নূরুন্নাহার নীরু
কই! আমিতো কিছুই দেখছি না! ঐতো ! ঐ যে! নিটোল নাজমাকে টেনে জানালার কিনারে নিয়ে আসে। মগরেবের নামাজটা আদায় করেই নাজমা- নিটোল জানালার গ্লাস খুলে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তেত্রিশ তলা থেকে দেখা বিশাল আকাশ। ঝকঝক করছে। তারই গায়ে দুলে ্ওঠা ‘শাওয়ালের চাঁদ’ হাসছে। এসব এপার্টমেন্টে খোলা বারান্দা নেই তাই জানালাই ভরসা। ওরা খুঁজছে ঈদের চাঁদ । নিটোল গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে “শাওয়ালের হেলাল হাসে ঐ/নিয়ে ঈদের খোশ কালাম,/ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক,/ঈদ মোবারক আসসালাম। কানাডায় আসার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ওদের নিভৃতে ঈদ উদযাপন। যেহেতু দ’ুজনেরই বাবা মা, ভাই বোন সব দেশে রেখে এসেছে ওরা । চাঁদ দেখে নিটোল আনন্দে উদ্বেলিত। সাথে সাথেই চাঁদ দেখার দোয়াটি পড়ে ফেললো দুজনে। বৌকে নিয়ে চাঁদের সাথে সেলফি তুলে ফেললো কয়েকটা। আজ ও বৌ এর পাশে থেকে সব কাজে সহযোগিতা করবে। ওদের আজকের বিশেষ পরিকল্পনা হচ্ছে দুই মায়ের হাতের বিশেষ বিশেষ খাবারগুলো তৈরী করা। নাজমার মনে পড়ে মায়ের বাড়ির বিশেষ খাবারটি হচ্ছে একটি ব্যতিক্রমী খাবার। এখন অবশ্য এটাকে অনেকেই ‘এরাবিয়ান ডিশ’ বলে জানে। আর এখনতো আরব দেশের সাথে বাঙ্গালির যোগাযোগ, যাতায়াত এমনকি অবস্থানও বেড়ে গিয়েছে প্রচুর যা মায়ের অর্থাৎ নানুর আমলে ভাবাই যায়নি। মায়ের জন্মের বছরই নাকি মায়ের দাদা হজ্জ করতে গিয়ে আরব দেশ থেকে সে খাবারটি খেয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মায়ের ভোজনবিলাসী দাদা খাবারটির নাম বলতে না পারলেও পুত্রবধূকে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে সে খাবার আদায় করে নিয়েছেন। নাজমার নানু ছিলেন খুব রাধুনী ঘরের মেয়ে। ফলে নিজেও নতুন নতুন রান্না উদ্ভাবনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মায়ের দাদা অর্থাৎ নাজমার বড় বাবা তার নানুকে সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন খাবারটিতে কি কি উপাদান ছিল। নানু তার সাধ্যমত তা তৈরী করে যখন শ্বশুর বাবাকে খাওয়ালেন তখন তিনি না কি ভীষণ খুশী হোন এবং নাম দেন ‘ইফতারির। যেহেতু রোজার পরের প্রথম খাবার এবং এটি খেয়েই তিনি ঈদের নামাজ পড়ে আসতেন। তাই এর নাম হলো ইফতারি। এরপর প্রথামত মায়ের সংসারেও এ প্রথাটিই চলে আসে যথারীতি। তবে মা এর সাথে আরো কিছু যোগ করে সত্যিই এক অসাধারণ ডিশ তৈরী করে ফেললেন। যেমন নাড়কেল কুচা, বিভিন্ন রকম বাদাম ইত্যাদি। আজ নাজমাও সে রীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেললো। নিজের অজান্তেই হাসছিল নাজমা। কারণ ওর হাত থেকে তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে নিটোল ঠিক বাবা যা করতো। আগেই ভিজিয়ে রাখা শুকনো খেজুর, বাদাম কুচো করে নিয়েছে। সাথে নাড়কেল কোরা, নানা রকম কিশমিশ, বাদাম, মনাক্কা, ঘি, চিনি মেখে রেখেছে। ওদিকে স্টিক সেমাই কড়া করে ভেজে গুড়া করে বৈয়ামে রেখে দিয়েছে। এবার পরিবেশনের সময় মিশিয়ে নিয়ে খাবে। “যেমনি ঘ্রাণ তেমনি স্বাদ” হাত চাটতে চাটতে বলছে নাজমা। আর এর মধ্যেই নিটোলের চাখাচাখি শুরু হয়ে গেছে। আসলে এরই মধ্যে রয়েছে ভিন্ন রকম এক তৃপ্তি। নাজমার মনে পড়ে মা সবার আগে বাবাকে পরিবেশন করে প্রশান্তির চোখে চেয়ে দেখতেন। ওরও আজ সেরকমই লাগছে। নিটোলই যেন ওর প্রথম মেহমান। এ দেশে মেহমানদারীর সুযোগ ঘটে সম্মিলিত আয়োজনের মাধ্যমে। যাকে বলে পটলাক পার্টি ! এই চাঁদ রাতে মা আর ঘুমাতেন না। সারা রাত জেগে যাবতীয় মিষ্টান্নগুলো পাকিয়ে ফেলতেন। সকালে উঠে টেবিল তৈরী দেখে যেমনি ছেলে মেয়েদের মন ভরে যেত তেমনি চলত খাবারের পাল্লা। বড় ভাইয়া অবশ্য ঝালটিই বেশী পছন্দ করতেন বলে মা হালিম আর কাবাবটাও এরই মধ্যে রেঁধে ফেলতেন। “প্রতিবারই মায়ের বিভিন্ন আইটেমের মধ্যে কোন না কোন ভিন্ন স্বাদের বিশেষ কিছু একটা থাকতোই যা প্রতি ঈদকেই আমাদের কাছে নতুন করে তুলতো। যেমন; লাউয়ের বরফী , মুলার মোরব্বা, গাজরের জর্দা কিংবা বিটের হালুয়া। শুধু তা ই নয় মা ঘর সাজাতে, টেবিল সাজাতেও একটু নতুনত্ব নিয়ে আসতেন। কিন্তু তা আহামরি কিছু না তবে অবশ্যই সাধ্যের মধ্যে। নাজমা তার রকিং ডিশে প্রতিটা আইটেম সাজাতে সাজাতে সে কথাই বলছিল নিটোলকে। এদেশে ঈদের জন্য বাড়তি কোন দিবস নেই, ছুটি নেই, সাজ সাজ রব নেই। কিন্তু তাই বলে কী! মুসলিমরা সবাই একত্রিত হয়ে স্থানীয় কোন একটি মসজিদে জমায়েত হয় এবং ঈদের নামাজ আদায় করে নেয়। থাকে মহিলাদের জন্যও পৃথক ব্যবস্থা। শিশুদের আনন্দদানের ব্যবস্থা। অতঃপর চলে প্রত্যেকের বহন করে আনা কোন না কোন খাবারের সম্মিলিত আহার। এটাই ওদের আনন্দ, এটাই ওদের ঈদ। একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার এটাই চমৎকার সুযোগ। নাজমা নিটোল দুজনেই সজ্জনপ্রিয় মানুষ। ইতোমধ্যেই ওরা সবার মধ্যমনি হয়ে উঠেছে প্রায়। পরিবার পরিজনহীন সুদূর বিভূঁইয়ে থাকা সবার হৃদয়েই একটা অতৃপ্তির বেদনা চিন চিন করে। ওরা বুঝতে পারে, অনুভব করে নিজেদের মত করে। এ অবস্থাকে খানিকটা হলেও কাটিয়ে উঠাতে ওরা এবার আরো একটা কৌশল খাটায়। ঈদুল ফেতরকে স্বাগতম জানিয়ে ওরা বড়দের জন্য কার্ড তৈরী করে ফেলে। শিশুদের জন্য গিফটবক্স। ছোট ছোট বাক্যে ছন্দ তুলে ওরা কিছু ফেস্টুনও তৈরী করে ফেলে। যা মসজিদের দেয়ালে টানিয়ে সাজাবে। মেডিকেলের ছাত্রী হলেও নাজমার আর্টের হাত চমৎকার। ওদিকে নিটোলতো কবিতা লিখতে ওস্তাদ। নাজমার মনে পড়ে যায় , এ রাতে মা শুধু রান্না নিয়েই থাকতেন না বরং রাত জেগে ইবাদাত করতেও নিস্পৃহ ছিলেন না। মা বলতেন,” এ রাতের ইবাদাত খুবই মর্তবাপূর্ণ। দোয়া কবুলের মোক্ষম সুযোগ। নাজমাও আজ সে কাজটিই করবে বলে মনস্থির করে নিল। নিটোলকেও সাথে নিয়ে কিছুক্ষণ কোরান পাঠে মনোনিবেশ করবে বলে দ্রুত হাত চালাতে থাকে। মূলত এ চাঁদ রাত থেকেই শুরু হয়ে যেত ওর মায়ের বাড়ির ঈদ। হল-হোস্টেলে থাকা পাঁচভাইবোন এ রাতেই এসে একত্রিত হতো। বিশেষ করে শেষ ইফতারীতে মায়ের প্রধান রেসিপি ছিল কাচ্চি বিরিয়ানী আর চিকেন ফ্রাই! যেহেতু ঈদের দিনে সাদা পোলাও, ডিমের কোর্মা, মুরগীর রোস্ট, গরুর ঝাল ছিল ওদের প্রিয় খাবার। সেহেতু স্বল্প সময়ের জন্য পাওয়া মা তার সন্তানদের জন্য সব ধরণের খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সে এক মহানন্দ পরিবেশ! দুপুরে নিজ বাড়িতে খেয়ে তারপর যে যেদিকে খুশী যাও- বেড়াও। পাঁচ ভাইবোনই নিজেদের বৃত্তির টাকা থেকে চাঁদা তুলে বাবা মায়ের জন্য গিফট কিনে ফেলত ছাত্র জীবন থেকেই। তাঁদের অগোচরেই কেনা হয়ে যেত বাবার জন্য সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য একটা শাড়ী। অবশ্য পরে মা শাড়ী কেনায় আপত্তি তুললে মাকে সংসারের টুকিটাকি কিনে দেয়া হত। এ ভাবেই হয়েছিল ওদের ওভেন, ব্লেন্ডার, টোস্টার, কফিমেকার, গ্রীল মেকার ইত্যাদি। আজ পাঁচজন পাঁচ জায়গায়। বাবা মার সাথে আছে শুধু ছোটন। একাকীত্ব ঘুচাতে ওকেও বিয়ে করিয়ে বৌ এনেছে মা। এক পড়ুয়া মেয়ে মায়ের ভীষণ পছন্দ। ছোটখাট মানুষ সবাই বলে দ্বিতীয় নাজমা। মা চান ও সারাক্ষণ সেজেগুজে মায়ের পাশে পাশে থাকুক। সহজে রান্নাঘরের কাজে হাত লাগাতে দেন না সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে বলে। মনে করেই নাজমা ফিক করে হেসে ওঠে। “কই আমাদেরতো এ সুযোগ দেয় নাই মা! বরং আমরা কর্মঠ থাকি এটাই যেন চাইতেন মা!” ওদিকে নিটোল শাশুড়ী মা’র পাঠানো ঈদ গিফটগুলো খুলে খুলে দেখতে গিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,” আরে! দেখ দেখ! আম্মু এবার ইয়ালো থেকে ড্রেস কিনেছে। আমার জন্য কাবলী সেট আর ম্যাচিং করে তোমার জন্য ওয়ান পিস লং ড্রেস। তার মানে আম্মু এবার আড়ং কে বয়কট করেছে।” “হ্যাঁ এমনটাই মা বলেছিল”Ñ নাজমাও সায় দিল নিটোলের কথায় । নামাজে দাঁড়ানোর আগে মায়ের সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হলো নাজমার। যদিও বাংলাদেশে ঈদ হবে আরো একদিন পর। এখন দিনের ভাগ চলছে সেখানে। Ñ“মা কি করছে? এবারও কি একদিন আগে থেকেই রান্নাখাওয়ার জোগাড় চলছে? না কি মা আমাদের অভাব অনুভব করছে? কষ্ট পাচ্ছে?” মা! ভিডিও কল দিয়ে একনাগাড়ে এ প্রশ্নগুলোই করে ফেললো নাজমা। ওপাশ থেকে মাÑ “কি করে এবার আনন্দের ঈদ করি মা! আমার সন্তানতো শুধু তোমরা পাঁচজনই না! আমি যে আরো ভাবি । ভাবি ফিলিস্তিনের ছেলে মেয়েদের কথাও। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ওদের খবর পড়তে গিয়ে নিজেকেই কেমন জানি অপরাধী মনে হয়, কষ্টে মুখ লুকাই! আমরা কী করতে পারছি ওদের জন্য?” “ব্যতিক্রমী মা আমার! এখানেও হেরে গেলাম তোমার কাছে। স্বগতুক্তি করে উঠলেও নাজমার খেয়াল হলো; নিটোলরা এদেশে প্রতিদিন একবার হলেও মানববন্ধন করে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে। শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন। কোন বাধা নেই, বুলেট-টিয়ারের ভয় নেই! অথচ এ দেশটাই ছিল জায়নবাদীদের একটি অন্যতম ভূমি।— “আর আমার মাতৃভূমি! মুসলিম প্রধান হয়েও কিছুই করতে পারছে না আজ নীরিহ মুসলিমদের জন্য”Ñ নাজমার স্বগোতোক্তি ভেসে আসে মায়ের কানে আর হঠাৎ চোখে পড়ে নাজমার পেছনে আসা ক’জন নারীর মুখ। হয়তো প্রতিবেশী! আজ চাঁদ রাত। গতবারের মত এবারও ওরা এসেছে নাজমার হাত দিয়ে মেহেদী পরতে। নাজমা ফিরে তাকায় মায়ের দৃষ্টি ধরে। দরজা খোলা দেখে বুঝতে পারে নিটোল ততক্ষণে বের হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনীদের জন্য ওদের পূর্ব পরিকল্পিত আরো একটি প্রোগ্রাম আছে আজ। বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে ওর অজান্তেই যেন বেরিয়ে এলো বিবর্ণ ক’টি শব্দ। “এবার আমরা না-ই সাজলাম মেহেদী রঙে। যেখানে ফিলিস্তিনের বোনেরা প্রতিনিয়ত রক্তের রঙে সাজছে!” ওপার থেকে মায়ের গর্বিত নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে পলকে। ভাবলেন, “ মেয়ে! এবার তুমিই আমাকে হার মানালে! ঐ বিবর্ণ শব্দেই বয়ে যাক আমাদের এবারের চাঁদরাত।