জোবায়ের রাজু

দেখতে দেখতে মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেল। নাসরিন মেয়ে অদিতির দিকে তাকিয়ে ইদানীং এই কথাটাই ভাবছে। মেয়েরা হঠাৎ করে ঝাড়া দিয়ে বড় হতে হতে যৌবনের দিকে অগ্রসর হয়। অদিতির এমন পরিবর্তনে নাসরিন মেয়েকে জীবনÑযৌবনের তাৎপর্য শেখায়। ওড়না বুকে জড়ানোর ইতিকথা শেখায়। অদিতিও ভালো মেয়ের মতো মায়ের জ্ঞান দান আমলে নেয়।

এবার মাধ্যমিক দিবে অদিতি। ভারী সুন্দরী হয়েছে দেখতে। অনেকটা বাবা হারুনের মতো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে নাসরিন প্রায়ই এটা চিন্তা করে। বাবার মতো মেয়েটারও ঠোঁটের বাম পাশে একটা তিল আছে। এই তিলটাই নাসরিনকে জীবনভর মনে করিয়ে দেয় হারুনের কথা। আথচ সে হারুনকে বার বার ভুলতে গিয়েও ভুলতে পারে না। কেনই বা হারুনকে মনে রাখবে নাসরিন, যে হারুন তার জীবন নষ্ট করেছে, তাকে অকারণে বার বার মনে করবার কি এমন অর্থ আছে!

অদিতির বয়স যখন দুই বছর, তখনই হারুনের সাথে নাসরিনের ডিভোর্স হয়ে যায়। সংসার জীবনের যখন হারুনের সাথে নাসরিন একই ছাদ তলায় বাস করতো, কোন দিন একবিন্দু সুখে থাকতে পারেনি। অথচ দুজনের বিয়েটাও হয়েছে ডাক ঢোল পিটিয়ে আর দশ গেরাম কাঁপিয়ে।

পারিবারিক দেখা শোনায় বহু বছর আগে হারুনের সাথে নাসরিনের বিয়ে হয়। তখন বেশ সুপুরুষ ছিল হারুন। হাজারে একটা যাকে বলে। সুদর্শন আর সুঠাম দেহের হারুনকে বিয়ে করে সুখের স্বর্গে পৌঁছে গেছেÑপ্রথমে এমনটি ধারণা করেছে নাসরিন।

দিন দিন হারুনের কার্যকলাপের প্রভাবে নাসরিন বুঝতে পারলো সে যেটাকে সুখের স্বর্গ ভাবছে, সেটা আসলে তা নয়। বরং নরক। এই নরকে হারুনের দেয়া মানসিক নির্যাতনে কখনো কখনো হাঁপিয়ে উঠতো নাসরিন। হারুনের একরোখা জেদ, তার উপর প্রতিনিয়ত মদ্যপান, বার বার নারী কেলেংকারীতে জড়িয়ে যাওয়াÑসব মিলিয়ে নাসরিনের জীবন হয়ে উঠেছিল ভরাÑডুবির সংকটে।

ততদিনে প্রেগনেন্টও হয় নাসরিন। গর্ভবতী স্ত্রীর প্রতি কোন আগ্রহবোধ জন্মায়নি হারুনের মনে। বাবার অঢেল সম্পদ আর ব্যাংকে জমানো কাড়ি কাড়ি টাকার ভুবনে নিত্য বাস করতো হারুন। মদÑগাঁজার আসরে বদ লোকের সাথে গলায় গলায় সম্পর্ক হতে থাকে হারুনের। এক পর্যায়ে সে হয়ে উঠে জুয়া খেলার মহা নায়ক। সেই জুয়া খেলায় বাবার ব্যাংকের তাজা টাকা নামতে থাকে। এতে মতিউর রহমানকে তেমন একটা হতাশ হতে দেখা যেত না ছেলে হারুনের কার্যকলাপে। কারণ তার এত এত টাকা আর সম্পদ তো একমাত্র সন্তান হারুনেরই। তবু মাঝে মাঝে মতউির রহমান ছেলেকে সুপথে ফিরে আসার আহবান করতো, কিন্তু কাজ হতো না। কারণ হারুন এক রোখা স্বভাবের, উগ্র মেজাজ। মুখের ভাষাও খারাপ। কার সামনে কোন ধরনের ভাষা উচ্চারণ করতে হবে, এই জ্ঞানবোধটুকু হারুনের ছিল না।

এত কিছুর পরও স্বামীর সকল সমস্যা অবশ্য মেনে নিয়েছে নাসরিন। সে ভাবতো হারুন একদিন না একদিন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ততদিনে একের পর এক নারী কেলেংকারীতে জড়িয়ে পড়ে হারুন। যেটা একটুও মানতে নারাজ ছিল নাসরিন। অন্য নারীর সাথে স্বামীর সম্পর্ক হবে, এ কারণে মনে মনে বিরক্ত হতো সে, কিন্তু প্রতিবাদের ক্ষমতা ছিল না। লাখপতি হারুনের ঘরে সামান্য একজন শিক্ষক কন্যা নাসরিনের জীবন ছিল নাচের পুতুলের মতো। ততদিনে মেয়ে অদিতির পৃথিবীতে আসার সময় হতে থাকে। নাসরিনের ধারণা ছিল সন্তানের মুখ দেখলে হারুন ভালো হয়ে যাবে। কোন কুÑকর্মের আর অংশীদার হবে না।

এক সময় অদিতি পৃথিবীতে আসে। রাজকন্যার মতো মেয়ে দেখেও কোন ভাবান্তর হয় না হারুনের। নাসরিনের ধারণাকে পাল্টে দিয়ে হারুন আগের মতই অপরিবর্তন থাকে। মাঝে মাঝে রাতে বাসায়ও ফিরে না। রাতভর জুয়ার নেশায় পড়ে থাকে।

সব কিছুকে ভাগ্য বলে নাসরিন যখন মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যতের আশার আলো ফোটাতে চলছেÑতখনই একদিন অনাহুতের মতো লায়লা নামের এক যাত্রার মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে হাজির হয় হারুন। স্বামীর এই অপকর্ম কোনভাবেই মানতে পারেনি নাসরিন। তাই মেয়েকে নিয়ে শিক্ষক পিতার ঘরে চলে আসার কিছুদিন পরই হারুনকে ডিভোর্স লেটার পাঠায় নাসরিন।

যথেষ্ট রুপসি ছিল বলে দ্বিতীয় বিয়ের অনেক প্রস্তাব আসতে থাকে নাসরিনের। কিন্তু সে আর বিয়ে করবে না বলে জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। অদিতিকেই নিয়ে তার ভবিষ্যতের পথচলাÑএই বানী সকল পাত্র পক্ষকে জানিয়ে বিয়ের সম্বন্ধ বাতিল করে দেয়।

২.

দেখতে দেখতে জীবনের পথ অনেকটা পাড়ি দিয়ে এসেছে নাসরিন। অদিতি বড় হতে থাকে। মেয়েকে নিয়ে নাসরিনের চোখ ভরা স্বপ্ন। ডাক্তার বানাবে।

হারুন এতটাই নিষ্ঠুর আর নির্দয় হয়ে ওঠে যে মেয়ের একটিবারও খবর নেয়নি। মেয়ে কি সুখে আছে না আছে, সেগুলোর প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে যাত্রার সেই লায়লা নামের মেয়েকে বিয়ে নতুনভাবে সংসার পাতে।

কিন্তু দ্বিতীয় সংসারে অশান্তি ছাড়া সুখ পায়নি হারুন। পারিবারিকভাবে লায়লা যাত্রাদলের নর্তকী বলে প্রায়ই তাকে যাত্রাদলে অংশ নিতে হয়। কিন্তু লায়লার সেই কাজটা কখনো ভালো লাগে না হারুনের। ফলে দাম্পত্য জীবনে নানান কলহ বৃদ্ধি পায়। বিয়ের আগে লায়লা যাত্রাদলে কি কি অপকর্ম করতো, কতজনের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিলÑসব গোপন খবর হারুনের কানে ঢুকিয়ে দেয় লায়লার নিন্দুকেরা। ফলে স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে হারুন। লায়লা যখন বুঝতে পারলো হারুনের কাছে দিন দিন সে অবহেলিত হয়ে উঠছে, তখনই সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। অনেক কৌশল করে হারুনের বিষয় সম্পত্তির পাঁচ শতাংশ নিজের নামে লিখে নিয়ে এক সময় নাসরিনের মতই হারুনকে ডিভোর্স দেয়। দুই স্ত্রীর কাছে ব্যর্থ হয়ে জীবনের প্রতি অনেকটা আস্থা হারাতে বসে হারুন। কিন্তু মদ গাঁজা আর জুয়া খেলা তাকে নতুন জীবনের হাতছানি দিয়ে প্রতিনিয়ত ডাকতো।

বার্ধক্যজনিত রোগে মতিউর রহমানও মারা গেলেন। বাবার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়ে হারুন। জুয়া খেলার প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে দিন দিন বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা পয়সা যা পায়, সব জুয়ার পেছনে খরচ করে ফেলে।

সম্পত্তি বিক্রি করতে করতে এক সময় সেটা শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়ে পথের ভিখারির মতো জীবন যাপন শুরু করে হারুন।

৩.

নাসরিন একদিন সকাল বেলা উঠোনে যে মানুষটিকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে, সে মানুষটি স্বয়ং হারুন। চেহারার এই বেহাল দশা দেখে নাসরিন অবাক না হয়ে ধীর কণ্ঠে বললÑ‘তুমি এখানে?’ রুগ্ন কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে নাসরিনের সামনে এসে অপরাধীর মতো নত কণ্ঠে হারুন হারুনের জবাবÑ‘তোমাকে কষ্ট দিয়ে যে পাপ করেছি, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি আজ। আমাকে ক্ষমা করো।’ চোখের পাতা ভিজে আসার আগেই নাসরিন কণ্ঠে প্রতিবাদের ঝড় তোলে বললÑ‘ক্ষমার মালিক আমি না। আল্লাহ। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। দূর হও আমার সামনে থেকে।’

নাসরিনের অবজ্ঞামূলক আচরণে অনেকটা অসহায়ের মতো দেখাচ্ছিল হারুনকে। সে অসহায়ই। সব কিছু হারিয়ে আজ সে নিঃস্ব। তার এই নিঃস্ব পরিস্থিতি আর অসহায় চেহারাটা দেখতে খুব ভালো লাগছে নাসরিনের। সংসার জীবনে যে সুখ সে নাসরিনকে দিতে পারেনি, প্রকৃতি আজ তার বিচার করেছে।

উঠোনে এই সাত সকালে সম্পূর্ণ এক অচেনা লোককে মায়ের সামনে দেখে অদিতি আগ্রহী বলায় বললÑ‘উনি কে মা?’ মায়ের কাছে সঠিক জবাব পাবার আগেই অদিতি দেখলো অচেনা লোকটি হঠাৎ শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বললÑ‘নাসরিন ও আমাদের মেয়ে? আমাদের মেয়ে বড় হয়েছে?’ নাসরিন নির্বাক। কিছু বলতে গিয়েও তার গলা থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।

অদিতি মায়ের কাছে এসে খুব ছোট্ট করে বললÑ‘মা, উনার চেহারাটা দেখতে অনেকটা আমার মতো। কে উনি? এই সকালে উনি কোথা থেকে এলেন, কেনই বা এলেন?’ নাসরিন মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না। তার চোখ দুটোতে ক্রমেই পানি চলে আসছে। না, এতটা বছর মেয়েকে চোখের গোপন পানি দেখায়নি নাসরিন। আজও দেখাবে না।

অদিতির হাত ধরে সোজা ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল নাসরিন। বাইরে উঠোনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদছে হারুন। মেয়েকে অকারণে শাসনের মতো গাঢ় গলায় নাসরিন বললÑ‘খবরদার ওই পাপি সম্পর্কে আর একটাও প্রশ্ন করলে আমার মরা মুখ দেখবি।’

অদিতি জানালার কাছে এসে উঠোনের লোকটাকে দেখছে। কি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে লোকটা। লোকটাকে অদিতির বলতে ইচ্ছে করছেÑ‘আচ্ছা আপনি তো দেখতে আমার ম..। আপনি আমার বাবা?’