জুবায়ের হুসাইন
খুশিতে উড়তে ইচ্ছে করছে জুনাইরার। ঘরের সামনের খোলা ছাদের ওপাশের নিমগাছটার এ-ডাল থেকে ও-ডালে যেমন করে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে বেড়ায় চপলা টুনিজোড়া। কিংবা ছাদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাদ্যকণা বাসায় অভুক্ত ছানাদের জন্য নিতে আসা চড়ুইগুলো যেভাবে ক্ষণে ক্ষণে স্থান বদল করে এবং পরক্ষণই চোখের পলকে উড়াল দেয়Ñ তেমনই উড়তে মন চায়।
আম্মু কিছুটা আঁচ করতে পারেন জুনাইরার এতো খুশির কারণ। নয়নের মণিকে ডেকে বলেন, তোমাকে ভাইয়ুর খুবই পছন্দ হয়েছে। সেটাই তোমাকে জানাতে চেয়েছে।’
‘আম্মু, আমি ভাইয়ুকে ছাদে নিয়ে যাই?’ কিছুটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে অনুমতি চাইলো জুনাইরা।
‘তোমার ভাইয়ু তো কেবলই খেলো। একটু পরে নিও আম্মুসোনা!’
জুনাইরা এটা মেনে নিতে পারে না। ভাইয়ুকে কোলে নিতে গেলেই একটা না একটা অজুহাত খাড়া করবেন আম্মুটা। দুর! আম্মুটা যে কী! মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। একটু আগের খুশির ছটায় যেনো একরাশ কালি লেপ্টে দিয়েছে কেউ।
ভাইয়ুটা বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে হাত-পা ছুড়ে খেলা করছে। মাঝে মাঝে দু’হাতের কচি আঙুলগুলো মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে ‘চপ্ চপ্’ করে চুষছে।
স্নেহের দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো জুনাইরা। কী কিউট লাগছে দেখতে! মুখের হাসি হাসি ভাবটা আবারও ফিরে আসতে লাগলো। বসলো ভাইয়ের পাশে।
‘আমার দুত্তু ব্যাঙ!’ মুখে ঢোকানো আঙুল বের করে নিজের মুখে বুলিয়ে বললো জুনাইরা। ‘আমার দুত্তু ভাইয়ু! আম্মু এখন কোলে নিতে দিচ্ছে না। তুমি দুদু খেয়েছো, যদি তুলে দাও, তাই।’
জবাবে ‘বুউ..বুউ..’ টাইপের কিছু উচ্চারণ করলো জুনাইরার “দুষ্টু ব্যাঙ”।
‘হ্যাঁ ভাইয়ু, আমি তোমার বু। কোলে নেবো ভাইয়ু, একটু পরে। আমরা ছাদে যাবো। পাখি দেখবো। আকাশ দেখবো। টাইম ফুল দেখবো। তোমাকে ফুল ছিঁড়ে দেবো।’
জুনাইরা যতই এসব বলতে থাকে, তিন মাস পার হওয়া ভাইয়াটা ততই তার অবোধ্য স্বরমালা বের করতে থাকে কচি মুখ দিয়ে।
জুনাইরার ভাইয়ুর নাম জুহায়ের। তার এই ‘বুউ..বুউ..’ টাইপের উচ্চারণকে ও “বু” অর্থাৎ বোন হিসেবে গণ্য করে নিয়েছে। সেজন্যই খুশিতে উড়তে চাওয়া।
জুহায়ের ‘আ¹ু আ¹ু’ শব্দও উচ্চারণ করে। জুনাইরা ও তার আম্মুর ব্যাখ্যাÑ শব্দটা আসলে ‘আব্বু’। জুনাইরার ফুফু এবং নানীও একই কথা বলেন। এই তিন মাসের ছেলেটা আব্বু ডাকও শিখে গেছে! মায়া আরও বেড়ে যায় তাদের।
দুপুর গড়িয়ে যেতে বসেছে। সারাদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছে। এক্ষণে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী দক্ষিণ অথবা পূর্ব দিকে খোলা রেখে ঘর তৈরি করতে হয়। এতে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস দু’টোই পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানের কনক্রিটের যুগে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। জুনাইরাদের শোয়ার ঘরটার পশ্চিমে একটা জানালা। ও পথে বাতাস খুব একটা প্রবেশ না করলেও খোলা রাখেন আম্মু। এই মুহূর্তে বাতাসের একটা ঝাপটা আছড়ে পড়লো থাই জানালার কাঁচের গ্লাসে। এক পাট খোলা জানালা দিয়ে ধুলো-ময়লাসহ বাতাস প্রবেশ করলো ঘরের ভেতরে। আম্মু রান্নাঘরে ছিলেন। টের পেয়ে মেয়েকে দরোজা বন্ধ করতে বললেন।
চারপাশটা হঠাৎ করেই অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।
বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে। গুড়ুম গুড়ুম করে মেঘ ডাকছে। একটু পর পর বাজ পড়তে লাগলো। কয়েক বছর ধরে বাজ পড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে।
আম্মু এবার রান্নাঘর ছাড়লেন। ছেলেকে কোলের ভেতরে নিয়ে মেয়েকে পাশে বসালেন। বজ্রের শব্দে মা-মেয়ের ভীষণ ভয়!
জুনাইরা শক্ত করে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো।
দপ্ করে ঘরের লাইট নিভে গেলো। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। কিন্তু ভয় নেই, সঙ্গে সঙ্গে হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। এসি-ডিসি লাইট লাগানো আছে ঘরে।
নিচ থেকে ফুফু দৌড়ে এলেন।
স্বস্তি পেলেন জুনাইরার আম্মু।
বৈশাখ শুরু হয়েছে মাত্র কয়দিন হলো। এর মাঝেই তার রুদ্র রূপ দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। এবার ফাল্গুন-চৈত্র মাসে রোজা পড়েছিলো। শেষের চার-পাঁচটা রোজায় বেশ গরম পড়েছে। তবে বৃষ্টি হয়নি, যদিও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টির কথা বলা হয়েছিলো।
জুহায়ের মায়ের কোলে শুয়ে সমানে আঙুল চুষে চলেছে। প্রকৃতির এইসব পরিবর্তনে তার মনোযোগে ব্যঘাত ঘটাতে পারে না।
দরোজা-জানালা বন্ধ থাকায় ঘরটা ভ্যাপসা হয়ে উঠেছে। ফুফু হাতপাখা দিয়ে ভাইপোকে বাতাস করছেন।
হঠাৎ বাতাসের বেগ কমে গেলো। ঝম ঝম করে শুরু হলো বৃষ্টি। জুনাইরার বরাবরের শখ বৃষ্টির পানিতে হাত ভেজানো। বললো, ‘আম্মু, জানলা খুলি?’
ফুফু বললেন, ‘না আম্মু, এখন জানালা খোলা যাবে না। ভাইয়ুর অসুবিধা হবে।’
জুনাইরা চুপসে যাচ্ছিল, আম্মু বললেন, ‘না আপা, থাক, ঝড় থেমে গেছে। আমি ওকে বলেছিলাম বৃষ্টি হলে তাতে হাত ভেজাতে দেবো।’
ফুফু আর না করলেন না। হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই জুনু মা? বৃষ্টি তোমার খুউব ভালো লাগে?’
‘হ্যাঁ ফুফু,’ বললো জুনাইরা। ‘বিষ্টি আমার খুব প্রিয়। ভাইয়ু বড়ো হলে আমি আর ভাইয়ু বিষ্টিতে ভিজবো। তাই না ভাইয়ু? আমার দুত্তু ব্যাঙ!’
ভাইয়ু কী বুঝলো তা সেই জানে। মুখে ‘হুউউ’ উচ্চারণ করলো। তাতে ফুফু আর আম্মু হাসতে লাগলেন। ফুফু মুখ টিপে দিয়ে বললেন, ‘পাকা বাপ আমার! সব কথা বলতে পারে!’
জুনাইরা জানালার পাল্লা খুলে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো। হাসি এ-কান থেকে ও-কান ছড়িয়ে পড়লো। ও তখন ওর ছোট্ট মনটা কল্পনার রাজ্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেÑ ভাইয়ুর হাত ধরে খোলা ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখছে। পানি জমে গেছে ছাদে। সেই পানিতে দাপাদাপি করছে। চাচাত ভাইবোন জারিম আর উমাইরাও এসে যোগ দিয়েছে ওদের সাথে।
আম্মু ডাকছেন, ফুফু ডাকছেন, বম্মা ডাকছেন, মাম্মাম ডাকছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ওদের এই বৃষ্টি বিলাস যে অন্য মাত্রা পেয়েছে! কচি হৃদয়গুলোতে সতেজ জীবনীশক্তিরা উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা ইতল বিতল বৃষ্টিতে। বৃষ্টির ছাট পেয়ে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা বীজগুলো যেমন সবুজ পল্লব বের করে মাটির উপরের বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহের প্রস্তুতি নেয়, তেমনি সেই বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের জন্য তৈরি হতে থাকে এই শিশুগুলো।