জয়নুল আবেদীন আজাদ

মানুষ তো আপন প্রয়োজনে সমৃদ্ধ জীবনযাপনের লক্ষ্যে সমাজবদ্ধ হয়েছে। যে কোনো উন্নত সমাজে, মানবিক সমাজে মানুষ সৃষ্টিশীল হয়, সংস্কৃতিমান হয়। এ প্রসঙ্গে দর্শন এবং সাহিত্য ভাবনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাহিত্য তো নানা রস নিয়ে কথা বলে, কাজ করে। সেই নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়ে যাওয়ার আগে আমি আরো মৌলিক কিছু বিষয়ে কথা বলতে চাই। এই যে আমি কথা বলছি, আমি তো একজন মানুষ। মানুষ কি সৃষ্টি নাকি স্রষ্টা? যদি মানুষ সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে তার একজন স্রষ্টা আছেন। আমরা যখন সৃজনকর্মে ব্যস্ত হবো, তখন স্রষ্টা এবং মানুষ বিষয়ে আমাদের ভাবনার কি কোনো প্রয়োজন নেই? আমার মনে হয়, স্রষ্টা সম্পর্কে যেমন ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি মানুষের নিজের সম্পর্কেও ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।

এই সূচনার পরে যে বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলতে চাই তা হলো সাহিত্য কর্ম। আমি আজকে বিস্তীর্ণ আলোচনায় যাবো না। যারা সাহিত্যকর্মে যুক্ত আছেন, যারা সাহিত্য নিয়ে ভাবেন, তাদের সামনে কিছু প্রশ্ন রাখবো। আপনারা এনিয়ে ভাববেন এবং স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করবেন সৃজনে, বক্তব্যে এবং বিতর্কে। এই যে সাহিত্যকর্ম, এটা কি আসলে কোনো সৃষ্টি নাকি অনুকৃতি, না অনুবাদ, না ইমিটেশন? সাহিত্যিক যখন প্রকৃতি নিয়ে লেখেন, আকাশ নিয়ে লিখেন, সমুদ্র নিয়ে লেখেন, জীববৈচিত্র‍্য নিয়ে লেখেন; তিনি কি আসলে কিছু সৃষ্টি করেন, নাকি অনুবাদ করেন? এটা কি সৃষ্টি নাকি অনুকৃতি। সৃষ্টি তো স্রষ্টাই করেন। স্রষ্টার সেই সৃষ্টিকে নিয়ে মানুষ যখন সাহিত্যকর্ম করে, আমার বিবেচনায় সেটা আসলে সৃষ্টির অনুবাদ, সেটা ইমিটেশন, সেটা অনুকৃতি। এখানে মানুষের এবং সাহিত্যিকের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এ সীমাবদ্ধতাকে আমরা কি উপলব্ধি করি? এখানে এ প্রশ্নটি আমি রাখতে চাই। সাহিত্য বিষয়ে অনেক কথা আছে। সেখানে দর্শনের প্রসঙ্গ চলে আসে, জীবন চেতনার প্রসঙ্গ চলে আসে, সেই বিস্তৃত অঙ্গনের কথা আমি এখন বলব না। শুধু কিছু প্রশ্ন রাখবো। যেমন, সাহিত্য কি জীবন জিজ্ঞাসা? মানুষের মন, ইন্দ্রিয়বৃত্তি এবং অধ্যাত্ম যে সত্তা, এগুলো নিয়ে কি সাহিত্যের সমগ্রতা? আরো বিষয় আছে। বুদ্ধিগত সত্যের ধারণা এবং হৃদয়গত সত্যের ধারণা, এ দুয়ের সমন্বয় কি সম্ভব শিল্পবৃত্তে? যদি বুদ্ধিগত বিষয় এবং হৃদয়গত বিষয়ে আমরা সীমাবদ্ধ থাকি, তাহলে প্রশ্ন জাগে রূহ বা আত্মার অবস্থান কোথায়? মানুষ কি শুধুই মস্তিষ্ক ধারণ করে? শুধুই কি হৃদয়বৃত্তি ধারণ করে? তাহলে মানুষের মধ্যে কি রূহ বা আত্মার কোনো অবস্থান নেই? এ বিষয়ে সৃষ্টিশীল মানুষের কি কোনো ধারণা থাকতে নেই? এই যে আমাদের হৃদয় বা হার্ট, আমাদের কল্ব, এ নিয়ে অনেক কথা আছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি, হার্টফেল হয়ে কেউ মারা গেছেন। হার্টের অপারেশন হয়, হার্টের চিকিৎসা হয়, অস্ত্রোপচার হয়। সেটা কোন হার্ট, সেটা কোন হৃদয়? এখানে ব্যাখ্যা আছে। হার্টের, কল্বের বা হৃদয়ের একটা বস্তুগত রূপ আছে, যেখানে অপারেশন করে থাকেন ডাক্তার। হার্টের একটা নৈতিক দিক আছে, হার্টের একটা আধ্যাত্মিক দিক আছে। সে প্রসঙ্গে চলে আসে নফসে আম্মারা, নফসে লাওয়ামা এবং নফসে মুতমাইন্নার কথা। সাধারণত মানুষের মধ্যে যে জৈবিকতা আছে; কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য আছে, এগুলো মন্দ আত্মা বা নফসে আম্মারার কাজ। অধিকাংশ মানুষই নফসে আম্মারা ধারণ করে থাকেন। নফসে আম্মারার যে মন্দ কাজ, সেটা যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে আছে, সেটা তেমনি সৃষ্টিশীল কাজেও আছে। নফসে আম্মারার প্রভাব আমরা বৈজ্ঞানিক কাজেও লক্ষ্য করে থাকি। সাংগঠনিক কাজেও লক্ষ্য করে থাকি। নফসে আম্মারা অর্থাৎ প্রবৃত্তির যে মন্দ তাড়না, সেটা ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর, পরিবারের জন্য ক্ষতিকর, সমাজের জন্য ক্ষতিকর, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। দুষ্ট জ্বীন ও ইনসান ক্ষতির মাত্রা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে অক্লান্তভাবে।

আমরা শয়তানকে ভুলে যাই কিন্তু শয়তান আমাদের ভোলে না। তারা নফসে আম্মারা বা মন্দ আত্মার কর্মকান্ডে সহযোগিতা করে থাকে নানাভাবে, নানা প্রকরণে। এর মধ্যেও সচেতন কিছু মানুষ নফসে আম্মারার যে বিস্তৃত জগত, সেখানে অবস্থান করতে চান না। তাঁরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। তার ভাবেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? এই যে প্রশ্ন করা, দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করা, এটা হল নফসে লাওয়ামার কাজ। যার মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, যার মধ্যে প্রশ্ন আছে সে আত্মা নষ্ট হয়নি, সে আত্মা এখনো জীবন্ত আছে। নফসে লাওয়ামার যে দ্বন্দ্ব, যে সংঘাত, যে জেহাদ, সেটা বেশ প্রাণবন্ত। সচেতন মানুষের এইযে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, জিহাদ তা হয়ত একটা পর্যায়ে এসে নফসে মুতমাইন্নার সমুন্নত জগতে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। নবী-রাসূলদের অবস্থান কিন্তু নফসে মুতমাইন্নায়। তাঁদের আত্মা প্রশান্ত। তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তাঁরা শান্ত, সমাহিত। তাঁরা প্রশান্ত। তাঁদের সাথে কথা বললে জ্ঞান পাওয়া যায়। তাঁদের জীবন থেকে উদ্দীপনা পাওয়া যায়। নফসে মুতমাইন্নার যাঁরা লোক তাঁরা অস্থির নন, তাঁরা শান্ত, তাঁরা কোমল, কিন্ত তাঁরা চিরবিপ্লবী। তাঁরা দোদুল্যমান নন। এই যে নফস, এই নফসের তারতম্যের কারণে মানুষ মন্দ হয়, মানুষ সংশয়বাদী হয়। মানুষ হতাশ হয়, মানুষ দ্বন্দ্ব করে, মানুষ ‍যুদ্ধ করে। আবার এখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে যারা নফসে মুতমাইন্নার পর্যায়ে পৌঁছে যান, তাঁরা সমাজকে, বিশ্বকে আলোকিত করেন। শান্তি, সমৃদ্ধি, মুক্তির পথ দেখান। এই যে আমার নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্ব, আমার নিজের ত্রিবিধ পরিচয়Ñ নফসে আম্মারা, নফসে লাওয়ামা, নফসে মুতমায়িন্না; একজন সাহিত্যিক যখন এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাববেন, তখন এই ভাবনা তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হবে, ব্যক্তিচরিত্রে প্রতিফলিত হবে, পরিবারে, সমাজ-পরিবেশে প্রতিফলিত হবে। এ জাতীয় একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস যদি তিনি রচনা করেন, সেই গ্রন্থটি পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে।

এই যে আমি নফসের কথা বললাম, ত্রিবিধ নফসের অবস্থানের কথা বললাম, সাহিত্য জগতে কি এর কোনো গুরুত্ব নেই? যদি গুরুত্ব থেকে থাকে তবে প্রশ্ন জাগে, আমাদের সাহিত্য এখন কোন পর্যায়ে? আমরা কি স্রষ্টা হয়ে গেছি সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে? নাকি এখনো আমরা সৃষ্টি। যদি আমরা মানুষ হয়ে থাকি, তাহলে অবশ্যই আমাদের অবস্থান এখনও সৃষ্টির মধ্যে। নফসে মুতমাইন্না বা প্রশান্ত আত্মার মানুষ এখন খুবই কম। পাশ্চাত্য সভ্যতার শাসনে আমরা শাসিত। আমরা অনেকেই দিকহারা, দিশেহারা। আমরা এখনো অনুকরণ করি, অনুসরণ করি। বর্তমান সভ্যতায় অর্থসম্পদে, পারমাণবিক অস্ত্রে, পৃথিবী শাসনের যে ব্যবস্থাপনা, সে ব্যবস্থাপনায় না থাকার কারণে আমরা ভাবি, পাশ্চাত্য বা ইউরোপ যেটা ভাবে সেটাই সঠিক, আমাদের সেটাই অনুসরণ করতে হবে। এই যে পরানুকৃতি, এই যে অনুসরণ, এটা কি কোনো স্বাধীন ব্যক্তি, স্বাধীন সমাজ, স্বাধীন জাতির জন্য সম্মানের বিষয়; না লজ্জার বিষয়? এ ভাবনা আমাদের সাহিত্য জগতে কেন লক্ষ্য করা যায় না? এটা কি সমালোচনা করার মতো বিষয় নয়? এখানে আরেকটা বিষয় উচ্চারণ করতে চাই। তাজকিয়াতুন নফস বা আত্মশুদ্ধির প্রসঙ্গ। আত্মশুদ্ধির প্রসঙ্গটি এতটাই মৌলিক, সেটা ব্যক্তি জীবনের জন্য প্রয়োজন, দাম্পত্য জীবনের জন্য প্রয়োজন, সামাজিক জীবনেও প্রয়োজন, রাষ্ট্রীয় জীবনেও প্রয়োজন। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে যে জিওপলিটিক্স বা ভূরাজনীতির কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও প্রয়োজন। তাজকিয়াতুন নফস বা আত্মশুদ্ধির বিষয়টি যদি আমাদের জীবন যাপনের সাথে সম্পৃক্ত থাকত, তাহলে আমাদের সংসার ভাংতো না। পরকীয়ার অভিযোগ পাওয়া যেত না। সামাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ হতো। নাহ্, তেমন বাস্তবতা তো আমরা লক্ষ্য করছি না। ৫ই আগস্টে ছাত্রজনতার যে গণঅভ্যুত্থান, তারপরে ফ্যাসিবাদী সরকারের দুর্নীতির যেসব চিত্র উঠে আসছে গণমাধ্যমে, তা পাঠে আমি লজ্জিত হই। লজ্জিত হই। ফ্যাসিবাদী আমলে সমাজে, রাষ্ট্রে এই জাতীয় লুণ্ঠন কিভাবে হলো? ফ্যাসিস্ট আমলে প্রশাসন কাঠামোয় যারা ছিলেন; যাদের রাষ্ট্রের অর্থ, জনতার সম্পদ পাহারা দেয়ার কথা, তারা তার পরিবর্তে মানুষের সম্পদ, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। ফলে জনতার পকেট শূন্য। প্রসঙ্গত একটা কথা বলতে চাই, যদি কোথাও এক হাজার টাকার দুর্নীতি হয়, সে এক হাজার টাকা কিন্তু জনতার পকেট থেকে যায়। তাজকিয়াতুন নফস বা আত্মশুদ্ধির বিষয়টি যদি আমাদের ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় থাকত, তাহলে হয়ত এমন বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা হতাম না। তাই নফসের বিষয়টি, রূহের বিয়ষটি শুধু আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, এটি বাস্তব বিষয়ও বটে। তাজকিয়াতুন নফসের যে কাজটি নাবী-রাসূলগণ করে গেছেন, গুরুত্বের সাথে করে গেছেন; সেই আত্মশুদ্ধির কাজটি না হলে, ব্যক্তি কিভাবে সুন্দর হবে, দাম্পত্য জীবন কিভাবে আস্থায় বিশ্বাসে সুখে গড়ে উঠবে, সমাজ কিভাবে কেয়ারিং সোসাইটি হবে, দরদী সমাজ হবে, রাষ্ট্র কিভাবে জনকল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবেÑ এই প্রশ্ন তো জাগতেই পারে। আমরা যদি বস্তুবাদি হয়ে ভোগলিপ্সায় ব্যস্ত থেকে নগদ প্রাপ্তিকে মুখ্য ভেবে নেই, তাহলে আমরা কি করে মানুষ হবো, সমাজ কি করে মানবিক হবে? বর্তমান সময়ে একটি বিষয় বেশ উচ্চারিত হয়, সেক্যুলার সমাজ। এই সেক্যুলার শব্দ বা সমাজের বাখ্যা একরকম নয়। একেকজন একেক প্রয়োজনে, একেক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকেন। সেক্যুলারিজম শব্দের সুনির্দিষ্ট একটি অর্থ আছে। সেটা হলো ইহলৌকিকবাদিতা। একজন মানুষ যখন ইহলৌকিকবাদী হবে, তখন তার লক্ষ্য এবং দৃষ্টির সীমানা সংকীর্ণ হয়ে যাবে। পৃথিবী আমার শুরু, পৃথিবীই আমার শেষ। যেকোনো ভাবে আমি অর্থ সংগ্রহ করব। দুর্নীতির মাধ্যমে হলেও, জুলুমের মাধ্যমে হলেও আমি অর্থ সংগ্রহ করব এবং ভোগ করব। সেই ভোগে নৈতিকতা কতটা থাকে, সেই ভোগের ফলাফল কেমন হয়, এই প্রশ্ন বোধহয় করাই যায়। আর আমরা যদি সেক্যুলার বা ইহলৌকিকবাদি না হয়ে পরকালে বিশ্বাস করি, পরকালে বিশ্বাস কিšুÍ আমাদের এই জাপিতজীবনে পৃথিবীকে, ইহকালকে গুরুত্ব না দিতে বলেনি, আমরা ইহকালকে গুরুত্ব দেবো। পৃথিবীতে স্রষ্টা যে বস্তুগুলো আমাদেরকে দিয়েছেন, প্রকৃতি দিয়েছেন, খনিজ সম্পদ দিয়েছেন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়েছেন; এগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা প্রগতিশীল হবো, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। সাথে আমাদের মধ্যে বন্টনের ইনসাফ থাকবে। প্রবৃদ্ধি শুধু সরকারি ঘরানার লোকদের জন্য নয়, প্রবৃদ্ধি শুধু চাটুকারদের জন্য নয়, প্রবৃদ্ধির যে ফলাফল সেটা দেশের নাগরিকদের সকলের ঘরে যেতে হবে। এমন ভাবনার জন্য, এমন ভাবনায় কথা-কাজে মিল থাকার জন্য তাজকিয়াতুন নফস খুবই জরুরী বিষয়। তাহলে এখনো কি আমরা বলব, তাজকিয়াতুন নফস শুধু একটি আধ্যাত্মিক শব্দ? এটি জীবন যাপনের সাথে প্রসাঙ্গিক নয়? এমন ভাবনা বোধহয় সংগত নয়, যৌক্তিকও নয়।

বর্তমান সময়ে যারা সাহিত্য চর্চা করছেন তারা অনেকেই বলেন, ইউরোপীয় রেনেসাঁর পরে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হচ্ছে, সাহিত্যের দিগন্ত বিস্তারিত হয়েছে। এ ভাবনা তো অনেকের কাছে আছে। আমাদের প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যখন আমরা বাংলা সাহিত্যের কথা বলি, তখন আবার বাংলার নবজাগরণের কথা চলে আসে।

কলকাতাকেন্দ্রিক যে বাংলার নবজাগরণ, সেটা ইউরোপীয় প্রভাবে প্রভাবিত। ইউরোপীয় যে রেনেসাঁ সেই রেনেসাঁর প্রভাব যখন কলকাতাকেন্দ্রিক টাওয়ার বাংলায় এসে পড়ে, তখন কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের একটি রূপ আমরা লক্ষ্য করি। আরেকটি রূপ হলো খামার বাংলার। যেটা আমাদের কৃষি বাংলা। যেটা এখন আমাদের প্রিয় স্বদেশ। যে রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। আমরা যদি তথ্যভিত্তিক কথা বলি, তাহলে এই জনপদের যারা মানুষ, তাঁদের নৃতাত্বিক যে বিকাশ, তাঁদের যে ধর্মবোধ, ইতিহাস সচেতনতা, আশা-আকাঙ্খা, এগুলোর একটু খোঁজ-খবর নিতে হবে। এটা তো সত্য যে, এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম। আরো আছেন, আমাদের এই সমাজেরই সম্মানিত নাগরিক হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান। এর বাইরেও রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। সবার কথা আমাদের ভাবতে হবে। আমি একটি ধর্মে বিশ্বাস করি, আমার একটি জীবন দর্শন আছে। তার অর্থ এই নয় যে, একটি দেশের, একটি রাষ্ট্রের সবাইকে আমার ধর্মমত, আমার জীবনদর্শন গ্রহণ করতে হবে। এটি জাতিরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়। সব দেশেই সংখ্যালঘু একটি জনগোষ্ঠী থাকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জনগোষ্ঠী থাকে। কিন্তু তাঁরা সবাই নাগরিক। তাদের সবাইকে আপন মতে, বিশ্বাসে, বিকশিত হওয়ার অধিকার দিতে হবে। আসলে সেই ব্রিটিশ আমলে, যখন ব্রিটিশ চলে যাবে, তখন একটি প্রশ্ন এসেছিল, এই উপমহাদেশের জনগণের সাংস্কৃতিক রূপ কি হবে? তখন কেউ কেউ বলেছিলেন, এক দেহে লীন হতে হবে, অর্থাৎ, তখনকার বৃহত্তর যে হিন্দু জনগোষ্ঠী, তাদের সংস্কৃতির চেতনায়, ভাবনায় লীন হয়ে এক মহাভারত গঠন করতে হবে। তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মুসলমানরা যে অংশগ্রহণ করেছে, জীবন দিয়েছে, সংগ্রাম করেছে, তা কিন্তু স্বকীয়তা হারিয়ে অন্যের দেহে লীন হওয়ার জন্য নয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বলেছিলেন, একটি দেশে কালচারাল ফেডারেশন হতে পারে, কালচারাল ফিউশন নয়, ফিউশন হলো মিশ্রণ। দর্শনজাত যে সংস্কৃতি সেখানে মিশ্রণ চলে না। সূরা কাফিরূনে আমরা সে পরিচয় জেনেছি, আমার ধর্ম তুমি গ্রহণ করবে না, তোমার ধর্ম আমি গ্রহণ করব না। তুমি তোমার ধর্ম পালন করো। আমি আমার ধর্ম পালন করব। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এই কথাটি বলেছেন যে, কালচারাল ফেডারেশন হতে পারে, কালচারাল ফিউশন নয়। কালচারাল ফেডারেশন হলো, তুমি তোমার ধর্ম-সংস্কৃতি করবে, আমি আমারটা করব। মিশ্রণ বা গোঁজামিলের কোনো প্রশ্ন নেই। এটাই হলো বৈচিত্র‍্য। যারা জ্ঞানদীপ্ত মুসলিম তারা এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে বোঝেন। কারণ, তাদের সামনে ইতিহাস আছে। যারা প্রকৃত মুসলিম তারা ভালোভাবেই জানেন, পথ চলায়, পথ নকশা নির্মাণে যখন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হবে তখন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কাছে যেতে হবে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কাছে যাওয়ার অর্থ হলো, পবিত্র কোরআনের কাছে যাবে, নবীর সুন্নাহর কাছে যাবে। যখন একটি দেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয় যে, কালচারাল ফেডারেশন হবে নাকি কালচারাল ফিউশন হবে? তখন আমরা মদিনা সনদের দিকে ফিরে যেতে পারি। নবী সা. যখন অত্যাচারিত হয়ে, মজলুম হয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন তখন তাঁরা সংখ্যায় কম ছিলেন, অর্থবিত্তে কম ছিলেন। তাদের অস্ত্র-শস্ত্র বা যুদ্ধ উপকরণও তেমন ছিল না। সংখ্যালঘু ‍মুহাজির, এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিভাবে মদিনার নেতৃত্বে এসেছিলেন, এটি একটি অবাক বিষয়। রহস্যের বিষয়ও বটে। ইতিহাস যদি সংক্ষিপ্ত করে বলতে চাই তাহলে এভাবে বলা যায়, নবী সা. এবং কিছু সাহাবী যখন মদিনায় গেলেন, মদিনার চিত্রটা তখন কেমন ছিল? গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। মদিনা তখন প্রায় আশিটি দুর্গে বিভক্ত ছিলো।

আমরা দুর্গের পরিচয় জানি। দুর্গে ভালোবাসার নিবাস হয় না। যুদ্ধের নিবাস। আশিটি দুর্গের যে মদিনা, সে সমাজকে পর্যবেক্ষণ করে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম গুরুত্বের সাথে তিনটি কথা উচ্চারণ করেছিলেন; আমি মদিনায় শান্তি আনব, আমি মদিনায় শুধু ন্যায় নয় অ্যাবসুলেট জাস্টিস - নিরঙ্কুশ ন্যায় আনবো, এবং উন্নয়ন হবে সবার জন্য। দল, মত, ধর্ম, নির্বিশেষে সবার জন্য শান্তি, সবার জন্য নিরঙ্কুশ ন্যায় এবং উন্নয়ন সবার জন্য। এই জাতিরাষ্ট্রের যে দর্শন, যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটাই হলো ইসলামের ‍দৃষ্টিভঙ্গি। তাহলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগটা কেমন হবে? এক্ষেত্রে আমরা মুসলিম সমাজের মধ্যে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করে থাকি। দেখা যায়, যখন কেউ ইসলামের পক্ষে কথা বলেন, তখন তিনি সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন। আবার যখন কেউ ইসলাম বা মুসলামানের পক্ষে কথা বলেন তখন তিনি জাতীয়তাবাদী, মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা বলেন। তাহলে বিজেপি দোষ করল কি? ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা নরেন্দ্র মোদি, তিনি তো একইভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলছেন, যদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলে একটি উগ্র সমাজ বিনির্মাণের কথা বলা হয়, তখন সেটা যদি ভারতে ত্রুটি হয়, তাহলে বাংলাদেশেও যদি আমরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের নামে একটা উগ্র জাতীয়বাদী পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস পাই, তাহলে সেটা কি দোষণীয় হবে না? এখানে আমাদের জবাব কি হবে? আসলে যারা প্রকৃত মুসলিম তাঁরা সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। তাঁরা জাতীয়তাবাদী হতে পারেন না। তাহলে তারা কি হবেন? তারা হবেন বান্দামুসলিম। বান্দা মুসলিমের পরিচয় কি? পৃথিবীর, সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ বান্দা হলেন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। তাঁর পরিচয় নানাভাবে বিধৃত হয়েছে। আমি সেই পরিচয়কে উদ্ধৃত করে আলোচনা দীর্ঘ করতে চাই না। শুধু পবিত্র কোরআনে তার উপাধি কি দেওয়া হয়েছে আমি সেটাই বলতে চাই। পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে বলেছেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। এই শব্দ দুটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। রাহমাতুল্লিল আলামিন, শুধু মানবজাতিকে নিয়ে আলামিন হয় না। এই পৃথিবীর হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আস্তিক, নাস্তিক, সবাইকে নিয়ে কিন্ত আলামিন হয় না, সৃষ্টিজগত হয় না। তাঁরা সৃষ্টি জগতের অংশ হতে পারেন। মানুষের বাইরেও জীব জগতে কোটি কোটি প্রাণী আছে। জীববৈচিত্র‍্য আছে, প্রকৃতি আছে, আকাশ আছে, আঙ্গিনা আছে, বস্তু আছে। এই সব মিলয়ে যে সৃষ্টি জগত, সেই সৃষ্টি জগতের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম হলেন রহমত, এটা স্বয়ং আল্লাহর উক্তি। তাহলে, একজন বান্দা কি করে সাম্প্রদায়িক হবেন। একজন বান্দা কি করে উগ্র জাতীয়তাবাদী হবেন। বান্দা তো স্রষ্টা অনুগত হবেন। বান্দার কাজ হবে বন্দেগী। সে বন্দেগী শুধু মসজিদ, মাদ্রাসা, সিয়াম সাধনা, হজ্জ, যাকাত, এ কয়েকটি কাজেই সীমাবদ্ধ নয়। বান্দা যখন কর্মমুখী হবে, সেটা সাহিত্য অঙ্গন হতে পারে, রাজনৈতিক অঙ্গন হতে পারে, আইন আদালত হতে পারে, কৃষি কাজ হতে পারে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা হতে পারে, ভূ-রাজনীতি হতে পারে। বান্দা যেখানেই কাজ করুক, সেটা হবে বন্দেগীর কাজ। যখন আমরা বন্দেগীর কাজ বলব, তখন সেখানে একটি আদর্শ এবং নীতির প্রশ্ন চলে আসে। অর্থাৎ জাপিত জীবনে বিচিত্র সম্পর্কসূত্রে আমি যে কাজটাই করি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, ব্যবসা, বাণিজ্য, কৃষি, সবজায়গায় আমাদের কাজ হবে বান্দার। অর্থাৎ আমাদের সব কাজই হবে বান্দেগীর।

তাহলে বাংলাদেশে আমাদের যে সাহিত্য হবে, সেটা হবে বন্দেগীর সাহিত্য। সেখানে নফসে আম্মারার, ‘মন্দ আত্মার’ শাসন মানা যাবে না। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা বা উগ্র জাতীয়তাবাদের বার্তা গ্রহণ করা যাবে না। রাসূল সা. শ্রেষ্ঠ বান্দা হিসেবে যেমন সবার জন্য শান্তির বার্তা শুনিয়েছেন, কাজ করে দেখিয়েছেন, আমাদেরও সেটাই করতে হবে। আমি বিশেষভাবে এখানে সাহিত্য ভাবনার কথা বলছি। সাহিত্য জগতে যারা কাজ করবেন, তাঁদের কাজ হবে, তাদের সৃষ্টি হবে, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সবার কল্যাণে। তাঁদের দৃষ্টি শুধু নর-নারীর সম্পর্কসূত্রে নয়, সমাজে যে অসঙ্গতি আছে, জুলুম আছে, ফ্যাসীবাদ আছে, তাঁদের কলম সেখানে পৌঁছাবে। তাঁরা প্রকৃতির বান্ধব হবেন। তাঁরা আফসোস করে শুধু বলবেন না, কার্বনে ভরে গেছে আমাদের আকাশ। এই যে প্রকৃতি বিনষ্ট হচ্ছে, জলবায়ুসংকট হচ্ছে, তাঁদের সাহিত্যে সেই বিষয়গুলো আসবে। তাঁরা চাটুকার হবেন না। তাঁরা অর্থলিপ্সায় নিজেকে বিক্রি করবেন না। সাহিত্যের বিষয় শুধু প্রেম-ভালোবাসার বিষয় নয়, শুধু বিদ্রোহের বিষয় নয়, আমাদের জাপিতজীবন যতটা ব্যাপক, আমাদের দৃষ্টির সীমানায় যে বিষয়গুলো আছে, সব বিষয়ে কলম কথা বলবে, সব বিষয়ে সাহিত্য কথা বলবে। আমরা যখন সাহিত্য রচনা করি, তখন কৃষক নিয়ে কথা বলি, ফসল নিয়ে কথা বলি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও কৃষকদের নিয়ে কথা বলেছেন, কৃষকদের মর্যাদা দেয়ার কথা বলেছেন, তাঁদের অবদান নিয়ে কথা বলেছেন। আমরা তো খুব সহজে বলে থাকি, কৃষক ফসল ফলায়। আসলে কি শুধু কৃষকই ফসল ফলায়? এটা কি পুরো সত্য, নাকি অর্ধ সত্য? কৃষক বীজ বপণ করে, চারা রোপণ করে, চর্চা করে, আগাছা বাছে, কিন্ত কৃষকের এই প্রয়াশেই কি ফসল ফলে? ফসল ফলাতে কি সূর্যের তাপ লাগে না, আকাশের বৃষ্টি লাগে না? সূর্যের আলো কে দেয়, আকাশের বৃষ্টি কে দেয়? বৃষ্টি পরিচালনায় যে ফেরেশতারা দায়িত্ব পালন করেন, সে কথা আমরা কতটা জানি? তাহলে আমরা যদি ফসলের কথা বলি, সেখানে যেমন কৃষকের আবদান আছে, মাটির অবদান আছে, ঠিক তেমনি অবদান আছে আকাশের, সূর্যের, বৃষ্টির। তাহলে আমরা কি পেলাম? আকাশ এবং আঙ্গিনা নিয়ে আমাদের জীবন। ফসল ফলানোর পিছনে যেমন মানুষের অবদান আছে, তার চেয়ে বেশি অবদান আছে স্রষ্টার। তিনি সূর্যালোক দেন, তিনি বৃষ্টির পানি দেন। বৃষ্টি ছাড়া কি ফসল ফলানো সম্ভব সেভাবে? আকাশ এবং আঙ্গিনা নিয়ে যদি আমাদের জীবন হয়, আমাদের ফসল হয়, জীবিকা হয়, তাহলে আমাদের জ্ঞান শুধু মানুষের জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? মানুষের বিদ্যার মধ্যে কেন আমাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকবে? আকাশ থেকে যে জ্ঞান নাজিল হয়েছে, যেটাকে আমরা ওহি বলি, মানব জ্ঞানের সাথে ওহি জ্ঞানের কি সমন্বয়ের প্রয়োজন নেই? আমার তো মনে হয়, বর্তমান সভ্যতার যে সংকট সেটা আকাশ এবং আঙ্গিনাকে সমন্বিত না করার সংকট। মানব রচিত যে জ্ঞান, সেটা আসমানী জ্ঞান বা ওহীজ্ঞানের আলোকে সংশোধিত এবং পরিশুদ্ধ করা সম্ভব। তাজকিয়াতুন নফস, তথা আত্মশুদ্ধি ছাড়া মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা স্পষ্টভাবে বলতে পারি, মানুষ প্রকৃত মানুষ না হলে, অবয়বের মানুষ দিয়ে মানবিক সমাজ নির্মিত হবে না। গাজার যুদ্ধ বন্ধ হবে না। ফ্যাসিবাদ দূর হবে না। আকাশ এবং আঙ্গিনার জ্ঞানের সমন্বয়ে জ্ঞানকে সম্পূর্ণ করতে হবে। তেমনি অবয়বের মানুষকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে, প্রশান্ত আত্মার অধিকারী হওয়ার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হতে হবে। প্রকৃত মানুষই মানবিক সমাজ পরিগঠন করতে পারবে।

আসলে আমি বলতে চাই, বান্দার বন্দেগীর যে সাহিত্য, সেটা হবে বিশ্বসাহিত্য। কিন্ত আমরা মুসলমানরা তো এখন আর নিজেকে সেভাবে প্রকাশ করতে পারি না। নিজের বিশ্বাসের কথা, ঈমানের কথা জ্ঞানদীপ্তভাবে বলতে পারি না। কারণ, আমরা দুর্বল। এর মূল কারণ হলো, আমরা কুরআন চর্চায় দুর্বল। কুরআনিক এবং প্রফেটিক যে নলেজ আছে, যে আলো আছে, সেটা ধারণের ক্ষেত্রে আমরা দুর্বল। আমরা বিভ্রান্ত। আমরা অনেকেই সংশয়বাদী। এমন চেতনার মানুষ তো নিজেকেই পরিবর্তন করতে পারে না, তার কথা ও কাজে মিল থাকে না। সে কি করে সভ্যতায় অবদান রাখবে? সে কি করে বিশ্ববাসীকে পথ দেখাবে? আমরা যদি বিশ্বাসী মানুষ হই, তাহলে শুধু দৃশ্য জগৎ আমাদের সাহিত্যের বিষয় হবে না, অদৃশ্য জগৎও আমাদের সাহিত্যের বিষয় হবে। অদৃশ্য জগৎ কি সত্য নয়? আমাদের চারপাশে কি ফেরেশতা নেই? জ্বীন নেই? পবিত্র কুরআনেতো ‘জ্বীন’ নামেই একটা সূরা আছে। সৃষ্টির শুরুতে আদম আ. এর সাথে যে জ্ঞানের প্রতিযোগিতা হয়েছিলো, নাম বলার প্রতিযোগিতা হয়েছিলো, সেখানে কি ফেরশতা এবং জ্বীনরা ছিলেন না? আরো কিছু শব্দমালা আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই। আমরা আকাশের কথা শুনি। আমরাতো প্রথম আকাশের বৃত্তান্তই এখনও জানতে পারিনি।

আমাদের কুরআন তো সপ্তম আকাশের কথা বলেছে, আকাশের দুয়ারের কথা বলেছে, মেরাজের কথা বলেছে, সিদরাতুল মুনতাহার কথা বলেছে, আরশের কথা বলেছে। আমার চারপাশে শুধু কোনো কোনো জ্বীন নয়, ফেরেশতারাও আছেন। যারা আমার লেখা পড়ছেন, তারা কি সেভাবে বিশ্বাস করছেন যে আমাদের চারপাশে যেমন জ্বীন শয়তান আছে তেমনি ফেরেশতাও আছেন? কাঁধের দুই ফেরেশতাই শুধু নয়, আরো প্রচুর ফেরেশতা আছেন। যদি আপনি কোরআনিক ভার্সনে যান, তাহলে অবশ্যই উপলব্ধি করবেন, এই পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যত, তার চাইতে অনেক অনেকে বেশি ফেরেশতার সংখ্যা। কিন্ত এটা অদৃশ্য জগত। আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো, আমরা ঈমানের কথা বলি, কিন্ত আমরা বিশ্বাস করি শুধু দৃশ্য জগতে। অদৃশ্য জগতের কথা সেভাবে বিশ্বাস করি না। তাহলে আমাদের সাহিত্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হবে কেমন করে? যদি আমরা প্রকৃত বান্দা হই, জ্ঞানদীপ্ত মুসলিম হই, তাহলে আমাদের সাহিত্যে যেমন দৃশ্যজগতের কথা আসবে, তেমনি আসবে অদৃশ্য জগতের কথাও।

আমাদের সাহিত্যে যেমন ইহকালের কথা আসবে, তেমনি আসবে পরকালের কথাও। সৃষ্টির শুরু থেকে নবী এসেছেন, শেষ নবী মুহাম্মদ সা., তিনি কথা এবং আচরণের মাধ্যমে সেই একই সত্য প্রকাশ করেছেন, যে অভিযাত্রা আদম আ. থেকে শুরু হয়েছে। তাঁদের কথা একরকম কেন? তাদের জীবনদর্শন একরকম কেন? কারণ তাদের সোর্স অব নলেজ ওহীর জ্ঞান, সেটা এক স্রষ্টা থেকে এসেছে। আমি আমার কথা এই ছোট্ট পরিসরে আর বাড়াতে চাই না। আমি যে বিশ্বসাহিত্যের কথা বলছি, সেটা হবে বান্দার বন্দেগীর সাহিত্য। পরিশেষে আবারো উচ্চারণ করছিÑ বিশ্বাসী মানুষ, ঈমানদার মানুষ, যে মুসলিম হবে, সে সাম্প্রদায়িক হবে না, সে জাতীয়তাবাদীও হবে না। সে হবে বান্দা। একমাত্র স্রষ্টার আনুগত্যই তাঁর কাজ, বন্দেগীই তাঁর কাজ। সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গনে সে দৃশ্য জগতের কথা বলবে, অদৃশ্য জগতের কথাও বলবে, সেখানে বান্দার ভাবনা ফুটে উঠবে। আমার মনে হয়, বর্তমান সময়ে এটা খুবই প্রাসঙ্গিক ভাবনা, খুবই সংগত সাহিত্য ভাবনা।