জোবায়ের রাজু

আনোয়ারা বেগম বড্ড চিন্তিত। মাত্র দুই মাস আগে একমাত্র মেয়ে জুলিকে যে ঘরে বিয়ে দিয়েছেন, সবাই বলেছে ওটা রক্ষণশীল পরিবার। জাত বংশ ভালো। পাত্রপক্ষের সবকিছু যাচাই-বাছাই করে অবশেষে বেশ ধুমধামে মেয়েকে ফিরোজের হাতে সঁপে দিয়েছেন। কথা ছিল তারা জুলিকে রাজকন্যার মতো রাখবেন। পাত্রপক্ষের এমন ওয়াদা শুনে আনোয়ারা বেগমের বুক গর্বে ভরে গেল। এতটাই গর্বে বুক ভরে গেল যে তিনি নিকট আত্মীয়দের কাছে এই নিয়ে জোর গলায় দাম্ভিক বাক্য শোনালেন- আমার মেয়েকে কেবল সু-পাত্রে নয়, উঁচু ঘরেও বিয়ে দিয়েছি।

কিন্তু বিয়ের দুই মাস যেতে না যেতেই সবকিছু কেমন যেন অবান্তর প্রমাণ হতে শুরু করল। যে রাজকন্যার ওয়াদা নিয়ে তারা জুলিকে ঘরের বউ করে নিল, সেসব ওয়াদা যেন কৌশল মাত্র। তবে নম্র ভদ্র স্বামী হিসেবে ফিরোজকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। জুলির ব্যাপারে যথেষ্ট মানবিক হলেও জুলির শাশুড়ি আর একমাত্র ননদ সাদিয়া ভীষণ ডাইনী স্বভাবের। জুলির দোষ ধরতে ওরা যথেষ্ট পটু। জুলির সাংসারিক কোনো কাজই তাদের মনের মত হয় না। রান্নাবান্নায় নাকি জুলি আনাড়ি। শাশুড়ির অনেকগুলো অভিযোগের মধ্যে একটি অভিযোগ হচ্ছে- জুলি মোবাইলে আসক্ত। ফলে তার কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সংসার করতে আসা হঠাৎ এই দুঃখের সাগরে পড়া জুলি ননদ আর শাশুড়ির চোখকে ফাঁকি দিয়ে মায়ের সাথে এসব বেদনার গল্প ব্যক্ত করে। মেয়ের মুখে এসব নিরস গল্প শুনে আনোয়ারা বেগমের বুকটা ফেটে যায়। অথচ সারা জীবন তিনি মেয়েকে আদরে সোহাগে বড় করেছেন। বলা যায়, সংসারের কোনো কাজে মেয়েকে হাত দিতে দেননি। জুলিরও সেসবে মনোযোগ ছিল না। নরম সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে মোবাইলে বেশীরভাগ সময় নিজেকে বিজড়িত রেখেছে আর একমাত্র ভাবী রেশমাকে কারণে অকারণে এটা সেটার ফরমায়েশ দিয়ে গেছে। আনোয়ারা বেগমও একমাত্র পুত্র রকির স্ত্রী রেশমাকে এখন পর্যন্ত এক ধরনের নির্যাতনের মধ্যে টিকিয়ে রেখেছেন।

সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে রেশমা। কোনো এক আশ্বিনে রকির সাথে বিয়ে হয় জীবনপুর মেমোরিয়াল হাইস্কুলের হেডমাস্টার আকবর আলীর মেজ মেয়ে রেশমার। আকবর আলী শিক্ষিত ছেলের হাতে কন্যাকে তুলে দিলেও রেশমা একজন বদমেজাজি শাশুড়ি আর অত্যাচারী ননদ পেয়েছে। বিয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায় রেশমা বুঝে গেল এটা সংসার নামে একধরনের নরক। এই নরকে তাকে সারা জীবন দিনাতিপাত করতে হবে। আনোয়ারা বেগম চান না রকি রেশমার সাথে একান্ত সময় কাটাক। বিয়ের এক সপ্তাহ পর রকি যখন শখ করে বউয়ের জন্য রূপার নূপুর কিনে এল, তখনই অশান্তির প্রথম সংকেত পায় রেশমা। পুত্রের এমন কাণ্ডে আনোয়ারা বেগম যে মনোক্ষুণ্ন, সেটা চতুর রেশমা টের পেল।

জুলিও আড়াল থেকে বলল, ‘বিয়ে করতে না করতে বউকে রূপার নূপুর দেয়। কবে না জানি ডায়মন্ডের হার দিয়ে বসে।’ রেশমা জুলির কথায় আকাশ থেকে পড়ল। অথচ বিয়ের রাতে রকি তাকে বলেছে, দেখবে আমার বোন তোমাকে বান্ধবী বানিয়ে ফেলবে।

জুলির বিয়ের পর ওর শ্বশুরালয়ে এমন অশান্তির গল্প শুনে আনোয়ারা বেগমের মানসিক অবস্থা বেগতিক হয়ে ওঠে। তবে এসবের মাথাব্যথা নেই রেশমার। সে বুঝতে পেরেছে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না। শাশুড়ি আর ননদ যেভাবে তাকে শায়েস্তার ওপর রেখেছে দিনের পর দিন, আজ প্রকৃতি তাদেরকে সব ফিরিয়ে দিচ্ছে হাতেনাতে।

তবে আনোয়ারা বেগমও বুঝতে পারেন তিনি কর্মফল ভোগ করছেন। তাই রেশমার সামনে প্রকাশ্যে এসব মুখ ফুটে না বললেও আনোয়ারা বেগম যে তার বোনদের কাছে ফোন করে এসব দুঃখ প্রকাশ করে চুপি চুপি নরম সুরে কাঁদেন, রেশমা আড়াল থেকে সব শুনে আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে ততদিনে বুঝে গেছে কিছু কিছু প্রতিশোধ আসলে গায়ের জোর দিয়ে নিতে হয় না, সময় এবং পরিস্থিতি সেসবের প্রতিশোধ নিয়ে নেয়।

জুলি ফোন করে আনোয়ারা বেগমকে জানায়, ‘ফিরোজ আমাকে নিয়ে মালয়েশিয়া যেতে চাচ্ছে। কিন্তু ওর মা চাচ্ছে না।’ আনোয়ারা বেগম যখন এই ঘটনা তার বোনকে ফোন করে জানায়, রেশমা দূর থেকে শুনে তার অতীত ভাবতে থাকে। বিয়ের পর রকিও চেয়েছে তাকে নিয়ে কক্সবাজার যেতে। কিন্তু শাশুড়ি বাধা দিলেন। এ নিয়ে সংসারে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল একদফা। মায়ের গোয়ার্তুমির কারণে রকি একসময় স্ত্রীকে নিয়ে সাগর দেখার পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়।

আজ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে দেখে রেশমা ভাবে, জীবন প্রতিধ্বনির শব্দের অর্থ। যে যখন যার সঙ্গে যা যা করে, সব কিছু প্রতিধ্বনির শব্দের মতো তার কাছে আবার ফেরত আসে।