হানিফ ওয়াহিদ

রেডি হয়ে বেরুতে যাবে, নাসরিন পেছনে থেকে ডেকে বলল, তোমার টাই বাধা ঠিক হয় নাই ।

রানা নাসরিনের কাছে গেলো, হাসি মুখে বলল, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো কিছু খেয়াল রাখো কীভাবে?

নাসরিন কিছু বলল না, শুধু ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো।

নাসরিনের বিয়ে হয়েছে চার বছর। বিয়ের পর তিন বছর ভালোই কাটলো, এরপর থেকে অসুখ হওয়া শুরু হলো। সর্বশেষ এক বছর আগে জানা গেল তার দুটো কিডনি নষ্ট।

এখন চলছে ডায়ালিসিস করে। তাদের টাকা পয়সার অভাব নাই। নাসরিনের বাবা মেয়েকে বাঁচানোর জন্য হন্যে হয়ে কিডনি খুঁজছেন।

এই এক বছরে অনেক বদলে গেছে রানা। বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত। স্ত্রীকে সময় দেওয়ার কথা সে চিন্তাও করে না। সে যে অপাঙক্তেয় হয়ে গেছে, তা তার আচরণ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু দেখা হলে এমন একটা ভাব নেবে, যেন স্ত্রী তার জানপ্রাণ। রানা জানে না, মেয়েদের একটা তৃতীয় নয়ন থাকে, সে নয়ন ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়।

রানা স্ত্রীর হাত ধরে বলল, আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই লক্ষীটি? নাসরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। রানা বেরুতে বেরুতে বলল, চিন্তা করো না, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, অচিরেই আশা করছি একটা কিডনি পেয়ে যাবো।

বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো রানা, সামনে দেখা হয়ে গেল রিমার সাথে। সে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, রিমা এখানে কী করছে?

এক সময় রিমা ছিল তাদের কলেজের ক্রাশ। মোহনীয় সুন্দরী। কলেজের এমন কোন ছেলে ছিল না, যে রিমার প্রেমে পড়েনি। সে কাউকে পাত্তা দিতো না, গরীব ঘরের মেয়ে হয়েও তার চলন বলনে একটা আভিজাত্য ধরে রাখতো।

রানা ছিল সেই কলেজের নামকরা ছাত্র। টাকা পয়সাও কম ছিল না,সে বহুবার রিমাকে প্রপোজ করেছে, পাত্তা পায়নি। এক সময় রিমাকে পাওয়ার জন্য সে পাগল ছিল। এক দিনের জন্য হলেও রিমাকে চাই। সে বহুদিন রিমাকে কল্পনা করে নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছে। বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন কৌশলে সে রিমাকে পেতে চেয়েছে।

সে তাকে নিয়ে বাজে চিন্তা করতো, তা কি রিমা বুঝে ফেলেছিল? রিমার কাছে পাত্তা না পেয়ে পরিবারের পছন্দের মেয়ে নাসরিনকে বিয়ে করেছে সে। স্ত্রীকে নিয়ে সে সুখী নয়। রাতে স্ত্রীকে যখন কাছে না পেয়ে ব্যর্থ হয়, তখন চোখের সামনে রিমার মুখ ভেসে ওঠে।

অনেকেই বলে, রিমা মেয়েটা নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।

কানাঘুষা শোনা যায়, সে আজকাল রাত করে বাড়ি ফেরে। ঠাটবাট আগের মতোই আছে। আরেকবার কি চান্স নেওয়া যায়? রিমাকে একবার কাছে পেলে জীবনের সব হাহাকার দূর হয়ে যাবে।

রিমা কি রাজি হবে?

অন্যদিন দেখা হলে পাত্তা দেয় না, আজ নিজ থেকেই এগিয়ে এলো, রানার চোখে চোখ রেখে বলল, আপনি যা চাইছেন তা পাবেন।

মনে হলো ভুল শুনছে সে। তার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো। সে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, রিমা তার হাতে ধরা দিবে? এতদিন পর? তাহলে কি এটাই সত্যি, মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেছে?

রিমা বলল, আপনার আশা পূরণ হবে, তবে আমার একটা শর্ত আছে।

রানা বলল, তোমার সব শর্ত পূরণ করতে রাজি। কি শর্ত বল। রিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমাকে টাকা দিবেন তিন লাখ।

রানার চোখ কপালে উঠে গেলো। তিন লাখ! এক রাতের জন্য মেয়েটা তিন লাখ চাইছে! অবিশ্বাস্য! রানা কিছু বলতে চাইছিল, রিমা সামনে এগুতে এগুতে বলল, যদি রাজি হন তাহলে কালকের মধ্যে আমাকে টাকাটা দিবেন।

রানা রিমার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল, রিমা একটা কাগজ রানার হাতে দিয়ে বলল, এখানে আমার মোবাইল নাম্বার আছে, রাজি হলে জাস্ট আমাকে একটা কল দিবেন।

রিকশা নিয়ে চলে গেল রিমা। পিছনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রানা।

অফিস এসে রানা কাজে মন দিতে পারলো না, শুধু রিমার কথা মনে হলো। তার কোন তর সইছে না, ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ছুটে যেতে। টাকা তার কোন কমতি নেই। শুধু রিমার মতো একটা মেয়ে কাছে পাওয়ার আকুতি তার। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা টাকার কাছে বিক্রি হলো? অবশেষে তার ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে? কিন্তু রিমা তার ইচ্ছার কথা জানলো কেমন করে?

আসলেই কি মেয়েদের একটা তৃতীয় নয়ন থাকে, যা দিয়ে তারা লম্পট পুরুষ চিনতে পারে?

সে কাগজটা হাতে নিয়ে রিমার নাম্বারে ফোন দিয়ে বলল,আমি তিন লাখ দিতে রাজি।

রিমা বলল, নগদ টাকা দিবেন। নগদই পাবে, কবে চাও টাকা? আজ হলে ভালো হয়। সমস্যা আছে? আজই পাবে, কোথায় আসবো, বল। আমার বাসায় চলে আসুন।

অবাক হলো রানা। সরাসরি বাসায়! ওকে, আমি এক্ষুনি আসছি।

রানার হাত পা কাঁপতে লাগলো, অবশেষে সে পেতে চলেছে, আজই! গাড়ি নিয়ে বিশ মিনিটের মাথায় রানা রিমার বাসায় পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখে রিমা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিমাকে সামনে পেয়ে টাকার বান্ডিলটা তার হাতের সামনে এগিয়ে দিল। সে ছো মেরে বান্ডিলটা তার হাতে নিয়ে নিল। রিমা টাকার বান্ডিল নিয়ে একটা ঘরে প্রবেশ করল। রানা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার পিছনে পিছনে গেল। ঘরে শুয়ে আছে একজন বয়স্ক অসুস্থ রোগী।

রিমা তার অসুস্থ বাবার মাথার কাছে গেলো, তারপর ফিসফিস করে বলল, ভয় নেই বাবা, টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। টাকার জন্য আর তোমাকে মরতে হবে না, কালই তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেব। সামান্য তিন লাখ টাকার জন্য আমার বাবা মারা যাবে তা হতে পারে না। বাবা, এই লোকটা মহৎ, আমার একটা কিডনির বিনিময়ে তিনি তিন লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছেন।

রানা স্তব্ধ হয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। রিমার বাবা পাশ ফিরে মেয়ের দিকে তাকালেন, কোনো কথা বলতে পারলেন না। শুধু চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো।