আসগর মতিন
ভাষাবিদ, গবেষক সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নামটি বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অঙ্গনে একটি অতি উজ্জ্বল নাম। বাংলাভাষায় পরিচয় বিনির্মাণে, ভাষার বিকাশে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় এবং সেই সাথে সাহিত্য রচনা করে অমর হয়ে আছেন তিনি। তাকে এই ক্ষেত্রে একজন তুলনারহিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। শহীদুল্লাহ এমন একজন কীর্তিমান মহান পুরুষ যিনি তার কাজের জন্য উভয় বাংলায় সমানভাবে বরিত ও স্মরণীয় হয়ে আছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তিনি ১৮টি ভাষা জানতেন; ফলে বিভিন্ন ভাষায় সংরক্ষিত জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করে সেখান থেকে মণিমুক্তা আহরণ করে নিজ ভাষাকে সহজেই সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন। জ্ঞানের সাধনায় নিয়ত তৎপর থেকে তিনি জ্ঞানতাপস উপাধি লাভ করেছেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র বহুমাত্রিক অবদানের কারণে বাংলাভাষা ও সাহিত্য দেশে বিদেশে সমাদৃত হয়েছে ও হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের গবেষকরা বলেছেন, ‘বাংলাভাষা ও সাহিত্য তাঁর অবদানে নানাভাবে ঋদ্ধ। বিশেষত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ ছিল তাঁর গবেষক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা বলেন, বাংলা অঞ্চলে প্রচলিত বহু প্রবাদের উৎসস্থল যে চর্যাপদ, তাও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অনুসন্ধানলব্ধ আবিষ্কার। এর ভাষা বিশ্লেষণ করে উদ্ভবকাল সম্পর্কে প্রচলিত বহু ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করে চর্যাপদের বৈজ্ঞানিক-বাস্তবভিত্তিক সময়কাল নির্ধারণ করেন যা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। চর্যাপদের উপভাষার উপর গবেষণার জন্য তিনি ১৯২৮ সালে ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলিম যিনি এই ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তার দেখানো গবেষণার পথ ধরে অসংখ্য গবেষক কাজ করে চলেছেন, বাংলা গবেষণা ঋদ্ধ হচ্ছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে তার পিতার নাম মফিজউদ্দীন আহমদ, যিনি ছিলেন পীর গোরাচাঁদের দরগাহর খাদেম। দরগাহর খাদেম না হয়ে তিনি পৈতৃক পেশা থেকে বেরিয়ে ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ফলে তিনি উক্ত জগতে প্রবেশের সুযোগ লাভ করেন। আর এর ফলে বাংলাভাষা ও সাহিত্য লাভবান হয়েছে। ছোট বেলায় তার জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটার ফলে তিনি ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষা শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন। মনে রাখা দরকার সেই সময়ে বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে খুব বেশি সংখ্যক প্রতিভা উঠে আসতে পারেন নি। এই সময়কালে মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮ - ১৯৬৮), এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০), এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) প্রমুখ ছিলেন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। কাজী নজরুলের আগমন এর পর পরই ১৮৯৯ সালে। শহীদুল্লাহর গ্রন্থাদি প্রকাশিত হতে শুরু করে নজরুলের গ্রন্থ প্রকাশের সমসাময়িককালে ১৯২৩ সালের দিকে। সেই সময়ে কলকাতা থেকে বাঙালি মুসলমান লেখকদের বই প্রকাশ সহজ কাজ ছিল না।
শহীদুল্লাহ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা এবং ১৯০৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান উচ্চ মাধ্যিমিকের সমমান) পাস করেন। এরপর তিনি হুগলি কলেজে পড়াশোনা করেন ১৯০৬-৮৮ পর্যন্ত। কিন্তু অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ (১৯১০) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) পাস করেন। দুবছর পর তিনি বি.এল (১৯১৪) ডিগ্রিও অর্জন করেন।
শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার ব্যাপারে যেমন আগ্রহী ছিলেন আর সেই তাড়না থেকেই মুসলিম হয়েও তিনি সংস্কৃত ভাষা শেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। জানা যায়, ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে বেদ পঠনের অনুমতি দেননি পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী। এই বিতর্ক আদালতেও গড়ায়, পরে দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে ‘ভাষাতত্ত্ব’ নামে নতুন বিভাগ চালু করে সেখানে শহীদুল্লাহকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন তখনকার উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আর বিষয়টি উঠে এসেছে কয়েক বছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায়। এতে বলা হয়েছে, সদ্যপ্রয়াত সুকুমারী ভট্টাচার্য যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, সেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর। মুসলমান বলে শহীদুল্লাহ্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়াতে রাজি হননি সত্যব্রত সামশ্রমী। আর সুকুমারী ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে, সে কেন সংস্কৃত পড়বে? ভাবখানা এই, সংস্কৃত যেন নানা স্রোতে-উপস্রোতে গড়ে ওঠা ভারতীয় জীবনের অঙ্গ নয়, তা কেবল ‘আদি হিন্দুদের ভাষা’। অর্বাচীন মুসলমান আর খ্রিস্টানদের সে ভাষা পড়ার কোনও ‘অধিকার’ নেই। অনধিকারী সংস্কারহীনদের হাতে পড়লে ‘সংস্কৃত’-এর বিশুদ্ধি বিনষ্ট হবে। তাই পড়তে দিয়ো না, ঢুকতে দিয়ো না ‘দেবভাষার দেবালয়ে’, বাদ দাও, বহিরাগত হিসেবে দাগিয়ে রাখ। (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ জুন, ২০১৪)
কিন্তু শহীদুল্লাহ সংস্কৃত নিয়ে পড়েছিলেন আর সেই পড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস ও গতিপথ বিনির্মাণে তার সহায়ক হয়েছিল। সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃত নিয়ে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে তিনিই প্রথম সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে পাস করেন। সংস্কৃতে অনার্স পাস করার পর সংস্কৃত নিয়ে এমএ পড়তে চাইলে সংস্কৃত পণ্ডিতগণ তাঁকে পড়াতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন, সে কথা আগেই বলেছি। ১৯১২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঐ সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম ভাষাতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয়। আর শহীদুল্লাহ ছিলেন ঐ বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯), তারপর চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি চবিবশ পরগনা জেলার বশিরহাটে আইন ব্যবসায়ে (১৯১৫-১৯) নিযুক্ত হন। তিনি একবার বশীরহাট পৌরসভাব ভাইস চেয়ারম্যানর নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহকারী গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ১৯২১ সালে ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯২৬ সালে প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পান এবং ১৯২৮ সালে বৈদিক ভাষা প্রাকৃত ও দোহাকোষ সম্পর্কে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ভাষাতত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও অধ্যাপনার সুযোগ পান।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাজগুলো দু’পর্বে বিভক্ত। একদিকে তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্যের পরিচয় নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন, বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে গবেষণা করেছেন, গ্রন্থ লিখেছেন। আবার কিছু সৃজনশীল কাজ দেখা যায়। সেই সময়ে পাঠ্য বইয়ের সংকট ছিল। সেই সংকট ঘোচাতে তিনি কাজ করেছেন। শহীদুল্লাহ ‘তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব’-এর গবেষণায় খ্যাতি লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য অবদান ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’। এটি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাতাত্ত্বিক গ্রন্থ। এ গ্রন্থে বাংলা ভাষায় অনার্য প্রভাব ও বৈদেশিক প্রভাব সম্পর্কে তিনি সুচিন্তিত আলোচনা করেছেন। তাঁর অপর মূল্যবান গ্রন্থ ‘বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ’। সমালোচকেরা বলেছেন, প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণের অভাব মোচন করার লক্ষ্যে রচিত এ গ্রন্থটি তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক অবদানের আরেক উজ্জ্বল নিদর্শন।
১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ পৃথক হলে তিনি ফ্রান্স থেকে ফিরে এসে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ও রিডার পদে যোগ দেন। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডিন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমীতে যোগ দেন। ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমির ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের সম্পাদক হন। একই সময় এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হওয়ারও গৌরব অর্জন করেন।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ্ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথম উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি জানান। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক (১৯১১) ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন (১৯১৭), ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন (১৯২৬), কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলন (১৯২৮), হায়দ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন (ভাষাতত্ত্ব শাখা, ১৯৪১) এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন (১৯৪৮)।
বাংলা সন সংস্কার তার আরেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আগে বাংলা সনের তারিখগুলো সামঞ্জস্যহীন ছিল। তিনি সেখানে সামঞ্জস্য বিধানে ভূমিকা রাখেন। ড. শহীদুল্লাহ বাংলা সালের তারিখ বিন্যাস চূড়ান্ত করেন। ১৯৬৩ সালে বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস করার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা একাডেমি কর্তৃক একটি কমিটি নির্ধারিত হয়। ড. শহীদুল্লাহ এ কমিটির সভাপতি হন। পরে অনেক গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করে যে পঞ্জিকা চূড়ান্ত করেন, সেটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত এবং সর্বমহলে প্রচলিত। সেটাই দীর্ঘ দিন প্রচলিত থেকেছে। সম্প্রতি সেটার উপর ভিত্তি করে বাংলা একাডেমির করা একটি ক্যালেন্ডার প্রচলিত রয়েছে। এতে বাংলা ও ইংরেজি তথা গ্রেগরীয ক্যালেন্ডারে বিখ্যাত দিনগুলো যেন একই থাকে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সংস্কারের ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি ও রবীন্দ-নজরুলের জন্ম মৃত্যু বার্ষিকীর তারিখগুলো অপরিবর্তিত থাকছে।
গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনাও করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো: সিন্দবাদ সওদাগরের গল্প (১৯২২), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৯৩৬), দীওয়ান-ই-হাফিজ (১৯৩৮), শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), রুবাইয়াত-ই-উমর খয়্যাম (১৯৪২), Essays on Islam (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), পদ্মাবতী (১৯৫০), বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খন্ড ১৯৫৩, ১৯৬৫), বিদ্যাপতি শতক (১৯৫৪), বাংলা আদব কী তারিখ (১৯৫৭), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১৯৫৭), বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৫৯), কুরআন শরীফ (১৯৬৩), অমরকাব্য (১৯৬৩), সেকালের রূপকথা (১৯৬৫) ইত্যাদি। তাঁর সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এক বিশেষ কীর্তি। মুহম্মদ আবদুল হাই -এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত iwPZ Traditional Culture in East Pakistan (১৯৬১) একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর Bud- dhist Mystic Songs (১৯৬০) গ্রন্থটি চর্যাপদের অনুবাদ ও সম্পাদনা কর্ম। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত; এর ধর্মতত্ত্ব নিয়েও তিনি আলোচনা করেন।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে শহীদুল্লাহ্র বহু মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন। আল এসলাম পত্রিকার সহকারী সম্পাদক (১৯১৫) ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক (১৯১৮-২১) হিসেবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দেন। তাঁরই সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশুপত্রিকা আঙুর (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজি মাসিক পত্রিকা দি পীস (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গভূমি (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক তকবীর (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন।
ভাষা ও সাহিত্যের ওপর গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অনেক পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’, ফরাসী সরকার কর্তৃক ‘নাইট অব দি অর্ডারস অব আর্ট লেটার্স’ (১৯৬৭)। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার (মরনোত্তর) ও ২০০২ সালে ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) এ ভ’ষিত করে। এছাড়াও বহু পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিন তিনি। ‘জ্ঞানতাপস’ হিসেবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন স্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। আমরা তার রুহের মাগফেরাত কামনা করি।