শাহীন সুলতানা

ছবির মতো সুন্দর গ্রাম নন্দনপুর। গ্রামের চৌমাথা জুড়ে চৌধুরীদের বিশাল আমবাগান। সে বাগানে নানা জাতের আম। হিমসাগর, ল্যাংড়া, মল্লিকা, বউ সোহাগী, মিসরিভোগ, তোতাপুরিসহ আরও কত আম! বিভিন্ন বিদেশি ফলও শোভা পায় সেখানে।

আমের মৌসুমে গাছ ভরে আম এসেছে। কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল। বাগান জুড়ে ফলের মেলা।

শনিবার দুপুরে বাজার থেকে ফেরার পথে রোমেল ঢুকে পড়ে সে বাগানে। পাকা কাঁঠালের মৌ মৌ ঘ্রাণে বিমোহিত হয়। ফজলি, আম্রপালি, বারোমাসি ও মধুগুটি আমে ভরে আছে আমগাছের ডালপালা। রোমেল অবাক হয় সে সৌন্দর্য দেখে।

বাগানে ঢুকতেই ঠাস ঠাস করে দু’তিনটি পাকা কাঁঠাল পড়ে রোমেলের সামনে। ডানপাশের জামরুল গাছটায় লাল লাল জামরুল। তারপাশে করমচা গাছে কী সুন্দর পাকা পাকা করমচা!

এসব দেখতে দেখতে রোমেল কাঁঠাল নিয়ে হাজির হয় পাহারাদারদের কাছে। বলে- কাকু, বাগানের গাছে অনেক কাঁঠাল পেকে আছে। ঘ্রাণে ভরে গেছে গাছতলা। তোমরা চাইলে সব কাঁঠাল পেড়ে দিতে পারি। যেই কথা সেই কাজ। সড়সড় করে গাছে উঠে কয়েকটি পাকা কাঁঠাল নিয়ে নেমে আসে মুহূর্তে।

পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু ফল পায় সে।

বাড়ি এসে ভাইয়ের সাথে মজা করে ফল খায় রোমেল। মা বলে- “শোন বাবা, কাজ করে খেলে কখনো খাবারের অভাব হয় না। যে ভালো কাজ করে সে অনেক বড়ো হয়। তবে লোভ করবি না। লোভে বিপদ বাড়ে। মায়ের কথায় দু’ভাই মাথা নাড়ায়। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে ওরা।

রাতে ঘুমিয়ে রোমেল আমবাগানের স্বপ্ন দেখে। হাড়ি ভাঙ্গা, সিঁদুরটোকা, চিনি দানা... তারপর ঘুম ভেঙে যায়। ভাবে- কী চমৎকার মিষ্টি বাগানের আমগুলো!

রোমেলের বন্ধুরা তার কাছ থেকে মাঝেমধ্যে আম কেনে। বলে- তোর আমগুলো আমাদের কাছে বিক্রি কর রোমেল। দ্বিগুণ টাকা দেব! যা মিষ্টি একেকটা!

রোমেল ভাবে - বুদ্ধিটা খারাপ না। প্রতিদিন কয়েকটা আম বিক্রি করতে পারলে দ্রুত টাকা রোজগার করা যাবে!

এখন সে চৌধুরী বাড়ির বিশ্বস্ত কর্মচারী। প্রতিদিন বাগানে আসে, ফল পাড়ে, বিনিময়ে ফলের ভাগ পায়। কোনোদিন আম, কোনোদিন জাম, কোনোদিন লিচু পাড়ে সে। কিন্তু এখন আর অল্প ফলে মন ভরে না রোমেলের। পেটের ক্ষুধা মিটলেও চোখের ক্ষুধা বাড়তে থাকে।

একদিন সন্ধ্যা বেলা লুকিয়ে গাছে উঠে পড়ে রোমেল। সাথে নেয় বড়ো একটা থলে আর লম্বা রশি। রশি থাকলে ভরা থলে গাছ থেকে নামাতে সুবিধা হয়।

আষাঢ়ের আম্রপালি আম খেতে দারুণ মিষ্টি। তাছাড়া ফজলি আমও স্বাদে অপূর্ব! অসংখ্য আম ঝুলে আছে ডালের ফাঁকে ফাঁকে। রোমেল টপটপ করে আম ছিঁড়ে থলে ভরতে থাকে। ভাবে- মগডালের আমগুলো বেশি মিষ্টি আর বড়ো। তাই গাছ বেয়ে আরও উপরের দিকে উঠতে থাকে। অমনি বড়ো দু’টো আমে টান দিতেই পা ফসকে নিচে পড়ে যায় সে।

বাবা-রে... মা-রে বলে চিৎকার করে ওঠে। বাগানের পাহারাদারেরা দৌড়ে আসে। রোমেলকে দেখে হতভম্ব সবাই। বলে- এই রাতের বেলায় তুই গাছে কেন রে? ব্যথায় গোঙাতে থাকে রোমেল। চৌধুরী সাহেব রোমেলের পায়ে বরফ লাগাতে লাগাতে বললেন- কী রে খোকা, তুই বললেই তো কিছু আম তোকে বেশি দিতাম বাবা! রাতে এসে এভাবে হাত-পা ভাঙলি কেন? ক’টা আমের লোভে কেউ নিজের জীবন এভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়!

তীব্র ব্যথা আর লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল রোমেল।

হাতজোড় করে বলল- চাচাজান, আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। আমি আর কখনো এমন কাজ করব না। মায়ের কথা অমান্য করেই আমার বিপদ হয়েছে। মা বলেছিল- লোভ না করতে। আমি মায়ের কথা শুনিনি। আমায় দয়া করুন। আমি আর কখনো লোভ করব না।