মীম মিজান
মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি (১২০৭-১২৭৩) সারাবিশ্বে প্রেম ও প্রজ্ঞার বাহক নামে খ্যাত। সে প্রেম খোদাপ্রেম। খোদায় লীন হয়ে যাবার প্রেম। খোদা বা আল্লাহতায়ালাকে ভালোবাসা হচ্ছে একজন মুমিনের প্রথম কাজ। আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসলে যে ভক্তি ও পবিত্র অনুভূতি হৃদয়ে জাগরূক হয় তা পৃথিবীর মোহ থেকে প্রেমিক হৃদয়কে বিচ্ছিন্ন করে। আল্লাহতায়ালাকে ভালোবাসার জন্য তাঁর রাসুলকে ভালোবাসতে হয়। কেননা, আল্লাহতায়ালা নিজেই কুরআনে বর্ণনা করেছেন যে, হে নবি! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে তোমরা আমার আনুগত্য করো, আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহতায়ালাও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। -সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আবার ঘোষণা দিচ্ছেন যে, তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তার রাসুল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে।-সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৫৫
অর্থাৎ আমাদেরকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে যদি নিজের জীবন, সম্পদ বা সন্তানসন্ততির ওপরে স্থান দিতে না পারি তাহলে পূর্ণ ইমানদার হওয়া সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) নিজেই বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে অধিক প্রিয় না হই। -বুখারী: ১৫; মুসলিম: ৬৯
সুতরাং আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে সবার আগেই ভালোবাসতে হবে। আল্লাহতায়ালার পূর্ণ পরিচয় ইসলামের সামগ্রিক বিষয়তো কুরআনে অতি উত্তমরূপে লিপিবদ্ধ আছে। আবার রাসুল (সা.) এর আদর্শ জানতে হলে কুরআন পাঠ আবশ্যক। কেননা, যখন মা আয়েশাকে (রা.) রাসুল (সা.) এর জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো তখন তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ স্পষ্ট করে কুরআনের কথা বলেছেন। হাদিসটি হচ্ছে, সাঈদ ইবনে হিশাম থেকে বর্ণিত যে, আমি আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলাম যে নবি করিম (সা.) এর চরিত্র কেমন ছিল? তিনি বললেন, ‘নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চরিত্র ছিল কুরআন’। -মুসলিম: ১৭৭৩
তাহলে মুসলিম প্রসঙ্গে কুরআন সন্দেহাতীত প্রথম অনুষঙ্গ। আর সেই অনুষঙ্গকে বা প্রামাণ্য দলিলকে মাওলানা রুমি দীর্ঘ সময় নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। এবং অধ্যয়নের ফলে সর্বোচ্চ আত্মস্থ করে তার ব্যাখ্যা লিখেছেন। ব্যাখ্যা তাফসির আকারে নয়। কাব্যিক আকারে। কাব্যিক কলায় এমন মনোহর পদ্ধতিতে কুরআনকে ছন্দে ছন্দে বুনেছেন যে, গোটা বিশ্বে তা আজ সমাদৃত। ফারসি ভাষায় কুরআন (কুরআনের ব্যাখ্যা) নামে খ্যাত। বিখ্যাত ফারসি কবি আব্দুর রহমান জামি লিখছেন, মসনভিয়ে মা’নাভিয়ে মওলাভি, হাসত কুরআন দার জাবানে পাহলভি।
অর্থাৎ, ‘মৌলভীর আধ্যাত্মিক মসনভি, পাহলভি (ফারসি) ভাষায় কুরআন’।
এখন আমরা উদাহরণ দিয়ে সে ফারসি ভাষার কুরআন থেকে কিছু কবিতার উদ্ধৃতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করব। প্রথমত তিনি কুরআনের আয়াতের অংশকে কবিতার পঙক্তিতে সরাসরি ব্যবহার করেছেন। যেমন কুরআনের আয়াত, ‘লাইসা লিল ইনসানু ইল্লা মাসায়া’। অর্থাৎ, মানুষ যা চেষ্টা করে তাই পায়। সুরা নাজমের ৩৯ নং আয়াতে মানুষের কর্মের স্বাধীনতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এটিই বলেছেন। আর সেটাই প্রাসঙ্গিক ক্রমে মাওলানা তার মসনভিতে এভাবে কবিতার অংশ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘গদর হিম্মাত বশাদ অন জুহদো দুয়া, লাইসা লিল ইনসানু ইল্লা মাসায়া’ অর্থাৎ ‘মানুষের প্রার্থনার প্রকৃত মূল্য তার সাধনা ও প্রচেষ্টায় নিহিত; কেননা, মানুষের জন্য একমাত্র তার নিজের প্রচেষ্টার ফলই রয়েছে।’
কুরআনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষ। আর সেই মানুষের জীবন, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, সম্পদ সবকিছুই আল্লাহর কাছে তুচ্ছ করে দিলে মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ রূপ পরিগ্রহ করতে পারবে। নইলে শয়তানের খপ্পরে পড়ে জীবনকে বরবাদ করে দিবে। এমনই করে কুরআনে মানুষকে আল্লাহ তায়ালা তাদের জান ও মালকে যে জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন তা উল্লেখ করেছেন। যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘ইন্নাল্লাহাশ তারা মিনাল মু’মিনিনা আনফুসাহুম ওয়া আমওয়ালাহুম বেয়ান্না লাহুমুল জান্নাহ’। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। সুরা তাওবার ১১১ নং আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে নির্দেশ করেছেন। আর পারস্যের জমিনে ফোটা বিশ্ব মাতানো প্রেমের সুগন্ধির চাষী মওলানা রুমি একই প্রসঙ্গ তাঁর মসনভির পঙক্তিতে বুনেছেন এভাবে,
মুশতারি মস্ত আল্লাহুশতারা
হার গমে আজ মুশতারা হিন বারতারা
মুশতারা জু কে জুইয়ানে তুস্ত
অলেমে অগাজ ভা পইয়ানে তুস্ত
অর্থাৎ, আমাদের সত্যিকারের ক্রেতা হলেন আল্লাহ। তাই যে কোনো সাধারণ ক্রেতার (দুনিয়ার চিন্তা-দুঃখের) ঊর্ধ্বে ওঠো। সেই ক্রেতাকে খোঁজো, যে তোমার সন্ধানেই আছে। এই বিশ্বজগতের শুরু ও শেষ তিনিই।
এখানে কি সুনিপুণ বুননে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন রুমি! অর্থাৎ তার মসনভি কুরআনের উত্তম ব্যাখ্যা। আমরা যারা কবিতার পাঠক ও প্রেমিক হৃদয় তাদের জন্য রুমির মসনভি আবশ্যক পাঠ। তাতে হৃদয় খুলে যাবে ও পরিতৃপ্ত হবে। পাশাপাশি শ্রেষ্ঠের প্রেমে লীন হওয়ার পন্থায় এগিয়ে যাবে।
ওয়াদা পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে ইসলাম। আর ওয়াদা খেলাফ করলে খেলাফকারী মুনাফিক হয়ে যান। বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। সমাজে গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। বিশ্বাসহীনতার প্রচলন ঘটে। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ইসলামে ওয়াদা পালনের বিষয়ে জোর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা মায়েদার ১ নং আয়াতে এরশাদ করছেন, ‘ইয়া আইয়ুহাল লাজিনা আমানু আওফু বিল উকুদ।’ অর্থাৎ, হে ইমানদারগণ, তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করো। আবার সুরা বনি ইসরাইলের ৩৪ শীর্ষক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি পালনের বিষয়ে কঠিন হুশিয়ারি দিচ্ছেন এভাবে যে, ‘ওয়া আউফু বিল আহদা কানা মাসউলা।’ অর্থাৎ, অঙ্গীকার পূর্ণ করো। অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এরকম আরও অনেক আয়াত আছে। হাদিসেও নবী করিম (সা.) ওয়াদা পালনের বিষয়ে বারংবার তাগাদা দিয়েছেন। মাওলানা রুমি যেহেতু একজন ইসলামি আধ্যাত্মিক গুরু কবি তাই তিনি তাঁর কাব্যে ওয়াদা পালনের বিষয়গুলিও এনেছেন খুবই সুন্দর করে। যা তাঁর কাব্যকে করেছে ঋদ্ধ। খোদাপ্রেমিদের নিকট করেছে অত্যন্ত পছন্দনীয়। কুরআনের এমনই বিষয়টি তিনি এভাবে বলেছেন,
ওয়দে হ বইয়াদ ওফা কারদান তামাম
ভর না খহিকারদ বশি সারদ ভা খাম
ওয়দে আহল কারাম গাঞ্জ রেওয়ান
ওয়দে না আহল শোদ রাঞ্জে রাওয়ান
দার কালামে খোদ খওয়ান্দ ভা দুদ
আমর ফারামুদে আস্ত আওফা উফু বিল উকুদ
গার নাদরি খোয়ি ইবলিসি বিয়া
বশ মোহকিম বার সার উহদ ভা বফা
যার সরল বাংলা হচ্ছে,
প্রতিশ্রুতি পূরণ করা উচিত সম্পূর্ণভাবে,
অন্যথায়, যদি না করো, হবে শীতল ও অপরিপক্ব।
উদার মানুষের প্রতিশ্রুতি হলো অক্ষয় ধন,
কিন্তু অযোগ্যদের প্রতিশ্রুতি হয়ে ওঠে অন্তহীন কষ্ট।
পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তা নিজ বাণীতে বলেছেন,
“ওফু বিল উকুদ” তোমরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো।
যদি শয়তানের স্বভাব না থাকে তোমার,
তাহলে অটল থাকো অঙ্গীকার ও বিশ্বস্ততায়।
কি সুন্দর করে কুরআনের আয়াতের কিয়দংশ কাব্যে ব্যবহার করেছেন। পাঠক এবং আধ্যাত্মিক সাধকদের বলেছেন প্রতিশ্রুতি পালনের ফলে কী কী উপকারিতা আর পালন না করলে কী কী অপকারিতা।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন যে, প্রত্যেক প্রাণিকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। যাদের প্রাণ আছে তাদের কাছে মৃত্যুর দূত আজরাইল (আ.) ঠিকই পৌঁছে যাবেন। আর আমাদের সবার আগমন হয়েছে আলমে আরওয়াহ থেকে। আবার ইন্তিকালের মাধ্যমে ফিরে যেতে হবে আল্লাহর ঘোষণাকৃত আলমে বারযাখে। ঘুড়ির নাটাই যেমন একজনের হাতে থাকে। আমাদেরও নাটাই রয়েছে মালিকের কাছে। আল্লাহ তায়ালা তেমনটি ঘোষণা দিচ্ছেন যে, ‘আল্লাজিনা ইজা আসাবাতুম মুসিবাহ, ক্বলু ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ অর্থাৎ, তাদের ওপর যখন কোনও বিপাদ-আপদ আসে, তখন তারা বলে যে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য আর তাঁরই নিকট আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। সুরা বাকারার ১৫৬ নং আয়াতের প্রভাব ও ব্যাখা বা ইসলামী অনুষঙ্গ আমরা রুমির মাসনবিতে দেখতে পাই এভাবে,
ওজ মুলকে হাম বইদাম জুসতান যে জু
কুল্লু শাইয়িন হালাক ইল্লা ওয়াজহিহি
বরে দিগার আজ মুলকে কুরবান শাওয়াম
অনচে আন্দার ভা হাম নয়িদ অন শাওয়াম
পআস আদম গারদাম আদাম চোন আরগানুন
গুয়িদাম কে ইন্না ইলাইহি রাজিউন
মারগে দন অনাক ইত্তেফাক এমতুস্ত
কাবে হিওয়ানি নেহান দার জুলমাতাস্ত
অর্থাৎ,
রাজ্য থেকেও আমাদের মুক্তি খুঁজতে হবে প্রবাহ থেকে
সবকিছুই বিনাশশীল, কেবল তাঁর(আল্লাহর) মুখমণ্ডল ব্যতীত।
আরও একবার, আমি রাজ্যকে উৎসর্গ করি
এবং যা কল্পনার অতীত, তাই হয়ে যাই।
তাই আমি বিলীন হই, অস্তিত্বহীন হয়ে বেহালার মতো,
যে বলে, “আমরা তো তাঁরই দিকে ফিরে যাব।”
মৃত্যু সেই সত্য, যেখানে সমগ্র জাতির সম্মতি আছে,
কারণ প্রাণীর জীবন আঁধারে লুকানো।
এছাড়াও মাওলানা রুমির কাব্যে সবিশেষ স্থান লাভ করেছে কুরআনের প্রভাবে আল্লাহর একত্ববাদ, ইউসুফ জুলাইখার কাহিনি, আইউব (আ.) এর ধৈর্যের পরীক্ষা, ইসলামিক শিক্ষা, জিকির, বিশ্ব জগৎ এবং মানুষ সৃষ্টির রহস্য ইত্যাদি। কুরআনের ব্যাখ্যা ও অনুষঙ্গ প্রায় প্রত্যেক কবিতাতে তিনি প্রথিত করেছেন যা তাঁর কাব্যকে ইসমালিক ও কাব্যিক মর্যাদায় দিয়েছে অনন্য উচ্চতা।