খাতুনে জান্নাত কণা

আসলে হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তাই, কোথাও বেড়াতে যেতে আগ্রহী ছিল না সাদিয়া। ওর বোন খুব জোর করে ধরল,

: চল না যাই। আম্মার খালাতো বোন হলেও ও তোর বন্ধুর মতো। জানি, আমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। কিন্তু, যে জায়গায় কখনো যাইনি, ওখানে তুই সাথে থাকলে ভালো হয়। খালার বাসায় থেকে আমরা নানান জায়গায় বেড়াবো।

: সিদরাতের বাবা তো যেতে চাইছে না। বলছে, আমাদেরও যাওয়ার দরকার নেই। আসলে আমার কাছে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা নেই। কোথাও গেলে তো আর খালি হাতে যাওয়া যায় না। বড়জোর যাওয়া-আসার ভাড়ার টাকাটা হয়তো ম্যানেজ করে দিতে পারবো। ওখানকার অন্যান্য খরচ আপনাদের করতে হবে। ঢাকায় ফিরে আপনাদের টাকাটা আমি দিয়ে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ।

: আমারও তো অত টাকা নাই। চল। দেখা যাক। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। সিদরাতকে নিয়ে চল।

সাদিয়া সিলেটের অনেক জায়গায় এখনও যায়নি। একবার শুধু মৌলভীবাজারে গিয়ে লাউয়াছড়া অভয়ারণ্য দেখে এসেছে। সেখানে শ্রীমঙ্গলে চা বাগান দেখে তাড়াতাড়িই ঢাকায় ফিরতে হয়েছিল। একদিকে মন চাইছে, যেতে। অন্যদিকে দোদুল্যমানতা কাজ করছে। কারো উপর নির্ভর করে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? নিজের বোন হিসেবে বিশ্বাস করে মনে হয় যাওয়া যায়। কারণ, বাকি যা খরচ হবে, সেটা সে ফিরে এসে কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবে। ভাই- বোনরা তো এমনিতেই বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে। তাই, সে আর দ্বিধা না করে সব গুছিয়ে রেডি হয়ে নিল।

ভালোভাবেই তারা সিলেট পৌঁছে গেল। সাদিয়া যেহেতু নগদ অর্থ সংকটে ছিল, তাই ওর খালার জন্য এক জোড়া সিটি গোল্ডের দুল, একটা বাটিক প্রিন্টের নতুন বিছানার চাদর নিয়ে নিল। ফেসবুকে একটা বিজনেস পেজ আছে সাদিয়ার। সেই পেজে বিক্রির জন্য এই চাদর আগেই কেনা ছিল। দুলটাও। ছেলেকে নিয়ে ওদের বাসায় দু ইবা তিন দিন থাকা হবে হয়তো।

বেড়াতে বের হয়ে যে অভিজ্ঞতাগুলোর মুখোমুখি হলো, তাতে ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ওর বোন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাগ্নী নিজেরা নিজেরা ছবি তুলছে, কেনাকাটা করছে। সিদরাত আর সাদিয়ার প্রতি কোনো খেয়াল নেই। তাদের সাথে ছবি তোলার কোনো আগ্রহও দেখা গেল না। সাদিয়া নিজে থেকে সেধে ওদের সাথে দু’একটা ছবি তুলল। পরে ওর মনে হলো, ব্যাপারটা কেমন হয়ে যাচ্ছে না! আমি কেন যেচে গিয়ে ওদের সাথে ছবি তুলছি? ওরা তো আমাকে আর সিদরাতকে পাত্তাই দিচ্ছে না! যেন ওরা কোনো অপরিচিত মানুষের সাথে বেড়াতে এসেছে। এমন ভাব-ভঙ্গী করছে সিদরাতের খালা-খালু-খালাতো বোন সবাই। এমন জায়গায়, আত্মীয় পরিজন হলে একসাথে গ্রুপ ছবি তুলে। একজন আরেকজনকে ছবি তুলে দেয়। কোনো কেনাকাটা করলে, সাথে ছোট কোনো সদস্য থাকলে, তাকে একটা কিছু কিনে দেয় যেন তার মনটা খুশীতে ভরে থাকে। অথচ, সিদরাত একটা খেলনা বাইনোকুলার কিনে চাইছিল ওর মায়ের কাছে। ওর মা আপত্তি করছিল। পরে দেখল, পাশের দোকান থেকে ওর খালা, খালোতো বোনকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করছে। নিজেদের বাড়িতে নিয়ে, ছেলে- মেয়ের বন্ধু-বান্ধবীকে গিফ্ট করার জন্য চকলেট, ছোট সাইজের সাবান, চা-পাতা ইত্যাদি কিনছিল। সাদিয়ার ভাগ্নি আনিকা বলল,

: খালামণি, সিদরাতের জন্য এসব চকলেট কিনতে পারেন। খেতে বেশ মজা। সাদিয়া ওর সাথে থাকা, সামান্য যে কয়েক টাকা ছিল, তাই দিয়ে শেষে সিদরাতকে বাইনোকুলারটা কিনে দিল। চকলেট দেখে ছেলের খেতে ইচ্ছে হতে পারে দেখে, তা-ও কিনে নিল। কিন্তু, মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে গেল। আজ যদি সিদরাতের জায়গায় আনিকা থাকতো, হাতে টাকা থাকলে সাদিয়া নির্দ্বিধায় ভাগ্নীকে বাইনোকুলারটা কিনে দিত। কিন্তু, ওর বোন কি ভাবলেশহীনভাবে স্বামী আর মেয়েকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করে যাচ্ছে! ওর বা সিদরাতের প্রতি কোনো খেয়াল নেই। যদি এমন করে দূরত্ব রেখেই চলবে, তবে, এত সাধাসাধি করে সাথে নিয়ে আসার কি দরকার ছিল ? জাফলং গিয়ে ওয়াশরুমে যেতে চাইলে সিদরাতকে ওর খালু বলছিল,

: নিজে গিয়ে কাজ সেরে আসো। ক্লাস ফোরে পড়। বাথরুম খুঁজে নিতে পারবে না ?

সাদিয়া বলল,

: কোনদিকে যেতে হবে একটু দেখিয়ে দিন। তাহলেই হবে। ওতো এখনও ওর মা-বাবার সাথে সব জায়গায় বেড়াতে যায়। একা কোথাও যায় না। এখানে অপরিচিত পরিবেশে একটু আনইজি ফিল করছে।

ছেলেদের ওয়াশরুম আলাদা জায়গায় দেখে আপনাকে একটু হেল্প করতে বলছি। আমি মহিলা হয়ে ওখানে যাওয়াটা বিব্রতকর। নাহলে আপনাকে কষ্ট দিতাম না। আমিই সাথে করে নিয়ে যেতাম।

: আরে, তোমরা যে কী কর! আমার ছেলে এখন নিজে নিজে পৃথিবীর যে কোনো দেশে যেতে পারবে। যে কোনো দেশে।

হেসে ফেলল সাদিয়া। বলল,

: আমার ভাগ্নে আরিফের বয়স এখন পঁচিশ। সিদরাতকে আগে ঐ বয়সে আসতে দিন। তারপর তুলনা করলে ভালো হয়।

মনে মনে ভাবল, “ আপনার স্মার্টনেস সম্পর্কে তো খুব ভালো করেই জানি। আমার হোস্টেলের জন্য টেবিল ফ্যান কিনতে নাদিরা আপা, আপনাকে আমার সাথে পাঠিয়েছিল। সেটার সুইচ দেখিয়ে দোকানদারকে বারবার বলছিলেন , এইড্যা চলে তো? লোকটা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করছিল যখন , আমি তাড়াতাড়ি সেটাকে কভার করার জন্য বলেছিলাম , সবগুলো সুইচ ঠিকমত কাজ করে কিনা দেখান। তখন আপনিও সাথে সাথে বলে উঠেছিলেন , হ দেখান। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে এসে এখন ভাবছেন আমরা কত তুচ্ছ হয়ে গেছি। আপনি ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি। নিজের বোনের সাথে হাসপাতালে এমন কাউকে দরকার , যে ডাক্তার এবং নার্সদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে পারে। হারিকেন দিয়ে খুঁজেও নিজের পরিবারে এমন কাউকে না পেয়ে আপনার বৌ , মানে আমার বোন তখন আমাকেই রিকোয়েস্ট করেছিল , যেন আপনার বোনের সাথে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে থাকি। আমার কি খুব আনন্দ লেগেছিল বলে আপনার মনে হয়? মোটেই না । কিন্তু , মানবিকতার খাতিরে না করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস সেরে এসে তাকে সময় দিয়েছিলাম। এই আশায় না , যে আপনারা কখনো তার প্রতিদান দিবেন। আজ নিজেরা খুব স্মার্ট আর অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে গেছেন এমন ভাব দেখান তাই না ? এমন ফুটানি দেখাতে চেষ্টা করবেন জানলে , আপনাদের সাথে কি আসতাম মনে করেন ? ”

খাবার খেতে গিয়ে সাদিয়ার আরেক প্রস্থ মন খারাপ হলো। ছেলেটা গোশত আর ডিম ছাড়া কিছু খেতে চায় না। দোকানে মুরগির গোশত খাবে বলার পর , সিদরাতের খালু হেসে হেসে বলছিলেন ,

: হ হ, যা মন চায় খাও।

পথে যাত্রাবিরতির সময়ও, রেস্টুরেন্টে যখন সিদরাত স্যান্ডউইচ খেতে চাইল, ওর খালু সবগুলো দাঁত বের করে হেসে হেসে বলল,

: হ হ খাও। যা মন চায় খাও।

নাদিরা বলল,

: থাক, খেতে চাইলে খাক।

সাদিয়া হিসাব রাখছিল, কোথায় কত খরচ হচ্ছে।

সিদরাতকে নিয়ে নিজের সহোদর বোনের পরিবারের সাথে বেড়াতে আসাটা, তার জন্য এত নিরানন্দের হবে, ভাবতে পারেনি সাদিয়া। অথচ, এরা যখন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তাদের সাথে সেতুবন্ধের কাজ করেছে সে। সাদিয়ার বোনের জন্য তার দুলাভাইকে কেউ উপযুক্ত ছেলে বলে মনে করেনি। করবে কী করে ? অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে। পরিবারে একমাত্র শিক্ষিত মানুষ। এমন জায়গায় আত্মীয়তার কথা ওরা কল্পনাতেও আনেনি। তাই, আত্মীয়রা যখন তার বোনের পরিবারকে অবজ্ঞার চোখে দেখতো, সাদিয়ার খুব খারাপ লাগতো। সে তার নিজের বাসায় বোনকে বাচ্চাদেরসহ, নিয়ে এসে আদর-যত্ন করতো। অবশ্য, সেটা ছিল সাদিয়ার চাকুরি জীবনে। বিয়ের আগের দিনগুলোতে। যখন সাদিয়ার বিয়ে হয়ে গেল, ওর বোন নাদিরা আর তার স্বামী তখন তরতর করে ধনী হয়ে যাচ্ছে। নাদিরার স্বামী আসলাম, বিদেশে গিয়ে ব্যবসাপাতি করে, বেশকিছু টাকা-পয়সা নিয়ে ফিরল। তাদের সংসারে তখন বেশ স্বচ্ছলতা। আত্মীয়রা পালা-পার্বনে ডাকে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে। সাদিয়ার সংসার তখনও সাদিয়া গুছিয়ে উঠতে পারেনি। যেহেতু বিত্তের জৌলুস নেই, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, নাদিরা আর সাদিয়ার বাসায় খুব একটা আসে না। তার সাথে যোগাযোগও করে না। যে বোনটার নিজের একটা গাড়ি আছে, ঢাকার অভিজাত এলাকায় বড় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে, তার সাথে খুব দহরম মহরম। সাদিয়া সব বুঝে। তাই কষ্ট পেলেও আর কিছু বলতে যায় না। কিন্তু, এবার নাদিরার এই বেড়াতে আসার পরের ব্যবহার সে হজম করতে পারছে না। ওর বাচ্চার সাথে ওরা যা করেছে, এটা ওকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। আরিফ বড় হওয়ার পরও, এক ঈদের আগে, ওর সাথে শপিং এ গেলে, ভাগ্নে যে গেঞ্জি পছন্দ করেছে, সাদিয়া তার দাম পরিশোধ করে দিয়েছে। আরিফকে দাম দিতে দেয়নি। সাথে আরো একটা গেঞ্জি আলাদা কিনে দিয়েছে। বাসায় ফেরার পর যখন নাদিরা শুনেছে, বলেছে,

: কেন তুই দাম দিয়েছিস? কি দরকার ছিল? সাথে আরো একটা কিনে দেয়ার কোনো দরকার ছিল না।

তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়েছে সে খুব বিরক্ত। সাদিয়া বিস্মিত হয়ে ভাবে, ওর বোন বিরক্ত হলো কেন? সাদিয়ার ছোট্ট ছেলেটাকে যদি আবার কোনো ড্রেস কিনে দিতে হয় এই ভয়ে ? না, সিদরাতের খালা সিদরাতকে সেই ঈদে কিছু কিনে দেয়নি।

শুধু সেই ঈদ কেন? কোনো ঈদেই দূরে থেকে সিদরাতকে কখনো কোনো গিফট পাঠায়নি নাদিরা। সাদিয়া মনে মনে ভাবতে থাকে, আসলে ছোট বোন হিসেবে বোনের কাছে যে আদর ভালোবাসা পাওয়ার কথা। নাদিরা তাকে মনে হয় না তা দিতে কখনো পছন্দ করে।

বাসায় ফিরে সিদরাতের বাবার সাথে এগুলো শেয়ার করলে, সে তখন জানতে চায় ঠিক কত টাকা খরচ হয়েছে। এর কয়েক দিন পরেই, নাদিরা তার স্বামীকে নিয়ে জরুরী কাজে সাদিয়াদের বাসায় এলে, সাদিয়া তাদের সাধ্যমত আদর- যত্ন করে। চলে যাওয়ার আগে, সে তার বোনকে, সিলেটে যাওয়ার পর হওয়া বাড়তি খরচের টাকা হাতে ধরিয়ে দেয় ।