মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন
সদ্য বিবাহিতা সাকি আহমেদ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট বেড়ানোর পর সর্বশেষ কক্সবাজারে হানিমুন সেরে যখন প্রথম নানুবাড়ি বেড়াতে আসে তখন নানুবাড়ির সবাই বলাবলি শুরু করে, সাকি আসলেই একজন ভাগ্যবতী মেয়ে। তাকে দেখে মনে হয় যেন ভরা যৌবনে, লাবণ্যময়ী চেহারায়, নাকে-কানে, হাতে-মুখে, মাথা-গলায় দামি গয়নাভর্তি বিদ্যুৎপ্রভা একজন স্বর্গীয় অপ্সরী। যেমন রূপের বাহার তেমনি বিদেশি দামি পোশাকে সারা শরীর ঢাকা। সাকির কথা-বার্তায় চলনে-বলনে একটি দাম্ভিক ভাব সবাই লক্ষ করে। কথায় কথায় সে এমনভাবে হাত-মাথা নাড়ে যেন পরিহিত স্বর্ণালঙ্কারের দ্যুতি সবার চোখে পড়ে। আর কিছুদিন পর সাকি আবার ঘুরতে যাবে সিঙ্গাপুর।
তা হবেই না কেন, প্রবাসী স্বামী, শহরের দামি এলাকায় নিজস্ব দালান-কোঠা, গাড়ি-ঘোড়া, কী নেই তার। প্রবাসীর আয় ছাড়াও তার স্বামীর রয়েছে বেশকিছু দোকানপাট, ভাড়া বিল্ডিং ও বন্ধুর সাথে শেয়ারে ব্যবসা। প্রতি মাসে তার যা আয় সে তুলনায় ব্যয়ের খাত তেমন নেই বললেই চলে। স্বামীর যা ইনকাম তার সবই থাকে সাকির হাতে। প্রবাসীর বধূদের তো আর খরচ করার নির্দিষ্ট কোনো খাত নেই। যখন যা খুশি তখন সে ইচ্ছা পূরণই যেন বধূদের কাজ। বিয়ের দুই মাস পর সাকির স্বামী চলে যায় দুবাই। সাকি হয় দুই মাসের পোয়াতি।
আবরার হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দুবাইতে। আমাদের দেশ থেকে যারা মধ্যপ্রাচ্যে টাকা রোজগারে যায় তাদের অধিকাংশই অদক্ষ বা আধাদক্ষ শ্রমিক। সেখানেও আবার দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকে বিমান বন্দর থেকেও ফিরে আসে। ভিসার সাথে চাকুরির ধরণ না মেলাতে অনেকে বিদেশে ধুঁকে ধুঁকে মরে। অথবা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয়ে খালি হাতে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। সে তুলনায় আবরার বেশ ভালোই আছে। দুবাই গিয়ে প্রথম প্রথম সে কোনো নির্দিষ্ট কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়। পরে অবস্থা ধীর ধীরে পরিবর্তন হয়। দেশে থাকতে আবরার সখের বশে কম্পিউটারে ‘অফিস-এপ্লিকেশন’ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো। দুবাইতে সে প্রশিক্ষণ কাজে আসে। বেশ কিছুদিন বেকার থাকার পর এক বিদেশিনীকে হাত করে একটি ভিসা প্রসেসিং সেন্টারে আবরার কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি নেয়। তখন থেকে তার কপাল ফেরে। স্ত্রী ছাড়াও মা-বাবা আর এক ভাই ও এক বোন নিয়ে ছোট্ট সংসার তাদের। মাসের শেষে যা বেতন পায় সেখান থেকে নিজের প্রয়োজনীয় টাকা রেখে বাকি সব টাকা পাঠায় স্ত্রীর কাছে।
টাকা-পয়সার কোনো অভাব না থাকলেও সাকি মানসিকভাবে বেশ অশান্তিতে দিন কাটায়। একেতো স্বামী পাশে নেই তদুপরি সহায়-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় ব্যস্ত থেকে তার ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা। ইদানীং তাকে কোর্ট-কাচারীতেও দৌঁড়াতে হয়। তথাকথিত এক ডেভেলপারের পাল্লায় পড়ে সাকির এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। স্বামীর পাঠানো টাকায় নতুন অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট ক্রয়বাবত সাকির প্রদত্ত পুরো ৮০ লক্ষ টাকাই ফ্ল্যাট ব্যবসায়ীরা অস্বীকার করে বসে। ফলে স্বত্ব মামলায় প্রতি সপ্তাহে তাকে আদালতে দৌঁড়াতে হয়। বিপদের সময় সাকির সাহায্যকারী কাউকে পাওয়া যায় না। যদিও ফাউ খেতে পারে বলে অনেক আত্মীয়-স্বজন ও বসন্তের কোকিলের কোনো অভাব নেই তার। কিন্তু বিপদে-আপদে তাদেরকে আর খোঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া ভেতরে ভেতরে অনেক আত্মীয়-স্বজন সাকি-দম্পতির দ্রুত উন্নতি দুচোখে দেখতে পারে না। সুযোগ বুঝে অযথা ঝামেলা সৃষ্টি করে তারা পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
আনিস তার মামা আবরারের মাথা-ব্যথার বড় কারণ। মামার বাহানায় আবরারের ভাড়াবাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আনিস ইদানীং চাঁদাবাজি শুরু করে। এতে সমূহ লোকসানে পড়ে সাকি-পরিবার। আনিস আবার একজন স্থানীয় গ্যাংলিডার। বিশেষ রাজনৈতিক দলের ‘বড়ভাই’দের সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। তাই সাকিদের প্রচুর ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও চোখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। এভাবেই চলছে সাকিদের প্রাত্যহিক জীবন।
তিনদিন ধরে সাকি ক্লিনিকে ভর্তি আছে। চলছে তার নিবিড় পরিচর্যা। চতুর্থ দিনের মাথায় ডাক্তারের কাছ থেকে সুখবর আসে, সাকি এক পুত্র সন্তানের মা হয়। খুশির আতিশয্যে সাকির চোখে পানি চলে আসে। সে খোদার দরবারে হাজার শোকরিয়া জানায়। এ সময় যদি আবরার কাছে থাকতো তবে কতইনা ভালো হতো! মনভরে ভালোবাসা জানাতো তাকে। কিন্তু পারিবারিক সচ্ছলতার জন্যে আবরারকে আজ বছরের পর বছর বিদেশে কাটাতে হচ্ছে। এসব চিন্তা-কল্পনায় বিভোর হয়ে পড়ে সাকি। ঠিক এমনি সময় তার মোবাইলে দুটি কল আসে। একটি আনন্দের, অন্যটি যন্ত্রণার। প্রথম কলটি করেছে দুবাই থেকে তার স্বামী আবরার। তাতে সে পেলো শুভেচ্ছা, সান্ত¦না, স্বস্তি এবং সদ্যজাত পুত্রের কাক্সিক্ষত নাম। দ্বিতীয় কলটি করেছে তার মামাতো ভাই রফিক। তাতে সে জানালো ভাগিনা আনিসের দুটি ভাড়াঘর অবৈধ দখলের খবর। সাকির কাছে এ যেন হরিষে-বিষাদ। তবু অসহায় সাকির কিছুই করার নেই। ক্লিনিক-ফেরত সাকি স্বামী-স্ত্রীর পছন্দের নাম নিয়ে পুত্রের জন্ম-নিবন্ধন সম্পন্ন করে।
আজ থেকে বিশ বছর আগে আবরার দুবাই প্রবাসী হয়েছিলো। মাঝখানে শুধু একবারই দেশে এসেছিলো সে। তখন পুত্রের বয়স ছিল দশ বছর। এখন তার বয়স বিশ। সে গণিত বিষয় নিয়ে অনার্স পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। একজন রেমিটেন্স যোদ্ধার পুত্র হয়েও সে বাবার অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যে গা ভাসিয়ে দেয় নি। একজন সৎ নাগরিক হওয়ার অদম্য ইচ্ছায় সে অধ্যয়নে নিয়োজিত থাকে।
সাকির সুখের সংসারে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। সবই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। আজকে দোকানে টাকার ঝামেলা তো কালকে ঘরভাড়া নিয়ে ফ্যাসাদ। সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠে ডেভেলপারের টাকা আত্মসাৎ। আদালতে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ডেভেলপার ফ্ল্যাটের মামলার রায় নিজের পক্ষে নিয়ে নেয়। ভাগিনা আনিসের অত্যাচার অসহ্য হয়ে ওঠে। দেশে আবরারের ব্যবসায়িক পার্টনার ধূর্ত মফিজ একদিন ভুয়া দলিল সৃজন করে তার পুরো ভাড়াঘর দখল করে নেয়। এতোদিন সাকি যাদেরকে বিপদে-আপদে টাকা-পয়সা ধার দিয়ে সাহায্য করে আসছিলো তাদের আর টিকিটিরও দেখা নেই। এর মধ্যে আরও রয়েছে পরশ্রীকাতর আত্মীয়-স্বজন। সকলের সম্মিলিত আঘাতে সাকির পারিবারিক প্রাচুর্য লোপ পেতে থাকে আশঙ্কাজনক হারে। অবলা নারী সাকির শক্তিমত্তা ও পার্থিব সীমাবদ্ধতার কারণে আবরারের ধন-সম্পদ ধীরে ধীরে বেহাত হতে শুরু করে। তার আয়ের পথ দিন দিন সংকোচিত হয়। ভাটা পড়ে সাকির জৌলুসেরও। এভাবে বেশ ক’বছর গড়ায়। এরই মাঝে খবর আসে প্রবাসে আবরারের চাকরি চলে যাওয়ার। সংসারে নেমে আসে দৈন্যের অন্ধকার। সাকি-দম্পতি চোখে সর্ষেফুল দেখে। আবরারের এখন নির্ভর করতে হয় ধার-কর্য ও পরিবার থেকে পাঠানো সামান্য টাকার ওপর। আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হয় সংসারে।
চোখের সামনেই ডেভেলপারের ৮০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ, ধূর্ত মফিজের ভাড়াঘর দখল, ভাগিনা আনিসের জবরদখল, নিজের বেকার জীবনে অসুস্থতাÑ এমনি নাজুক পরিস্থিতিতে খবর এলো তাদের নিজস্ব দোকানে ডাকাত পড়েছে। এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আবরারের একদিন ব্রেন স্ট্রোক হয়। তার শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যায়। সে আর বিদেশে থাকতে পারে না। বন্ধুদের সহায়তায় আবরার দেশে চলে আসে কোনোমতে। দেশে এসে দেখে এখানে ত্রাস ও স্বৈরাচারের রাজত্ব চলছে। মানুষ নিজের ন্যায্য অধিকার থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। অপরাধীর বিচারহীনতার সংস্কৃতি পুরো দেশকে জাহান্নামে পরিণত করেছে। সিন্ডিকেটে সকল সেক্টর বন্দী। সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে তুঙ্গে।
আবরারের শরীরের একপাশ অবশ হওয়ায় সে ঠিকমত চলাফেরা করতে পারে না। তার ওপর রয়েছে ডাক্তার-ক্লিনিক, ওষুধ-পথ্যের বাড়তি খরচ। দেহে প্রাণ আছে বলেই জীবন পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু আয়ের সবপথ বন্ধ হলে জীবন পরিচালনা করা কীভাবে সম্ভব। যে সাকির একদিন গয়নার ভারে ন্যুব্জদেহ ছিলো, সে এখন পরিবারের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে একে একে সব গয়না বাঁধা-বন্ধক আর বেচাবিক্রি করে নিঃস্ব। ওদিকে তার স্বামী আবরার চলৎ-শক্তিহীন জড় পদার্থের মতো বিছানায় কাতরায়। সর্বোপরি পরিবারের আর্থিক বেহাল অবস্থায় তারা একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। কোনো উপায়ান্তর না দেখে সাকি একদিন গার্মেন্টসে নিম্ন বেতনে চাকরি নিতে বাধ্য হয়।
সাকিদের ঠিক এমনি করুণ অবস্থায় দেশে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে স্বৈরাচার তাড়াতে। এক পর্যায়ে ছাত্রদের আন্দোলন ছাত্র-গণআন্দোলনে পরিণত হয়। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। ফলে স্বৈরাচার জারি করে কারফিউ, মাঠে নামায় মিলিটারি। দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বিক্ষোভ ও গণ-অভ্যুত্থান দমাতে স্বৈরাচার লেলিয়ে দেয় নিজস্ব পেটোয়া বাহিনি। কিন্তু ছাত্রদের বিক্ষোভ দমাতে না পেরে পুলিশ নির্বিচারে গুলী চালায় ছাত্র-জনতার ওপর। এতে শহিদ হয় শতশত নিরীহ ছাত্র-জনতা। হাসপাতালে কাতরায় গুরুতর আহতরা।
প্রচার মাধ্যমে এ রকম ভয়াবহ খবর শোনে সাকি তার ঢাবি পড়ুয়া পুত্রের সাথে যোগাযোগ করলে সে বলে, “মা, আমরা এখন আন্দোলনে আছি। যতক্ষণ না দেশ থেকে স্বৈরাচার দূর হবে ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে। আমাদের জন্য দোয়া করোÑ যাতে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারি। মা, তোমাকে আমাদের কয়েকটি সুন্দর সুন্দর স্লোগান শুনাই: ‘স্বৈরাচারের আস্তানা, বাংলাদেশে হবে না’, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলী কর’, ‘চেয়ে দেখ চোখের আগুন, এই ফাগুনে হবে দ্বিগুণ”, “দেহের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে” ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মা-বাবা এতে বিচলিত হয়ে পুত্রকে তাড়াতাড়ি যেভাবে পারে বাড়ি চলে আসতে বলে। কিন্তু সে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে বদ্ধপরিকর।
ঠিক পরদিন সাকি-দম্পতির কাছে খবর আসে, তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান, ঢাবির মেধাবী ছাত্র শহিদ হয়ে পড়ে আছে ঢাকার রাজপথে। সাকি ও আবরার এ মর্মান্তিক খবর শুনে শোকে একেবারে পাথর হয়ে পড়ে। তাদের দুচোখে অশ্রু নেই, বুকের ভেতর জ্বলছে বেদনা আর ক্রোধের আগুন। অর্থ-বিত্ত, ধন-সম্পদ ও প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র সবকিছু হারিয়ে তারা আজ ভেতরে-বাইরে একেবারে নিঃস্ব। সাকির স্বামী আবরার আহমেদ পুত্রের শেখানো স্নোগান স্বগত উচ্চারণ করেÑ “লাশের ভেতর জীবন দে ...” কিন্তু এটুকু বলেই আর কিছু বলতে পারে না। দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করে জীবনলীলা সাঙ্গ করে আবরার আহমেদ। সাকির জীবনে নেমে আসে গভীর অন্ধকার।