মানে প্রিন্সেস?-নীরবতা ভাঙলো নিশাত। আবার মধুর কণ্ঠে হেসে উঠল সামিনা-আরে না না। সবাই ভালোবেসে আমাকে ওই নামটা দিয়েছে। এখানে কেউ প্রিন্সেস হয়না, সবাই সমান।

: হুম বুঝেছি। তুমি সত্যি শাহজাদীর মতো। তুমি খুবই ভালো মেয়ে। আমাকে তোমার আজীবনের বন্ধু বানাবে? আকুতি নিশাতের কণ্ঠে।

: তুমি তো আমার বন্ধুই। আর তুমিও ভালো মেয়ে। কেবল কখন কোনটা করতে হবে বুঝতে পার না।

সামিনার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো নিশাত। এমন সময় অন্য রকম এক লহরী বয়ে গেল বাগানে। তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো সামিনা। এখন ছুটি বলে হাটা শুরু করলো সে। এতক্ষণ পর বাড়ির কথা মনে হলো নিশাতের। মনে পড়লো পথ হারিয়ে এ বাগান স্কুলে চলে এসেছে ও। সামিনার গমন পথের দিকে তাকালো। অদম্য আকর্ষণে চুম্বকের মতো ওকে টানছে। মায়াবিনী ওই হৃদয়ভেদী চেহারা। এখনই সামিনাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না ওর। সাত পাচ ভাবতে ভাবতে পা বাড়ালো সামিনার পিছনে।আরো অনেক সাদা আর সোনালীর আড়ালে হারিয়ে গেছে সে। সবাই খুব দ্রুত হাঁটছে। নিশাত খেয়াল করল আলো নিভে আসছে ধীরে ধীরে। কালো হয়ে আসছে চারদিক। ও দ্রুত পা চালালো। একটি উঁচু দেয়ালের বাইরে এসে থেমে গেছে রাস্তা। দেয়ালের মাঝ বরাবর একটা বড় সুদৃশ্য ফটক। মেয়েরা ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। পা যেন জড়িয়ে আসছে নিশাতের। এত চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি পৌছতে পারছে না। আবশেষে একসময় এসে দাঁড়ালো সুবিশাল গেটে। ভিতরে তাকিয়ে চোখ ফিরাতে পারল না ও। সুউচ্চ মনেরেম প্রাসাদ। সামনে ফোয়ারা। ফোয়ারার পানিতে ভাসছে পদ্ম ফুল। ভিতরে ঢুকতে যেতেই সামনে আবির্ভূত হলো বেগুনী আলখেল্লা পরিহিত ফর্সামত এক লোক-কাকে চাই? ভদ্রভাবেই জানতে চাইলো।

: আমি ভিতরে ঢুকতে চাই।

: পাস আছে?

: জ্বী না। সে রকম কিছু নেই। আমি নতুন।

: গেটপাস ছাড়া তো ঢুকার নিয়ম নেই।

: দেখুন, শাহজাদী সামিনা সুলতানা আমার বান্ধবী।

: সে ও তো গেট পাস দেখিয়েই ঢুকেছে। তুমি দেখতে পারছো না কেন?

এই যে এই জিনিসটা আলখেল্লার ভিতর থেকে একটা সবুজ কার্ড বের করলো লোকটা। সোনালী অক্ষরে কি যেন লেখা কার্ডে। খুব পরিচিত মনে হলো জিনিসটা। অথচ মনেই করতে পারছে না কোথায় দেখেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো ঘাঘরার ভাজে। কোথাও নেই। ওর কাছে কার্ডটা নেই বলেই বোধ হয় সামিনা ওকে সাথে নিতে পারেনি। ইস্! আর দেখা হবে না ওর সাথে? পিছন ফিরলো নিশাত, অদৃশ্য হয়ে গেছে ফুলের বাগান। প্রচন্ড ঠান্ডা এসে জাঁকিয়ে ধরছে। গেট পাসটা যদি থাকতো- ভাবতে ভাবতে গেটের পাশে বসে পড়লো ও। হিম হয়ে আসছে হাত-পা। অবশ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নাড়াতেই পারছে না। চকিতে ঝাড়া দিল অকেজো হয়ে যাওয়া আঙ্গুল গুলো। নিজেকে আবিষ্কার করলো পড়ার টেবিলে।

এতক্ষণ মাথার নিচে থেকে ঝি ঝি ধরে গেছে হাতে। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। জানালাটা আটকে দিয়ে স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে বসলো। চোখের সামনে ভাসছে শাহজাদী সামিনা সুলতানার হৃদয় কাড়া মুখশ্রী, ‘মনোরম সেই প্রাসাদ আর ফুলবাগান। আবার যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তুু..। কি মনে হতেই পদার্থ বইয়ের পৃষ্ঠা গুলো তন্ন তন্ন করে খুজলো নিশাত। বের করে নিয়ে আসলো কাড্র্টা। সবুজের উপর সোনালী হরফ। এইতো গেট পাস। এবার আর ওকে আটকাবে না বেগুনী দারোয়ান। গত সপ্তাহে একটা জে.এস.সি কৃতী ছাত্রী সম্বর্ধনায় আরো অনেক গিফটের সাথে এই কার্ডটা পেয়েছিল। নিতান্ত অবহেলায় রেখে দিয়েছে বইয়ের ফাকে। উচ্ছাসিত হয়ে চোখের সামনে তুলে ধরলো কার্ডটা।কয়েকটা বাক্য লেখা..।

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা সমুন্নত করেন। সে লোকদের দৃষ্টিতে মহান পরিগণিত হয়।” আল-হাদীস।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিশাত। হঠাৎ শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখে ভীত চোখে চেয়ে আছে জেরিন। বড় বোনকে ঘুমন্ত মনে করে পেন্সিল কালার বক্সটা নিয়ে যাচ্ছিল সে। ধরা পড়ে যাওয়ায় হাত থেকে ভয়ে ফেলে দিয়েছে বক্সটা। কাছে গিয়ে বক্সটা বোনের হাতে ধরিয়ে দিল নিশাত-নাও আপু। এটা এখন তোমার। আমার লাগলে দিও ঠিক আছে? নিশাত, নিশাত! আমার কাপড়গুলো ইস্তি করে দিবি মা? দরজায় দাঁড়িয়েছেন সায়মা ইসলাম। ‘জ¦ী অবশ্যই মা।’-মিষ্টি করে হাসলো নিশাত। বড় আপুর আচরণে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে জেরিন। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল নিশাত। পাশে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকালো। একি! লাল সাদা সালোয়ার কামিজে শাহজাদী সামিনা সুলতানা দাঁড়িয়ে আয়নায়। না, না। ও নিজেই আজ থেকে শাহজাদী সামিনা সুলতানা।