মুহাম্মদ ইসমাঈল

সুবর্ণ সকাল, বিষণ্ন রাত আর বিবর্ণ বিকেলের মাসে আমরা অহরহ জীবন খুঁজে ফিরি। জীবনের উত্তাল স্রোতে নির্ঝরা হাসি, নির্মলা সুখ, নির্জলা অনুভূতির গতরে আছড়ে পড়া স্মৃতিময় ঢেউ গুণতে গুণতে কখন যে নাটাইয়ের সুতো ফুরিয়ে যায় তা বলতে পারি না। লাউয়ের ডগা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নোলক পরা সেই বালিকার কথা, যে কিনা রূমালের “মনে রেখো” চিত্রকর্ম সেলাই করে বালিশের নিচে চাপা দিয়ে কত রাত পার করেছে বুকের গভীরে ভালোবাসা রেখে। ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে যে কথা বলতে চেয়েছিলো, তা হয়তো আজও বলা হয়নি। বলা হয়নি সেই রক্তিম সূর্যের কথা, যার আভা ছুঁয়ে গাঙচিল শুভ্র ডানায় বাসন্তি রঙ মেখে হরিৎনীড়ে ফিরে একদণ্ড প্রশান্তি খুঁজেছিল। খুঁজেছিল দুধের শিশু মায়ের বুকে মাথা রেখে অন্নপ্রসাদ। জীবনের স্বাদ নিতে নিতে এক সময় অনন্তকাল কড়া নাড়ে। মাত্র বিয়াল্লিশ বছরের এক প্রতিভাবান সম্ভাবনাময় যুবক। অফুরন্ত প্রাণশক্তি, অদম্য সাহস ও প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এক টগবগে যুবক। ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী। কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, বক্তা, সংগঠক, সম্পাদক ইত্যাদি নানা গুণের মিশেলে গড়া এক অমিত সম্ভাবনাময় যুবক। কিন্তু সম্ভাবনার কুড়ি প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই অকস্মাৎ ঝরে পড়লো।

আহমদ বাসিরের সাথে প্রথম পরিচয় বাংলা সাহিত্য পরিষদে, তারপর প্রত্যাশা প্রাঙ্গণে কবি আফসার নিজাম, মতিউর রহমান মল্লিক, জাকির আবু জাফর একসাথে অনেক কথা ও আড্ডা ছিল। এরপর তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না আমার সাথে। হঠাৎ করে সি.এন.সি এর একটি প্রোগ্রামে দেখা শুধু দেখাই নয় ঐ দিন আহমদ বাসিরের পুরস্কার গ্রহণের দিন ছিল। মাহবুব ভাই আমাকে বললেন ইসমাঈল তুমি কুরআন তেলাওয়াত করবে অর্থসহ। যেই কথা সেই কাজ। আমি আমার কার্য সম্পাদন করলাম। কবিতা আবৃত্তির পালা। আমি “রোহিঙ্গা মেয়ের আর্তনাদ” কবিতাটি পাঠ শেষে আহমদ বাসির আমাকে বললেন- ভাই আপনার সাথে পরে কথা আছে, একান্তে। হাসিমুখে আমার কবিতাটির প্রশংসা করলেন এবং আমাকে উৎসাহ দিলেন।

এরই মধ্যে পুরস্কারের পালা। পুরস্কার হাতে পেয়ে খুশি। খুশিটা বেশিক্ষণ টিকেনি। অবয়বে একটি কালো ছায়া রেখাপাত করলো। কারণ পুরস্কার সনদটিতে একটি ভুল ছিল। এই ভুল নিয়ে পুরস্কারটি নিতে রাজি নয়। মাহবুব ভাই পুরস্কারটি সংশোধন করে আহমদ বাসিরের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন। এই ছিল আহমদ বাসির।

আহমদ বাসির এক তরুণ প্রতিভাবান যুবক। আহমদ বাসির এক স্বপ্নের মধ্যে বসবাস করতো। সৃষ্টিশীল প্রতিভাবানদের সবারই একটা স্বপ্ন থাকে। সে স্বপ্ন একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু সংবেদনশীল প্রতিভাবানদের স্বপ্ন ব্যক্তিকে নয়- দেশ, জাতি ও সমাজকে নিয়ে, শুধু বর্তমানকে নয় ভবিষ্যৎকে নিয়েও। আহমদ বাসিরের এমনই এক স্বপ্ন ছিল। হয়তো তার স্বপ্ন ছিলো জীবনের চেয়েও বড় ও মহৎ। সে স্বপ্নের চূড়া সে স্পর্শ করে যেতে পারে নি, তা অধরাই রয়ে গেছে। তার আকাশস্পর্শী স্বপ্নে রঙিন জগতে নিঃসঙ্গ বসবাস করে সম্ভবত সে সন্তুষ্টই ছিল। সে যা করতে পারতো তা সে সম্পন্ন করতে পারে নি। সেজন্য আমরা যেমন নিদারুণ কষ্টবোধ করছি, যদি তার আরাধ্য কাজ আমরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করি তাহলে তার প্রশান্তআত্মা শান্তি পাবে।

কালশীতে সংকল্প শিশু কিশোরদের নিয়ে সঙ্গীত, আবৃত্তি, অংকনসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার উদ্যোগ ও কাজ প্রশংসার দাবিদার। কবি যে কাজটি করেছেন সে কাজটি অনেকেই করবেন না। তিনি অত্যন্ত মেধা ও ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

কবি আহমদ বাসির বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন তেমনি ছোটদের জন্যও লিখেছেন। বড়দের জন্য “অন্তরঘর” কবিতায় বলেছেন-

যখন গোরস্থানের নীরবতা নেমে আসে লোকালয়ে

তখন সব পথই গন্তব্যহীন হয়ে পড়ে

যখন রাত্রি তার বিষণ্ন পাখা বিস্তার করে

শুয়ে পড়া ধরণীর কোলজুড়ে

পৃথিবী তখন দৈত্যের আস্তানা হয়ে যায়

আর আমাদের শয্যাশায়ী চিন্তা

যখন কোনো জানালাও খোলা পায় না

মনকে মনে হয় তখন

বহুকালের পরিত্যক্ত গৃহের মতই

আমরা এখন

এমনই এক লোকালয়ের ভেতর দিয়ে পথ চলেছি

যেখানে প্রায় সব অন্তরই

একেকটি পরিত্যক্ত গৃহ ব্যতীত আর কিছু নয়......।

(গোপন মাটির বীজতলা)

কবি ছোটদের জন্যও লিখেছেন-

ফুলগুলি পাখিগুলি

নদীগুলি কেনো এতো

মন কাড়ে খোকাটার

মহাকাশে তারা দেখে

চাঁদে আলো ধারা দেখে

কি যে হয় বোকাটার।

মনে তার জিজ্ঞাসা

জেগে ওঠে খাসা খাসা

সে খবর কারো নাই,

সবে শুধু দোষ ধরে

অংকটা আজ তুমি

কষতে যে পারো নাই?

খোকা ভাবে এই সব

ছোট-খাট অংকেতে

নাই কিছু তিপ্তির;

এই মহাবিশ্বের

বড় এক অংকে সে

ছোঁয়া পায় দীপ্তির।

কোনো কোনো মৃত্যু হয়তো পাতাঝরার মতো, আবার কোনো কোনো মৃত্যু বজ্রপাতের মতো। আহমদ বাসিরের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। তবু মেনে নিতে হয়। পৃথিবীতে কেউ থাকবে না। এমনকি আমিও না। এই ক্ষনজন্মা কবি একজন মর্যাদাবান কবির জীবন উদযাপন করেছে। কখনো হতাশ হননি। ছিটকে পড়েননি। আল্লাহ তুমি তাকে জান্নাত দান করো। তার পরিবার স্বজনদের প্রতি জানাই আন্তরিক সমবেদনা।