বিচিত্র কুমার
সবুজে ঘেরা এক ঘন বনের নিচে ছিল এক আশ্চর্য রাজ্যÑপিঁপড়েদের রাজ্য। দেখতে পাওয়া যেত না সহজে, কিন্তু পাতা সরালেই দেখা মিলত ব্যস্ত পিঁপড়েদের দল। কেউ মাথায় করে খাদ্য বয়ে আনছে, কেউ রাস্তা পরিষ্কার করছে, কেউ গুদামে খাবার গুছিয়ে রাখছে। এই রাজ্যের প্রতিটি পিঁপড়ে ছিল পরিশ্রমী, সৎ আর একে অপরের ভালো বন্ধু।
এই রাজ্যের রাণী ছিলেন শিলতা। তিনি খুব জ্ঞানী ও দূরদর্শী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন—সকল পিঁপড়েকে কাজ করতে হবে, কারণ পরিশ্রম ছাড়া এই রাজ্য টিকবে না। আর রাণীর ডান হাত ছিল একটি তরুণ পিঁপড়ে, নাম তার বিন্দু। সে ছিল খুবই চটপটে, পরিশ্রমী ও দায়িত্ববান। রাণী তাকে ভালোবাসতেন, কারণ সে কখনো অলসতা করত না।
গ্রীষ্মের সময় ছিল পিঁপড়েদের খাদ্য সংগ্রহের মৌসুম। তখন সকলে মিলে খাদ্য খুঁজে খুঁজে এনে গুদামে জমা করত, যাতে শীতকালে কষ্ট না হয়। কেউ ঝড়-বাদলে থামত না, বৃষ্টি কিংবা রোদ—সবকিছুর মধ্যেই তারা নিরলস কাজ করে যেত।
তবে এই রাজ্যের এক কোণে বাস করত এক আলসে পিঁপড়ে, নাম তার ডুবি। ডুবি কখনো কাজে যেত না। সে বলত, “সারাদিন খেটে লাভ কী? শীত তো এখনও অনেক দূরে। আমি পরে খাবার খুঁজে নেব।” সে কখনো গান গাইত, কখনো শুয়ে থাকত, আবার কখনো দলছুট হয়ে ঘুরে বেড়াত।
বিন্দু একদিন তার কাছে গিয়ে বলল, “ডুবি, এখনই যদি পরিশ্রম না করো, পরে কিন্তু কষ্টে পড়বে। শীত এসে গেলে খাবার পাওয়া যাবে না।”
ডুবি হেসে বলল, “তুমি পারো সারাদিন পাগলের মতো খাটতে, আমি সেটা পারি না। আমার ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে।”
বাকি পিঁপড়েরা ডুবির কথায় হতাশ হলেও কিছু বলত না। তারা নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত।
সময় গড়িয়ে গেল। বর্ষা এলো, তারপর হঠাৎ করেই শীতের আগমন। বাতাস ঠান্ডা হয়ে উঠল, মাটির উপর পানি জমে গেল, আর খাবার পাওয়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। গাছের ফল শুকিয়ে গেছে, জমিতে আর শস্য পড়ে নেই। পিঁপড়েরা তখন গুদাম থেকে খাবার বের করে ভাগ করে খাচ্ছে, একটুও অপচয় না করে।
আর তখনই শুরু হলো ডুবির কষ্ট। তার ঘরে কিছুই নেই, পেটে খাবার নেই, শরীর কাঁপছে ঠাণ্ডায়। সে সবার কাছে গেল, কেউ কিছু বলল না। সবাই চুপচাপ। শেষে বাধ্য হয়ে সে গেল রাণী শিলতার কাছে।
রাণী শুনে ডেকে পাঠালেন তাকে। ডুবির মুখ শুকনো, চোখে অনুতাপ। সে বলল, “রাণীমা, আমি ভুল করেছি। এখন বুঝেছি পরিশ্রম না করলে কেউ পাশে থাকে না। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।”
রাণী শিলতা কোমল কণ্ঠে বললেন, “তুমি ভুল বুঝেছিলে ডুবি, কিন্তু তুমি ভুল স্বীকার করেছ। আমাদের রাজ্যে কেউ ক্ষুধার্ত থাকে না। তুমি খাবার পাবে, কিন্তু মনে রেখোÑপরিশ্রম ছাড়া জীবনে কেউ এগোতে পারে না।”
সেই দিন থেকেই ডুবি বদলে গেল। সে সকালে সবার আগে উঠত, কাজ করত সবচেয়ে বেশি, গুদাম গোছাত, নতুনদের কাজ শেখাত। বিন্দু তার পাশে দাঁড়াত, তাকে উৎসাহ দিত।
ডুবি হয়ে উঠল রাজ্যের এক অনুকরণীয় পিঁপড়ে। আর সেই পিঁপড়ের রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল এক কথাইÑ
“পরিশ্রম মানেই সম্মান, আর অলসতা মানেই অপমান।”