আতিক রহমান
আমার মোটা মামা আর চিকন মামাকে কি তোমরা কেউ চেনো? এখানে তোমরা কেউ না চিনলেও মামাদের এলাকায় কিন্তু মামাদের এ নামে সবাই চিনে। বিশ্বাস না হলে, ঢাকার মাদারটেক এসে এলাকার লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করে দেখোই না। এতক্ষণে হয় তো আমার কথাই বিশ্বাস করে ফেলেছ। বিশ্বাস যদি করেই থাকো, তাহলে আমি আমার এ বহুগুণি মামাদের গল্প তোমাদের শুনাচ্ছি। শোন তাহলে। আগেকার কথা শোনাব। মোটা না চিকন, চিকন না মোটা মামার। আচ্ছা চিকন মামাকে নিয়েই শুরু করি। না বরং মোটা মামার কথাই আগে বলি। চিকন মামাটা রাগ না করলেই হয়!
মোটা মামাটা ইয়া মোটা, অর্থাৎ দু’হাত প্রসারিত করে যতটুকু দেখানো যায়, তারচেয়েও অনেক অনেক অনেক মোটা। কত অনেক তা বুঝাতে পারব না! আর লম্বা? চার ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি। ভালো করে মাপলে এরচে এক দেড় ইঞ্চি কম হবেন। এর বেশি তো নয়ই বরং কমও হতে পারেন। কারণ মাপার সময় মামা পায়ের পেছনের অংশ কিছুটা উঁচু করে লম্বা হয়ে দাঁড়ান। এমনিতেই মামা খাটো আবার মোটা তাই দেখতে আরো খাটো মনে হয়। এ নিয়ে মামার চিন্তার কোন শেষ নেই। কি করে লম্বা হওয়া যায়, মেদ কমিয়ে হালকা পাতলা হওয়া যায়। শেষে উপায় একটা খুঁজে পেলেন। আর উপায়ের কথা বলতে গেলেই কিনা মামার কথা এসে যায়। কারণ চিকন মামাই উপায়টা খুঁজে বের করেন। চিকন মামা এমনিতেই চিকন। আর লম্বা? লম্বায় তালগাছ! অর্থাৎ প্রায় সাতফুট। কিন্তু দেখতে এর চেয়েও বেশি লম্বা মনে হয়। টিংটিংয়ে বডি তো তাই! এই টিংটিংয়ে চিকন মামাই মোটা মামাকে নিয়ে গেলেন এক আধুনিক কবিরাজের কাছে। এখানে চিকন মামারও আসার প্রয়োজন ছিল। কারণ তিনি মোটা হতে চান, আর মোটা মামা চিকন এবং লম্বা হতে চান। অবশ্য চিকন মামা বলেছিলেন যে, খাট হবার কোন চিকিৎসা থাকলে তিনি খাটো হতেন! কিন্তু তা তো নেই। তাই শুধুই মোটা হতে চান। তো মোটা মামা আর চিকন মামা কবিরাজের দেয়া গাছ গাছালির ঔষধ খেতে লাগলেন। কবিরাজরা ভিজিট না নিলে কি হবে। এই আধুনিক কবিরাজ ঔষধ দিয়ে মনে হয় যেন চারগুণ দাম রাখেন। মোটা মামা বলেন, ঔষধের দাম রাখেন দ্বিগুণ। চিকন মামা মোটা মামার কথার সুর টেনে বলেন, ঔষুধের সাথে সুকৌশলে ভিজিটও রাখেন দ্বিগুণ! দ্বিগুণে-দ্বিগুণ যোগ করে দেখি আমার মনে হওয়া চারগুণই হয়। অর্থাৎ দুই মামার ধারণার সাথে আমার ধারণা এক হয়। তবুও কী আর করা? চারগুণ দাম দিয়েই ঔষধ খেতে হয়। নিয়মিতভাবে মামারা দীর্ঘদিন ঔষধ খেলেন। আরো কিছুদিন পর দেখা গেল চিকন মামা আরো চিকন হলেন, আর মোটা মামা আরো মোটা হলেন। কিন্তু লম্বা হলেন না মোটা মামা। দু’মামাই ক্ষেপে গেলেন কবিরাজের উপর। কবিরাজ শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন! তার দীর্ঘ চিকিৎসা জীবনে এ রকম উল্টো ফল কেউ পেয়েছেন বলে শুনেননি। দু’মামাই দু’মামার কথার সুর টেনে বললেন, জানেন আমরা মুক্তিযোদ্ধা। চিকন মামার পর মোটা মামা টেবিল থাপড়িয়ে বললেন, জানেন, আমি একাত্তরে নিজের জীবন বাজী রেখে শত্রুর ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কবিরাজও হাসিমুখে বললেন,আমি বুঝি রাজাকার ছিলাম? আরে মিয়া আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা, আপনে কি মনে করছেন? কবিরাজের কথা শুনে মোটা মামা কাষ্ঠহাসি হেসে ডান হাত এগিয়ে দিলেন কবিরাজের দিকে। বললেন, তা ভাই আগে বলবেন তো! দেখাদেখি চিকন মামাও মুচকি হাসলেন। আমি মামাদের সাথে ছিলাম। আসার সময় কবিরাজ মামাদের কাছে জানতে চাইলেন, তারা কে কোন বোতল থেকে ঔষধ খেয়েছেন? চিকন মামা বললেন, তা কি করে দেখাব, বোতল কি এখানে নিয়ে এসেছি নাকি! আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,আমি নিয়ে এসেছি। আমার কথা শুনেই দু’মামার চোখ যেন কপালে উঠল। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি জানতাম মামা বোতলের রহস্যেই আসল রহস্য, তাই তো আমি বুদ্ধি করে বোতল দু’টি লুকিয়ে এনেছি। কবিরাজ আমার কথায় তাল দিয়ে বললেন, ভালোই করেছ। তোমার ধারণাই ঠিক। মোটা মামা লাফিয়ে উঠলেন- মানে মানে?মানে একদম পানির মতো তরল। তার আগে বলুন কে কোন বোতল থেকে ঔষধ খেয়েছেন? কবিরাজের প্রশ্নে মোটা মামা, চিকন মামা ঝটপট যার যার হাতে বোতল তুলে দেখালেন। কবিরাজের অট্টহাসিতে আমার হাসিও যোগ হলো। দু’মামাই বোকার মতো একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। এবার কবিরাজ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কী? মানে এখনো বোঝেননি! মোটা মামা না বুঝেই মানে হ্যাঁ হ্যাঁ করছিলেন। আমি মোটা মামার হাতের বোতলটা ধরে বললাম, মামা এই বোতলের ঔষধ কি তোমাকে দেয়া হয়েছিল? আমার প্রশ্ন শুনে মামা একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন, বুঝেছি! কথাটা বলেই মামা একটু লজ্জিত হলেন যেন। চিকন মামা চিকন কন্ঠে বললেন, এ-ই জ-ন্য-ই-তো উল্টা ফল! মোটা মামা কবিরাজের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললেন,বোতলের গায়ে আমাদের নাম লিখে দিলে এ ভুল হত না, কবিরাজ বললেন, আমি তো আলাদা করেই দিয়েছিলাম, আপনারা লিখে নিলেই পারতেন। চিকন মামা কবিরাজকে বললেন, এখন আমাদের কি হবে? ভুলের মাশুল দিতে হবে। কারণ এখন আবার নতুন করে ঔষধ খেতে গেলে রি-এ্যাকশান হতে পারে। তাই কিছুদিন আপনাদের ঔষধ খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। কবিরাজের কথা শুনে মোটা মামা বললেন, ততদিনে ব্যায়াম-ট্যায়াম করে দেখি চিকন হওয়া যায় কি-না। কবিরাজ বললেন, আমার ঔষধ যে খায়, তার ব্যায়ামের প্রয়োজন হয় না। তবে আপনার যদি ইচ্ছে হয় করতে পারেন। মামা বাসায় এসে চিকন মামাকে বললেন, চলো চিকন আমরা কাল থেকে ব্যায়াম শুরু করি। সকাল বিকাল খোলা মাঠে দৌড়াই। চিকন মামা বললেন,তুমিই দৌড়িয়ে এসো গিয়ে। আমি তো আর মোটা হইনি। ভুল করে তোমার ঔষধ খেয়ে আজ আমি কী চিকনই না হয়ে গেছি। চেয়েছিলাম মোটা হতে আর হলাম কী! পরদিন সকালে মোটা মামা একাই মাঠে ব্যায়াম করতে গেলেন। তখন বেলা আটটা। শীতের সূর্যের আলো হাসছে পুব আকাশে। যেন মোটা মামার ব্যায়ামের ধরন দেখে হাসছে! মোটা মামা বুকডন দিতে গিয়ে বুকটা নিচে নামাতে গিয়ে আর উপরে উঠাতে পারেন না, সামনের দিকে ধপ্ করে পরে যান। একটু দৌড়িয়েই ফাঁপিয়ে ওঠেন। গভীর রাত্রে মামার শরীরে দশ নাম্বার বিপদ সংকেত! মানে হাত, পা, মাজা, ঘাড়, শরীরের জোড়ায় জোড়ায় দশ দিক থেকে ব্যথা শুরু হল। সারারাত আর নড়াচড়া করতে পারলেন না। সোজা হয়ে শুয়ে রইলেন। কঁকিয়ে কঁকিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন, তা কেউ বলতে পারব না। সকালে নাস্তার পর মামা একসাথে তিনটা প্যারাসিটামল খেয়ে বললেন, আর কখনো আটটার পর ব্যায়াম করতে যাবো না। এরপরও মোটা মামা ভোর সকালে উঠতে পারেননি। আর ব্যায়ামও করা হয়নি। দীর্ঘদিন সকালে ঘুমিয়ে অভ্যাস তো, তাই ---।অনেক দিন পর মোটা মামা ও চিকন মামা মিলে কবিরাজের কাছে গেলেন। কবিরাজ ঔষধ দিলেন। মোটা মামার ঔষধের বোতলের গায়ে লিখে দিলেন, ‘মোটা থেকে চিকন আর খাট থেকে লম্বা’ আর চিকন মামারটায় লিখে দিলেন, ‘চিকন থেকে মোটা’। দু’মামাই নিয়মিত ঔষধ খেতে থাকলেন। চিকন মামা ঔষধ খেয়ে তার যে কী ঘুম! রাত আটটায় শোন, সকালে আটটায় আবার ওঠেন। নাস্তা খান। ঔষধ খান তারপর আবার ঘুম। অথচ আগে চিকন মামা ঔষধ খেয়ে এর উল্টোটি ফল পেয়েছিলেন। অবশ্য ঔষধও উল্টোই খেয়েছিলেন। তাই তখন খাবারের রুচিও কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন চিকন মামা ঠিক মোটা মামার মতো, ভোজন বিলাসি হয়ে উঠেছেন। হয়েছেন, ঘুমকাতুরে। আর মোটা মামা? যে মোটা মামা কেবলই ঘুমের পোক ছিলেন। তার চোখে এখন ঘুম নেই। দিনের বেলা ছাদে উঠে তিনি রাস্তার রিক্সা গুনেন। আর রাত্রে প্রায়ই ঘুম হয় না বলে- আকাশে তারা গুনেন! মুখের রুচি হারিয়ে ফেলেছেন। আগের চিকন মামার মতো গুনে গুনে খাবার মুখে তোলেন। কী যে হয়ে গেল! চিকন মামা হয়ে গেলেন মোটা মামার মতো মোটা, আর মোটা মামা চিকন মামার মতো টিংটিংয়ে বক। খাওয়া দাওয়ায়, মোটা মামা হয়ে গেলেন চিকন মামা আর চিকন মামা হলে উঠলেন, মোটা মামা! কিন্তু মোটামামা চিকন হলে কি হবে, লম্বা হননি একটুও। চিকন হয়েছেন বলে দেখতেই একটু লম্বা মনে হয়। আমি কিন্তু পড়ে গেলাম মুস্কিলে! কারণ এখনওমোটা মামাকে ডাকলে, আগের মোটা মামাই এসে হাজির হন। আর চিকন মামাকে ডাকলে আগের চিকন মামাই উত্তর দেন। এর দু’দিন পর গিয়েছিলাম চিড়িয়াখানা। সঙ্গে দুইমামা। হঠাৎ কী এক প্রয়োজনে ডেকেছিলাম, মোটা মামা। সামনে এসে দাঁড়ালেন, আগের মোটা মামা অর্থাৎ আজকের চিকন মামা। লোকে দেখে অবাক! মানুষ বানরের নাচ আর দেখবে কি? মামাকে দেখতে লাগলেন। দু’জন যুবক তো আমার কথা নিয়ে কৌতুক করে বলেই ফেলল,বাঃ! মোটা মামার বডি কী! আরে দোস রবিউল বডি! কথাগুলো মামা শুনে অনেকটা ক্ষেপে গিয়ে বললেন,আরে আমার আগের বডি তো তোরা দেখিসনি তাই আমাকে তিরস্কার করলি। আমি মামার মনের অবস্থা বুঝে তাকে সান্তনা দেই, ওদের কথায় মনে কিছু নিও না মামা। মামা আমার কথার তীব্র প্রতিবাদ করল মনে কিছু নেব না মানে! আজ ওরা বলেছে, কাল আরেকজন বলবে। আমি আজই ফিরে গিয়ে আবার মোটা হবার ঔষধ খাবো। আমি মামাকে বুঝিয়ে বলি, মামা আসলে আমারই ভুল হয়েছিল। তোমাদের আগেই বলে রাখা উচিৎ ছিল যে, এখন থেকে মোটা মামা হল চিকনমামা, আর চিকন মামা হল মোটা মামা। আমার কথা শুনে মোটা মামা লাজুক হাসি হাসেন। সাথে চিকন মামাও। বুঝলাম, আমার কথা তারা মেনে নিয়েছেন। আর দেরি না করে মামাদের পরীক্ষা করব বলে মন স্থির করলাম। চিকন স্বরে ডাকলাম, চিকন মামা। আমার ডাক শুনে দু’মামাই দু’বার করে দু’জনের দিকে তাকালেন, উত্তর দিলেন না কেউ। আবার ডাকলাম। আগের চিকন মামা চিকন কন্ঠে বলে উঠলেন, কি ভাগ্নে। আগের মোটা মামা মোটা স্বরে বললেন, রাখ তো তোর এসব রিহার্সেল। পুরানো অভ্যাস কি এত সহজে ত্যাগ করা যায়! আমি উচ্চকন্ঠে হেসে বললাম, মামা আমি কিন্তু মনে মনে আগের চিকন মামাকেই ডেকেছিলাম। সত্যি পুরানো অভ্যাস কি এত সহজে ত্যাগ করা যায়!