কবির কাঞ্চন

চোখেমুখে জগতের হতাশা নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন রমজান আলী। ইদানীং কারণে-অকারণে মন খারাপ করে থাকেন। দিনদিন নিজের ভরাডুবির জন্য নিজেই নিজেকে দোষেন। পরিবারের সদস্যদের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্যের মঙ্গল করে আজ তারই মাশূল গুণতে হচ্ছে তাকে। হয়তো এরই ধারাবাহিকতায় পুড়ে মরতে হতে পারে তার প্রজন্মকেও। সেই ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। গতরাতেও একবিন্দু ঘুম হয়নি তার। কী করবেন, কার কাছে যাবেন। ভেবে কূল পাচ্ছেন না।

মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে হারানো দিনের সুখকর স্মৃতিগুলো। একসময় জায়গাজমি, বাড়ি গাড়ি সবই ছিল। বাপদাদার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তির মালিক ছিলেন। কিন্তু পাশের গ্রামের মীরেট ভাট্টী তার স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে যখন পথে নামছিলেন ঠিক তখনই তাদের আশ্রয় দিয়ে ছোটোখাটো থাকবার জন্য একটা ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। সাথে চাষাবাদের জন্য কিছু জমিও দিয়েছিলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই ভাট্টী সেই জায়গায় আরেকটি দোচালা ঘর বানিয়ে নিল। রমজান আলী তখনও কিছু বললেন না। ভাবলেন অসহায় মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে হয়তো।

কয়েক বছর পর একদিন মীরেন ভাট্টী তার কাছে এসে চাষের জমিগুলো অর্থমূল্যে কিনে নেয়ার প্রস্তাব করে। রমজান আলীর সহধর্মিণী চোখ কপালে তুলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাত্র বছর কয়েক আগে এখানে আমাদের কাছে এসে কোনমতে মাথাগোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। আর এখন আমাদেরই জমি কিনতে চাইছে। তাছাড়া কথা বলার ধরনও একজন ভালো মানুষের মতো নয়। না জানি মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে।

রমজান আলী খকখক কেশে বললেন,

- তো আপনাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

- ভালোই। আপনাদের দয়ায় জমিতে ভালো ফসল হচ্ছে। আমরা চাইছি নিজের পায়ে দাঁড়াতে। আপনি কী বলেন?

রমজান আলী হাসিমুখে বললেন,

- এ তো খুবই ভালো কথা। যারা নিজেদের ভালো চান তাদের সাথে স্বয়ং আল্লাহ থাকেন।

- তাই বলছি, এই টাকাগুলো রাখুন। আশপাশের জায়গার দামের মতো করে দিয়েছি। আপনি সুযোগ করে আমাদের রেজিষ্ট্রি করে দেবেন।

এই কথা বলে মীরেট ভাট্টী বের হতে ওঠে দাঁড়ালেন।

রমজান আলী ব্যস্ত গলায় বললেন,

- একি কথা! উঠে গেলেন যে? বসুন, আপনার ভাবি নাস্তা দিচ্ছে।

- না, থাক আরেকদিন এসে খাব। আজ একটু তাড়া আছে।

মীরেট ভাট্টী চলে যারার পর সুরাইয়া বেগম দৌড়ে এসে স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেন,

- তুমি এ কি শুরু করেছো!

- আমি আবার কী করলাম?

- কী করোনি বল! তোমার দিকে এতো করে তাকিয়ে নিষেধ করলাম। টাকা নিও না। তুমি নিয়ে নিলে। একবারও এর পরিণাম কী হতে পারে তা ভেবে দেখোনি। দেখলে কখনো এই টাকায় হাত রাখতে না। বরং ওদের জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বলতে। ওরা কালসাপ হয়ে আমাদের কাছে এসেছে। দেখবে একদিন ওরা ছোবল মেরে আমাদের নিশ্চিহ্ন করেই ছাড়বে।

- এমন করে বলো না, সুরাইয়া। মানুষকে বিশ্বাস করতে শেখো। মানুষ মানুষের জন্য। কারো বিপদ দেখে দূরে ঠেলে দেয়া তো কোন মানুষের পরিচয় হতে পারে না।

- তাই বলে নিজের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অন্যের জয়যাত্রাকে সমর্থন করতে হবে!

- নিজের পরাজয় মানে!

- এর মানে একদম সহজ। একদিন ওদের মাথাগোঁজার স্থান ছিল না। তুমি দয়া করে থাকতে দিলে। আপত্তি করিনি। আবার চাষাবাদের জন্য জমিও দিলে। তখনও কিছু বলিনি। শুনেছি তোমার অনুমতি না নিয়ে ওরা নতুন করে দোচালা ঘরও বানিয়েছে। আজ এসেছে তোমার জমি কিনতে। আমার কাছে বিষয়টা একদমই সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না।

- সুরাইয়া, তুমি শুধু শুধু ওদের ভুল বুঝছো। ওরা আসলে অমন না। বেচারা বিপদে পড়ে আমাদের কাছে এসেছিল। আমাদের একটু সহায়তা পেয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ নিয়ে আর বিরোধিতা করো না।

সুরাইয়া বেগম মন খারাপ করে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

- ঠিক আছে। তুমি যা ভালো মনে কর তা-ই করো।

কিছুদিন পর রমজান আলী মীরেট ভাট্টীকে জমি রেজিষ্ট্রি করে দিলেন। রেজিষ্ট্রির কাজ শেষ হবার পরদিনই মীরেট ভাট্টী তার কেনা পুরো জায়গার চারদিকে উঁচু করে সীমানা প্রাচীর তৈরি করলো। রমজান আলী তার এমন আচরণে বিস্মিত হন। কিন্তু মুখ খুলে মীরেট ভাট্টীকে কিছুই বলেননি। রমজান আলীর ছেলেমেয়েরা আগে যেখানে গিয়ে খেলাধূলা করতো সেই জায়গাটিও মীরেট ভাট্টীর উঁচু দেয়ালের মাঝে বন্দী। এ নিয়ে রোজ স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কাছে কথা শুনতে হয় তাকে। ইদানীং যে যাই বলে রমজান আলী কিছুই বলেন না। শুধু অসহায়ের মতো করে তাকিয়ে থাকেন। আর স্ত্রীর সেই দিনের পরামর্শগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার।

আরো কিছুদিন পর রমজান আলী ঘর থেকে বের হয়ে সামনের অবশিষ্ট জমিটুকুর দিকে এগুতে লাগলেন। তার জমিটুকু পেরোলেই মীরেট ভাট্টীর সীমানা প্রাচীর। হঠাৎ লক্ষ্য করেন সীমানা প্রাচীরের তলদেশ থেকে কয়েকটি পাইপ সরাসরি তার জমির দিকে মুখ করে আছে। অমনি দ্রুত পদে সেদিকে ছুটে গেলেন তিনি। গিয়েই পকেট থেকে রুমালটা বের করে নাক চেপে ধরলেন। কী বিশ্রী গন্ধ! নিশ্চিত এখানে টয়লেটের ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। তিনি উঁচু গলায় বলতে লাগলেন,

- মীরেট ভাই, ও মীরেট ভাই। আপনি কী বাড়ি আছেন?

ঘর থেকে বের হয়ে মীরেট ভাট্টী প্রাচীরের ওপার থেকে বললেন,

- কী হয়েছে, রমজান ভাই। এতো উচ্চবাচ্য করছেন কেন?

- আপনার টয়লেটের ময়লা আমার এদিকে আসছে কেন?

- এমনভাবে বলছেন যেন আমি ইচ্ছে করেই আপনার দিকে ময়লা ফেলেছি। হয়তো কোন সমস্যার কারণে যেতে পারে। তাই বলে এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করতে হবে?

- আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?

- আর কীভাবে বলব! আমার জায়গায় আমি আছি। আপনার জায়গায় আপনি। কারো কথা শোনার মানুষ আমি নই।

রমজান আলী চোখ বন্ধ করে দু’চোখের জল ছেড়ে নিশ্চুপ থাকেন। মীরেট ভাট্টী আবার বলল,

- শুনুন, এতো কথা বলে কোন লাভ নেই। আপনার ছেলেমেয়েদের অত্যাচারে আমরা ভালোমতো বাঁচতে পর্যন্ত পারছি না। তাই বলে কী আপনাকে কখনও বিরক্ত করেছি?

- ওরা আবার কী করলো?

- কী করেনি তা বলুন? এই তো গতকালও ওরা আমার দেয়ালের পাশের জমিতে খেলেছে। ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে আমরা খুবই অতিষ্ঠ হয়ে গেছি।

- ওরা কী আপনাদের ওখানে কখনও ঢুকেছে?

- না, তবে নিজের জায়গায় থেকেও অন্যের অস্বস্তির কারণ হওয়া নিশ্চয়ই ঠিক না। আপনি কী বলেন?

রমজান আলী আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

- ঠিক আছে, মীরেট ভাই। ওরা আর এখানে খেলতে আসবে না। আপনাদের অস্বস্তির কারণ হবে না। আপনারা ভালো থাকুন।

এই কথা বলে বড় বড় পায়ে ঘরের দিকে চলে আসেন তিনি।

একদিন রমজান আলী বাজারের একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে আছেন। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন নীরেট ভাট্টী। মীরেট ভাট্টীর আপন ছোটভাই। রমজান আলী ভালো করেই জানেন এই নীরেটই তার বড়ভাই, ভাবি, বাচ্চাদের পথে নামিয়ে দিয়েছিলেন। খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক নীরেট। নিজের স্বার্থের জন্য সে সবই করতে পারে।

তারপর রমজান আলীর পাশে বসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,

- কী অবস্থা, রমজান ভাই? চা খেয়েছেন?

- না, এখনও খাইনি।

এরপর নীরেট ভাট্টী দোকানিকে উদ্দেশ করে বললেন,

- মানিক ভাই, আমাদের ভালো করে গরম জলে কাপ ধুয়ে দুইকাপ চা দাও। ভালো থেকে বিস্কুটও দাও।

- জ্বি, দিচ্ছি।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নীরেট ভাট্টী আবার বললেন,

- তো রমজান ভাই আপনার কাছেই এসেছি। কিছু জরুরি কথা ছিল।

- কী কথা? বলুন।

- আপনি তো আমার ভাইয়ের পরিবারটাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছেন। আপনার কারণেই ওরা আজ ভালো আছে। গত কয়েকদিন আগে ভাইয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে। ভাইয়া বলেছেন আপনি নাকি টাকা পয়সা নিয়ে একটু সমস্যার মধ্যে আছেন। আমিও কিছুদিন যাবৎ ভাবছি একটা মাছের প্রজেক্ট করব। সুবিধামতো জায়গা পাচ্ছি না। সেদিন ভাইয়ার সাথে ঘুরে ঘুরে ভাইয়ার ও আপনার জায়গাগুলো দেখেছি। ভাইয়ার সীমানা প্রাচীরের সাথে লাগানো আপনার জমিটা আমার প্রজেক্টের জন্য খুবই ভালো হবে। আমি তা কিনতে চাই। আপনি কী বলেন?

রমজান আলী বেশ কয়েকবার নীরেট ভাট্টীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখবন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন।

নীরেট ভাট্টী বলে ওঠলেন,

- আবার কী ভাবছেন? আমি তো আমার কথা বলেছি। আপনি ভেবে দেখতে পারেন। ওই জায়গাটা তো এমনিতেই পড়ে আছে। আমাকে দিলে তা কাজে লাগবে। টাকাও পাবেন। তাছাড়া ভাইয়ার দেয়া সীমানা প্রাচীরের কারণে আপনার ওই জমিটি এমনিতেই অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

- ভাই, আমি তোমাকে তা পরে জানাব।

এই কথা বলে রমজান আলী সোজা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন।

নীরেট ভাট্টী পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে নিলেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে এক টান দিয়ে আবার ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে রমজান আলীর চলে যাবার পথের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে রইলেন।

স্বামীকে অবিরাম ঘামতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে আসেন সুরাইয়া বেগম। এরপর ফ্যান চালিয়ে দিয়ে কাছে এসে বললেন,

- তোমার আবার কী হয়েছে? এভাবে ঘামছো কেন?

রমজান আলী একটু সময় নিয়ে বললেন,

- সেদিন তোমার কথাই ঠিক ছিল। আমি বুঝিনি। আজকাল কেউই কারোর বিপদে এগিয়ে আসে না কেন আমি এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ওরা আসলেই অকৃতজ্ঞ।

- তুমি কাদের কথা বলছো?

- ভাট্টীদের কথা।

- ওরা আবার কী করলো?

- মীরেট ভাট্টীর অসহায় মুহূর্তে আমি এগিয়ে গেলাম। আর সে কৌশলে আমার চাষের জমি নিয়ে নিয়েছে। রেজিষ্ট্রির পর একটা দিনও দেরি করলো না। চারিদিকে সীমানা প্রাচীর তৈরি করে ফেললো। মুনিয়া-সুজনরা খেলতে পারছে না। রোজ ওদের বিষণ্ন মুখগুলো আমাকে ভেতরে ভেতরে পুড়ে খাচ্ছিল। তোমার পরামর্শ শুনেও নিজের নীতির সঙ্গে আপস করিনি। কিন্তু আজ আমার মনটা একদম ভেঙে গেছে।

- কী হয়েছে? মীরেট ভাট্টী কী তোমাকে কিছু বলেছেন?

- না, সে কিছু বলেনি। তবে তার যে ভাই তাকে সর্বস্বান্ত করেছিল সে আজ আমার অবশিষ্ট জমিটুকুও কেনার প্রস্তাব দিল। শুনে অবাক হলাম মীরেট ভাট্টীই নাকি তাকে এই পরামর্শ দিয়েছে।

- কী বল! মানুষ এতোটা নীচ হতে পারে!

- শুধু তাই নয়। নীরেট ভাট্টী আজ আমাকে বলল আমি নাকি আর্থিক কষ্টে আছি। এ কথা সে মীরেট ভাট্টীর কাছ থেকে জেনেছে। তাই সে দয়া করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই কথা বলে রমজান আলী অঝরে কাঁদতে লাগলেন। স্বামীকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে সুরাইয়া বেগমের অন্তর যেন ফেটে খানখান হয়ে যায়। সুরাইয়া বেগম জানেন তার স্বামীর এ কান্নার গভীরতা কতোটুকু! প্রায় দুই যুগ ধরে এই লোকটার সাথে তার পথচলা। আজ তৃতীয়বারের মতো তার চোখের পানি পড়তে দেখেছে সে। এর আগে একবার বাবাকে আরেকবার মাকে হারানোর পর এমন কান্না করেছে সে।

এরপর পাশে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে স্বামীর চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন,

- তুমি ভেঙে পড়ো না। নিজেকে শক্ত রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইনশাল্লাহ। তবে আজ থেকে একটা প্রতিজ্ঞা করো। প্রয়োজনে কষ্ট করে চলবে, তবু সম্পত্তি বিক্রি করবে না। আর গায়ে পড়ে কারো উপকার করতে যাবে না।

- ওটা তোমার অভিমান। মানুষ হয়ে মানুষের বিপদে এগিয়ে না আসলে আমরা কীসের মানুষ?

- আবারও!

এই কথা বলে সুরাইয়া বেগম স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এরিমধ্যে নীরেট ভাট্টী খকখক কেশে দরজায় কড়া নাড়লেন। দরজা খুলে হাসিমুখে অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন রমজান আলী। এরপর মুখোমুখি বসে বললেন,

- তো কী খবর আপনাদের?

- আমরা ভালো আছি। আপনাকে দোকানে বসে যে কথাটি বলেছি সেটি অন্যভাবে নেবেন না, প্লিজ। আসলে গত কয়েকদিন আগে আমি ভাইয়ার বাসায় গিয়ে আপনাদের জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে আপনার জায়গার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। তাছাড়া মীরেট ভাট্টী আমার ভাই হলে কী হবে মানুষটা একদমই সুবিধার নয়। ওর মতো কৃতঘ্ন স্বভাবের লোক এ জগতে পাওয়া ভার। আপনি ওকে দয়া করে মাথাগোঁজার ঠাঁই দিয়েছেন। আর সেই কিনা আগের সবকিছু ভুলে গেছে। জমি রেজিষ্ট্রির পরপরই সীমানা প্রাচীর তৈরি করেছে।

শুধু তাই নয় আপনার দিকে ওর ময়লা আবর্জনার পাইপগুলোর মুখ করে দিয়েছে। ক’দিন পরে এমনিতেই এখানে আপনাদের টিকে থাকাটাও অসম্ভব হয়ে যাবে। ভাবলাম, একবার যদি ওটা আমি নিয়ে নিতে পারি তবে মীরেট ভাট্টীকে সমুচিত জবাব দিতে পারব। এখন আপনিই বলুন কী করবেন?

রমজান আলী আনমনা হয়ে ভাবতে লাগলেন,

- এ আবার কোন ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছি। অন্যের উপকার করতে গিয়ে নিজের বাপদাদার সম্পত্তি হারাতে বসেছি। বসতবাড়ি ছাড়া ওই সামান্য জমিই তো আছে। ওটাও বেচে দিলে কেমনে বাঁচব!

নীরেট ভাট্টী আবার বললেন,

- কী ভাবছেন, রমজান ভাই?

- না, মানে, ভাবছি ওই সামান্যটুকু জমিই তো আমাদের অবশিষ্ট আছে। ওইটুকু কেমন করে বিক্রি করি! তাছাড়া মীরেট ভাট্টী সীমানা প্রাচীর তৈরি করার পর আমার ছেলেমেয়েরা এখন কোথাও খেলার জায়গা পায় না।

ওরা ওখানেই বিকালবেলার সময়টা পার করে। তাতেও মীরেট ভাট্টী অভিযোগ করেছে ওদের আওয়াজে নাকি তাদের সমস্যা হচ্ছে। আমি বলেছি ওরা আর ওখানে খেলবে না।

নীরেট ভাট্টী সুযোগ বুঝে বলল,

- আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি মাছের প্রজেক্ট করার সময় আপনার ছেলেমেয়েদের জন্য সুন্দর করে এককোণে খেলার মাঠ করে দেব। তবু আপনি না করবেন না, প্লিজ।

এই কথা বলে নীরেট ভাট্টী রমজান আলীর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন,

- আপনি এই টাকাগুলো রেখে দিন। জমির এডভান্স হিসেবে দিলাম।

ততক্ষণে সুরাইয়া বেগম নাস্তা নিয়ে হাজির। রমজান আলী নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আস্তে করে বললেন,

- নীরেট ভাই, নাস্তা খান।

- জ্বি আচ্ছা।

নাস্তা খাওয়া শেষ হলে রমজান আলী নীরেট ভাট্টীর হাতে টাকাগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বললেন,

- এই নিন, আপনার টাকা। আর একটা কথা শুনে রাখুন। ভাই, আমি কখনও আমার জমি বিক্রি করব না। আপনি অন্যত্র খুঁজুন।

- আপনি বড় ভুল করলেন, ভাই। এই জায়গা আপনি এমনিতেই ধরে রাখতে পারবেন না।

- সেটা আমার ব্যাপার।

- ঠিক আছে। দেখা হবে।

এই বলে নীরেট ভাট্টী ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সুরাইয়া বেগম পাশে বসে মুগ্ধ চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর রমজান আলী পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালসহ মুখমণ্ডলের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন,

- আর কোন ছাড় নয়। এবার থেকে খুব বুঝেশুনে পা বাড়াব। সত্যি জীবনে সহজসরল থাকা ভালো। কিন্তু একেবারে সহজসরল থাকা ভালো নয়। এতে নিজের বেঁচে থাকা নিয়ে টানাটানিতে পড়তে হয়। জীবনে চলার পথে যেমন বাধা আসে তেমন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে অথৈজলে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

স্বামীর মুখের কথাগুলো গিয়ে সরাসরি লেগেছে সুরাইয়া বেগমের অন্তরে। এতোদিন ধরে এমনই এক স্বামীকে খুঁজছিলেন তিনি। আজ তার স্বামীর ভেতরে যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষকে দেখতে পেলেন তিনি।

উদারতা দেখাতে দেখাতে একটা মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তার। রমজান আলীরও হয়তো তাই হয়েছে। সুরাইয়া বেগম কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই মীরেট ভাট্টীর পাইপগুলোর অবস্থা দেখতে দ্রুত ঘর ছাড়লেন তিনি।