শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট। দেশ উত্তাল। বাতাস ভারী হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের গন্ধে। একটি শান্তিপূর্ণ দাবিকে কেন্দ্র করে রাজপথে নামল হাজারো তরুণ, ছাত্র-ছাত্রী। তাদের কণ্ঠে ছিল “বৈষম্য নয়, ন্যায্য অধিকার চাই!”
কিন্তু সেই ন্যায্য দাবিকেই স্বৈরাচারী সরকার দেখল এক অন্য চোখে। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল, তখনই তার জবাবে নামল রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ, র্যাব, সশস্ত্র গুণ্ডাপাণ্ডা। নিপীড়নের ঝড় উঠল চারদিকে। গুলীর শব্দে কেঁপে উঠল দেশের মাটি, ছাত্রের শরীর রক্তে রঞ্জিত হলো।
প্রথম দিকে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল কেবল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে, কিন্তু রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ যেদিন বুক চিতিয়ে দাঁড়াল পুলিশের সামনে সেদিন থেকে বদলে গেল দেশের ইতিহাসের মোড়। তিনি ভাবেননি, এতটা নির্মম হবে রাষ্ট্র। তিনি কেবল বিশ্বাস করতেন, একটি ন্যায়বিচারপ্রার্থী বুককে কেউ গুলী করে না। কিন্তু সে বিশ্বাসই হয়ে উঠল তাঁর মৃত্যুর কারণ। আবু সাঈদ গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলেন। তাঁর বুকের রক্তে রাঙা হল রাজপথ। তাঁর মৃত্যু শুধু একটি জীবন হারানো নয়, এ ছিল এক বিশাল জাগরণের আহ্বান।
আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সারা দেশের ছাত্র-জনতা যেন ঘুম ভেঙে উঠল।
বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা হয়ে উঠল রণাঙ্গন। ১৬ জুলাই থেকে ঢাকার রাজপথে নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী। তারা অচল করে দেয় নগর জীবন।
সরকার এক অমানবিক সিদ্ধান্তেÍ ১৮ জুলাই নেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে নতুন করে শুরু করল হত্যাযজ্ঞ। বৃষ্টির মতো গুলী বর্ষণ চলল রাজপথে। শিশু, বৃদ্ধ, পথচারীÑ কেউ বাদ গেল না। একটি রাষ্ট্র কীভাবে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজ হাতে ধ্বংস করে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো এই দিনগুলো।
১৯ জুলাই রাতভর গ্রেপ্তার করা হলো আন্দোলনের শীর্ষ ছাত্রনেতাদের। তাদের ধরে নেওয়া হলো ডিবি হেফাজতে। তাদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। তবে জনগণের দাবি ও প্রতিরোধে সরকার বাধ্য হয় তাদের মুক্তি দিতে।
এই লড়াই থেমে যায়নি। ছাত্রসমাজ ঘোষণা দিল---
“জুলাই শেষ হয়নি, শেষ হবে না, যতদিন অধিকার না আসবে।” সরকারের অবহেলায় যখন পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়, তখন ছাত্রদের একদফা দাবিতে গর্জে ওঠে নতুন কর্মসূচি। ঘোষণা আসেÑ
“৬ আগস্ট লং মার্চ টু ঢাকা।” তবে পরে সেটিই এগিয়ে এনে নির্ধারণ করা হয় ৫ আগস্ট। এই দিনটিই পরিণত হয় এক ঐতিহাসিক দিনে ৩৬ জুলাই নামে।
সারা দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা রওনা হয় ঢাকার পথে। কেউ আসে পায়ে হেঁটে, কেউ সাইকেলে, কেউ ট্রাকে, কেউ রাতের আঁধারে। সকাল থেকেই তারা ঢাকার রাজপথে নেমে পড়েÍ
কিন্তু আবারও রাষ্ট্র শুরু করে নির্বিচারে গুলী বর্ষণ। শিশু থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আরও অনেক শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। ৩৬ জুলাই হয়ে ওঠে এক গণজাগরণের চূড়ান্ত রূপ।
সেই দিন ছাত্রদের নির্ভীক সিদ্ধান্ত ছিল “এবার আর নয়, এবার স্বৈরাচারের পতন চাই।”
অবশেষে, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যেখানে সরকার নিরুপায় হয়ে পড়ে। সশস্ত্র বাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু ছাত্ররা জানিয়ে দেয় স্বৈরাচার নয়, গণতন্ত্র চাই। তারা গণভবন ঘেরাও করে। চূড়ান্ত রণকৌশলে অবশেষে পতন ঘটে সেই স্বৈরাচারী শাসকের।
রক্তে লেখা হয় এক নতুন ইতিহাস একটি ছাত্রআন্দোলনের জয়গাঁথা, যার মূল নায়ক আবু সাঈদ।
আজ সে নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, সাহসে আর চোখের জলে। সে কেবল একজন শহীদ নয়, সে একটি প্রতীক স্বাধীনতার, ন্যায়ের, মানবতার।