অনন্য কাওছার

মাহফুজ বেকার জীবনের একটা পর্যায়ে এসে বুঝতে পারল, ঘরেবাইরে কোথাও তার এক পয়সার মূল্য নেই। আগে তার মনে হতো বাইরে নামধাম না থাকুক, পরিবারে তো আছে। পিতামাতা, ভাইবোনদের কাছে নিশ্চয়ই না থাকার প্রশ্নই ওঠে না । অথচ আজ তা ভুল প্রমাণিত হলো। মাহফুজের ছোটবোনের বিয়ে ঠিক হচ্ছে। পাত্রও তার বোনকে দেখে পছন্দ করেছে। বিষয়টি এতদূর গড়িয়ে গেছে। অথচ মাহফুজকে তার কিছুই জানানো হয় নি। এ যাবত মাহফুজ নিজেকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। প্রায়শই ভাবে সে কি মানুষের কাতারে পড়ে? পরিবারের বড়ছেলে হয়েও বোনের বিবাহের পাত্র বা পছন্দ অপছন্দ নিয়ে তাকে কেউ কিচ্ছু বলার দরকারই মনে করেনি। তবুও সে নিজে থেকে খোঁজখবর নিয়ে কড়া আপত্তি জানিয়েছে। কেউ তার কথা কানেই তুলেনি। মাহফুজ চায় তার বোনের বিয়েটা ভালো জায়গায় হোক, নিজেদের দুখের জীবনটা মেনে নিলেও বোনের সংসার যেন অভাবে না কাটুক। এটাই কারণ। এছাড়া মাহফুজ চায় না তার বোনের চোখের জল কাছাকাছি থেকে দেখুক। কাজেই গ্রামের পাশেই বিয়েটা ঠিক হচ্ছে বলেও আপত্তি জানিয়েছে সে। মাহফুজের এ বিয়েতে রাজি না থাকার আরো কয়েকটি কারণ আছে বটে। সে সবসময় চাইতো নিজের চাকরিবাকরি কিছু একটা হলে বোনের বিয়েতে ধুমধাম খরচ করবে। বোনের যাবতীয় খরচাপাতি, বরপক্ষের সবটুকু চাহিদা সে পূরণ করবে। তা আর হয়ে উঠছে না। যতদূর বুঝেছে, তাতে মনে হচ্ছে এই যাক্ একটা আপদ বিদায় হলো, এরকম অবস্থা। বিয়েটা হলেই যেন বাঁচা গেল। মাহফুজ একা কিছুই করতে পারছে না। নিজেকে তার কাপুরুষ বলে মনে হচ্ছে। তার বুকের মধ্যে তীব্র হাহাকার জমে বরফের মতো গলে পড়ছে। এ মুহূর্তে যদি একটা চাকরি হতো তবে জোর গলায় আওয়াজ করে বলতো, আমার বোনকে যারতার হাতে তুলে দিচ্ছি না। তার সুখের জন্য আলিশান প্রাসাদও খুঁজে দিতে প্রস্তুত। মাহফুজও হাসিউল্লাস করে বিয়েতে সাজতো। তা আর হয়ে উঠলো কই? না। কয়েকদিন ধরে মাহফুজ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। নিজেকে তার জঘন্য আর কাপুরুষ মনে হচ্ছে। আর কি দুয়েক বছর অপেক্ষা করা যেত না? বিয়েটা কি এখনই দিতে হবে?

মাহফুজের বোনের বয়সটাও তো বেশি হয়নি, অথচ এত তাড়াহুড়া কীসের? বোন কিছুটা রাগী মেজাজের। অকারণে কখনও কখনও রাগ অভিমান করে বসে। তবে এ কারণে কি সবাই আপদটাকে ঘর থেকে বিদায় করতে চাচ্ছে। মাহফুজের এমনটাই মনে হচ্ছে। তার কী একা বোনের জন্য কান্না পাচ্ছে? তার কী একা বুকের মধ্যে বিষাদ জমে আছে? মাহফুজ বারবার চোখের জল সামলিয়ে রাখার চেষ্টা করে এসেছে। তবুও চোখের জল বেয়ে বেয়ে পড়ছে। দিবারাত্রি অনুশোচনা আর অক্ষমতার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। এ থেকে পরিত্রাণ কী? তার বেকারত্বের জন্য যে এক পয়সার মূল্য ঘরেবাইরে নেই, তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। মাহফুজ কোনো উপায় না পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। অন্তত চোখের সামনে বোনের এমন অবহেলিত, অনাড়ম্বর বিয়ে দেখতে হবে না। বোনের চোখের দিকে অসহায়ত্ব নিয়ে তাকানোর চাইতে পলায়ন কী ভালো নয়? মাহফুজ এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত। ঠিক করেছে বাড়ি থেকে আজই পালিয়ে যাবে। কোথায় যাবে, কী খাবে তারও ঠিকঠিকানা নেই।

একটা চিঠি টেবিলে রেখে গভীর রাতে বেরিয়ে গেল মাহফুজ। পনেরো দিন পর মনে হলো কাজটা মোটেই ঠিক করেনি। নিজের অসহায়ত্ব আর বেকারত্বের কারণে বাড়ি থেকে পলায়ন করাটা উচিত হয়নি। বাড়ির পাহারাদার কুকুরের মতো সেখানে পড়ে থাকলেও সে পারতো। মাঝেমধ্যে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করলেও এরচেয়ে কিছুটা প্রশান্তি পেতো। মনে হতো কেউ তো শোনল একটা বেকার কুকুর বাড়িতে বসে ঘেউ ঘেউ করছে। অনাস্থা প্রকাশ করার শক্তি যেমন কুকুরের ভাষায় প্রকাশ পায়, সেও সেরকম পারতো। তিনবেলা হোক আর দুবেলা হোক যা-তা দিয়ে কুকুরের মতো অবহেলায় খেতে পারতো। সবচেয়ে সান্ত্বনার জায়গাটা এই হতো যে, বোনের মতামত নিয়ে তার খুশিমত অন্তত একটি রাস্তা বের করতে পারতো। মাহফুজ জানে না বাড়ি ফিরে বোনকে আর পাবে কিনা? তবুও মাহফুজ ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

ভোর নয়টার ট্রেন ধরে সে বাড়ি ফিরে আসে। মাহফুজ দেখতে পায়, কয়েকগুচ্ছ ফুলের পাঁপড়ি শুকিয়ে পড়ে আছে উঠোনে। বাড়িটা কি অদ্ভুত রকমের শোকার্ত। কুকুরটাও পুরাতন হাড্ডি শুঁকে শুঁকে ঘেউ ঘেউ করছে। মাহফুজ আদৌ জানে না তার কী করা উচিত। সে হয়তো কিছুক্ষণ পর কুকুরটার মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠবে। ঘেউ ঘেউ শব্দের তরজমা কেউ বুঝুক অথবা না বুঝুক।