আনোয়ারুল ইসলাম

রোজ সকালে পাখির কিচিরমিচির গানে আদিবার ঘুম ভাঙ্গে। বাড়ির পাশেই বুড়াইল নদীর কোল ঘেঁষে শতবর্ষী বটগাছ। এই বটগাছেই প্রতিদিন কম-বেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আনাগোনা দেখা যায়। অতিথি পাখিরাও মাঝে মাঝে এখানে এসে ভিড় করে। দূর-দূরান্তের পাখি পাগল মানুষেরা পাখি দেখার জন্য প্রতিনিয়ত এখানে আসেন। বটগাছের নিচে মিজান মাঝির ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। চায়ের দোকানের সামনে মানুষের বসার জন্য রয়েছে একটি টং। এই টংয়ে বসে মানুষ পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। আদিবাও সকাল বিকাল এখানে বসে পাখি দেখে। পাখির কিচিরমিচির গান শোনে। পাখির প্রতি তার হৃদয়ের টান আছে। বাড়ির সকলেই তা জানে।

একটি পাখির সাথে আদিবার ভাব জমেছে। প্রতিদিন ফড়িং ছানা এনে গাছের নিচে ফাঁকা জায়গায় খেতে দেয়। পাখিটিও গাছ থেকে নেমে আসে এবং ভীতু মনে এদিক সেদিক তাকায় আর খায়। পাখিটি ভয়ে মাঝে মাঝে ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ে গাছের ডালে বসে। আদিবা দূর থেকে তা দেখে। মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। আদিবা এভাবে প্রতিদিন দু’বেলা ফড়িং ছানা খেতে দেয়। কিন্তু পাখিটিকে সে চেনে না। একদিন আদিবা বাবাকে পাখিটির কথা বলে। মেয়ের কথায় বাবা খুবই খুশি হলেন। পরদিন শুক্রবার আদিবা বাবাকে নিয়ে পাখিটির কাছে এলো। সাথে নিয়ে আসা ফড়িং ছানা খেতে দিল। পাখা মেলে লেজ গুটিয়ে পাখিটি মাটিতে নেমে ফড়িং ছানা খেতে লাগল। আর ভয়ে ভয়ে তাদের দিকে তাকায়। আদিবার বাবা মুগ্ধ হয়ে তা দেখে।

এক পর্যায়ে আদিবাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মা,পাখিটির নাম জানো?

- না বাবা, জানি না। -এটি আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল।

-বাবা আমার বইয়ে দেখেছি। আজ তোমার কাছে জানলাম।

- মিশুক পাখি মা। সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারে।

বাবা-মেয়ের কথার মাঝেই পাখিটি দূরে কোথাও উড়ে গেল। আর দেরি না করে তারা বাড়িতে ফিরে এলেন।

এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। পাখিটি আর ভয় করে না। ফড়িং ছানা নিয়ে গেলে আদিবার মাথায় এসে পড়ে। ফড়িং ছানা খেয়ে উড়ে যায়। শিস দিলে আবার মাথায় এসে পড়ে। আদিবা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে ছেড়ে দেয়। পাখিটিও মায়ায় ভরা আদর আগলে নেয়।

একদিন এক কান্ড ঘটে গেল। পাশের বাড়ির রহিম চাচা ধানক্ষেতে কীটনাশক ঔষধ দিলেন। ধানক্ষেতের বিষাক্ত ফড়িং খেয়ে অনেক পাখি মারা গেল। তার আদরের দোয়েল পাখিটারও খোঁজ নেই।

আদিবা আজ সারাদিন দোয়েলের কাছে যেতে পারেনি। বিকেলে গিয়ে ফড়িং ছানা হাতে নিয়ে শিস দেয় কিন্তু পাখি আসে না। কোথাও দেখা যায় না। আদিবার বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। গাছের নিচে অনেক পাখির নিথর দেহ পড়ে আছে। খুঁজতে খুঁজতে দোয়েল পাখির দেখা পেল। নিথর দেহে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদিবা নিজের মনকে আর শান্ত করতে পারছে না। হু হু করে কেঁদে ফেলল। বেদনায় ভারাক্রান্ত মনে পাখিটিকে বাড়িতে নিয়ে এলো। সবাই দেখে কষ্ট পেলেন। শেষে উঠোনের পাশে ফুলবাগানে পুঁতে রাখলেন।

পাখিটি মরার পর থেকে আদিবার মন ভালো নেই। একা একা আনমনে বসে থাকে। মা-বাবা অনেক সান্ত্বনা দেয় কিন্তু তাতেও সে স্বস্তি পায় না। দু’দিন থেকে স্কুলে যায় না। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার দূড়াগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে সে পড়ে। এ স্কুলের নিয়ম কানুন খুবই কড়া। একদিন না গেলে স্যার ম্যাডামেরা বাড়িতে এসে খোঁজ খবর নেন। অনুপস্থিতির কারণ জানতে চান। হালিম স্যার একটু ব্যতিক্রম। তার খুবই রাগ। স্কুল ফাঁকি পছন্দ করেন না। বিউটি ও সেলিনা ম্যাডাম আদর দিয়ে সবার মন জয় করেন। নিজের সন্তানের মতো আদরে আগলে রাখেন। ইমান স্যার ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তিনি সাথে সাথেই ফোনে খোঁজ খবর নেন।

আজ দু’দিন পর সব শিক্ষকেরা বাড়িতে এসে হাজির। আদিবার বাবার কাছে সবকিছু শুনলেন। তারাও শুনে কষ্ট পেলেন। সবাই তাকে সহানুভূতি জানালেন।

বিউটি ম্যাডাম আদিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, এতে মন খারাপ করতে নেই, আদরের পশু-পাখি মারা গেলে সবাই কষ্ট পায়। কিন্তু তা মেনে নিতে হয়।

রহিম চাচা পেছন থেকে এসে আদিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন “ মা, আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দিস। তুই যেমন কষ্ট পেয়েছিস, আমিও অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমি তোমাকে পোষার জন্য একটি ময়না পাখি এনে দিব তবু তুই কাল থেকে স্কুলে যাস। আর এভাবে নিজেকে কষ্ট দিস না।