শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম
কোনো এক বিষণ্ন বিকেলে বৃষ্টি পড়ছিল নিঃশব্দে। জানালার কাঁচ ভিজে যাচ্ছিল। সেই জানালার পাশে বসে ছিল বছর পঁয়ত্রিশের এক মানুষÑ নাম তার ইশতিয়াক। হাতে ধরা এক কাপ চা, কিন্তু চুমুক দিচ্ছে না। তাকিয়ে আছে বাইরের দিগন্তে, যেখানে আকাশ আর পৃথিবী মিলেমিশে এক হয়েছে।
একসময় যে ইশতিয়াক ছিল সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু বন্ধুদের ভরসার জায়গা, পরিবারের গর্ব, আর প্রেমিকার স্বপ্নের পুরুষ, আজ সে যেন কেবল একটি ছায়া, নিজের জীবনের ফ্যাকাশে রঙে হারিয়ে যাওয়া এক শিল্পকর্ম।
ইশতিয়াক একসময় খুব ভালো আঁকতে পারত। স্কুল-কলেজে ছবি এঁকে পুরস্কার জিতে ফেলত। চাইলেই চারুকলায় ভর্তি হতে পারত, কিন্তু বাবা চেয়েছিলেন সে ইঞ্জিনিয়ার হোক। সংসারের আর্থিক টানাপোড়েন, ছোট ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নটা গিলে ফেলেছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিল, চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রংগুলো একে একে মুছে যাচ্ছিল।
এরপর জীবনে এলো নীলা। অফিসের কলিগ, হাসিতে যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে পারত। নীলা বলত, “তোমার চোখে একটা কষ্ট আছে, যেটা তুমি আড়াল করতে চাও, কিন্তু পারো না। আমি চাই, তোমার চোখে আবার রঙ ফিরুক।” সেই সময়টা আবার রঙ ফিরে পাওয়ার সময় ছিল। আবার সে আঁকতে শুরু করেছিল নীলার মুখ, তার হাসি, তাদের স্বপ্ন।
কিন্তু জীবন তো সরল রেখায় চলে না। নীলার বাবা ছিল প্রভাবশালী, আর ইশতিয়াক শুধু এক সরকারি প্রকৌশলী। সামাজিক ব্যবধান আর শ্রেণিবিভাজনের কাছে প্রেম পরাজিত হলো। নীলা চলে গেল বিদেশে বাবার পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করে।
ইশতিয়াকের জীবন আবার মুছে গেল ছাইয়ের মতো ধূসর রঙে। কিন্তু সে এবার একেবারে ভেঙে পড়ল না। শুধু নিজেকে আরও নিঃসঙ্গ করে নিল। বিয়ে করল না। অফিস আর একাকিত্বের মধ্যে গেঁথে নিলো নিজেকে। রঙহীন জীবন আঁকছিল সে, নীরবে, প্রতিদিন।
তবে জীবন যে কেবল কাঁদায় তা নয়, জীবন মাঝে মাঝে সান্ত্বনাও দেয়। একদিন হঠাৎ তার অফিসে এল এক নতুন ইন্টার্ন-নাম মেহেরিন। সাহসী, প্রাণবন্ত, আর আশ্চর্য রকমভাবে ইশতিয়াকের ছবি আঁকার গল্প শুনে অভিভূত। সে বলল, “আপনি যে হারিয়ে ফেলেছেন মনে করেন, তা তো এখনো আপনার ভেতরে বেঁচে আছে। আপনি শুধু তাকে আবার ডাকুন।”
মেহেরিন একটা ছোট প্রদর্শনীর আয়োজন করে ইশতিয়াকের পুরোনো আঁকা ছবিগুলো নিয়ে। সেখানে উপস্থিত হয় অনেকেই। কেউ কেউ ছবি কিনতেও চায়। ইশতিয়াক প্রথমে ভয় পায়, লজ্জা পায়। কিন্তু মেহেরিন পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “জীবনের রঙ বদলায়, ইশতিয়াক ভাই।
আপনি শুধু চোখ খুলে দেখুন।”
এরপরের দিনগুলোয় ইশতিয়াক আবার রঙ তুলি হাতে নেয়। রোজ না হলেও মাঝে মাঝে। আঁকে বাস্তব আর কল্পনার মিশেল। আঁকে জীবন, হারানো প্রেম, অন্ধকার, আলো, আকাশে ভেসে থাকা অসমাপ্ত গল্প।
একদিন এক চিঠি আসে বিদেশ থেকে নীলার লেখা। তাতে লেখা, “তুমি কি জানো, তোমার আঁকা সেই ছবিটা এখনো আমার ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে। তুমিই বলেছিলে, জীবন থেমে থাকে না। আজ বুঝতে পারছি, জীবনের সত্যিই রঙ বদলায়। অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু জানাতে চাই তোমার জন্য আজো অনেক দোয়া করি।”
ইশতিয়াক চিঠিটা পড়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুধু বলে, “জীবনের রঙ বদলায়... কিন্তু কিছু ব্যথা থেকে যায়।” তারপর আবার তুলি হাতে নেয়, আঁকে এক নতুন ক্যানভাস যেখানে ভোরের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে কালো মেঘের বুক।
জীবনের গল্প থেমে থাকে না। প্রতিটি ব্যর্থতা, প্রত্যাখ্যান, অভিমান কিংবা স্মৃতি, সবই জীবনের নতুন রঙ। শুধু চাই, কেউ একজন পাশে এসে মনে করিয়ে দিকরঙ ফুরিয়ে যায় না, রঙ বদলায়।