বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দিকে দৃষ্টি ছিল বিশ^বাসীর। ১৭ নভেম্বর রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যা, তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তার দোসর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও। তাদের সহযোগী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হয়ে অপরাধ স্বীকার করায় কম শাস্তি পেয়েছেন, আর তা হলো ৫ বছরের কারাদ-। রায়টি ঐতিহাসিক এবং স্বচ্ছ। এমন একটি রায়ের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে। তবে ট্রাইব্যুনালে সরকারের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তিসহ যাদের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়েছে, তারা জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় যুক্ত করে গেছেন। বিস্মিত হতে হয়, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি এক হয়ে কী করে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে এভাবে গণহত্যা চালাতে পারে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান না হলে তাদের হয়তো কিছুই হতো না। কারণ তারা আইন-আদালত, পুলিশ প্রশাসনকে নিজের মতো করে সাজিয়ে রেখেছিলেন। হাসিনা সরকার নিজেদের পরিকল্পনায় বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। সে ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে। তবে সে রায় ছিল অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ। আজ সে ট্রাইব্যুনালেই ফাঁসির দ- পেলেন হাসিনা গং। প্রাসঙ্গিক মনে করে ১৬ মাস আগের একটি লেখা এখানে যুক্ত করলাম।

আমার হাতে বাংলাদেশের বহুল পঠিত একটি জাতীয় বাংলা দৈনিক। পত্রিকাটির ৩০ জুলাই সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় রয়েছে অনেকগুলো শিরোনাম। যেমনÑ ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নিহতদের স্মরণে দেশব্যাপী আজ শোক’, ‘জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ১৪ দলের বৈঠকে’, ‘৬ সমন্বয়ক এখনো হেফাজতে, দেখা করেছেন স্বজনেরা’, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না : হাইকোর্ট’, ‘বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, লাঠিপেটা, আটক’। এ শিরোনামগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা চিত্র উঠে এসেছে। যারা খবরের নিবিড় পাঠক এবং অনুসন্ধানী, তারা হয়তো দেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন। তবে সবার আন্দাজ বা বিশ্লেষণ এক রকম হবে না। রাজনৈতিক বিশ^াস, তথ্যপ্রমাণের রকমফের, বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে তারতম্য সৃষ্টি করতে পারে।

উল্লেখ্য, সব দেশের রাজনীতির যেমন একটা ‘বহির্মহলের’ দিক আছে, তেমনি আছে ‘অন্দরমহলের’ দিকও। দু’মহলের খবরই রাখতে হয়। তবে অন্দরমহলের খবর রাখার কাজটি তেমন সহজ নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এখানেই ঘটে যায় তারতম্য। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদরা দু’মহলের খবরই রাখতে চান, এমন প্রবণতা লক্ষ করা যায় বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। বর্তমান বিশ^ব্যবস্থায় কোনো দেশের রাজনীতি শুধু সে দেশের ঘটনাবলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, অনেক সময় ভূরাজনীতির নায়করা তো অলস বসে থাকেন না। তাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক আছে, কৌশলপত্র আছে, আছে নানা উপায়-উপকরণও। নায়করা নিজ স্বার্থে আগ্রাসন চালানোর জন্য শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকেন। দরিদ্র ও ছোট দেশগুলোর নেতাদের তাই সাবধানে থাকতে হয়, অনেক খোঁজ-খবর রাখতে হয়। সরকারের মন্ত্রী ম-লীর পাশাপাশি বিরোধী নেতাদের কাঁধেও এ দায়িত্ব বর্তায়। তবে এ জন্য প্রয়োজন হয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং আলাপ-আলোচনার পরিবেশ। দেশপ্রেমিক সৎ নেতারা তাই হুট করে কথা বলেন না, আবেগকে ভিত্তি করে চলেন না। দেশের মঙ্গল যেহেতু লক্ষ্য, তাই ধৈর্য ধরতে জানেন এবং সংযত আচরণে পরিশীলিত হন। তবে যারা ক্ষমতার রাজনীতি করেন তাদের কথা আলাদা। তাদের কাছ থেকে জাতি ভালো কিছু আশা করতে পারে না। নীতি এবং নৈতিকতার বদলে কৌশল ও চাতুর্যই তাদের পছন্দের পথ। তারা সন্ত্রাস করবেন, মানুষ মারবেন; আবার জনদরদী সেজে কাঁদবেন তারাই। ফলে রাজনীতির জটিল পথে সৎ ও নীতিবান থাকাই সবকিছু নয়, মন্দ রাজনীতির কুশীলবদের ছল-চাতুরী মোকাবিলার সমর্থও রাখতে হবে। রাজনীতিতে চোখ-কান খোলা রাখার পাশাপাশি বাস্তবতার নিরীখে হিসাব-নিকাশের বিষয়টাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাপনে আবহাওয়ার বিষয়টা যেমন গুরত্বপূর্ণ, রাজনীতিতে ‘সঠিক সময়’ নির্ধারণের বিষয়টিও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। কোটা সংস্কার আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এ আন্দোলন এখনো শেষ হয়েছে কী? তবে দেখার বিষয় হলো, ঘটনাপ্রবাহ থেকে কে, কী শিক্ষা নেয়।

কোনো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত হয়, টালমাটাল হয়; তখন অনেকে দুঃখ করে বলেন, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ইতিহাস চর্চা হলে তো ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রসঙ্গ আসে। আমরা তো এখন ইতিহাস ভুলে বর্তমান নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ভোগবিলাসময় ঝলমলে জীবনের তাড়নায় অর্থকড়ি ও সম্পদ আহরণে অধঃপতনের কৃষ্ণ গহ্বরে যেতেও আমরা কুণ্ঠিত নই। এই পথের পথিক শুধু আইজি বেনজির নন; ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার চতুর ব্যক্তিরা এখন এ কৃষ্ণ গহ্বরের যাত্রী। বর্তমানে যারা পথভ্রষ্ট, অতীত দেখার যোগ্যতা তাদের থাকে না, ফলে ভবিষ্যৎ নির্মাণের আলো পাবেন তারা কোত্থেকে?

আমাদের প্রিয় এ পৃথিবীতে ন্যায়-অন্যায়, আলো-আঁধারের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। প্রাচীন গ্রিসের দিকে তাকালেও আমরা সে সত্য উপলব্ধি করব। সক্রেটিসের কী দোষ ছিল, কেন তাকে হেমলক বিষপানের দ- দেওয়া হলো? মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের জীবনকাহিনী আমরা জানতে পারি তার প্রখ্যাত শিষ্য প্লেটোর রচনাবলি থেকে। প্লেটোর সব গ্রন্থের নায়ক সক্রেটিস। পথেঘাটে সর্বত্র তত্ত্ব ও জীবনদর্শনের আলোচনা করতেন সক্রেটিস। তিনি তার দর্শন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রাস্তাঘাট, হাট-বাজার যেখানেই সুযোগ হতো, সেখানেই সবার সাথে বিনামূল্যে তিনি দর্শন আলোচনায় যুক্ত হতেন। তার চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিলÑ প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, বিশ^াস কোনো কিছুকেই তিনি বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতেন না। জ্ঞান অন্বেষণে সর্বদা ব্যস্ত রাখতেন নিজেকে তিনি। তার মতে, জ্ঞান হচ্ছে আসলে জিজ্ঞাসা এবং অন্বেষা। তিনি বলতেন, আমরা সবাই নিশ্চিন্তে বলি, আমরা সবকিছু জানি, আসলে আমরা কতটুকু জানি? তিনি পরিহাস করে বলেছিলেনÑ আমাকে লোকে জ্ঞানী বলে, কিন্তু আমি কতটুকু জানি? সরলতা এবং জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা সক্রেটিসকে এথেন্সের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। আর এ জনপ্রিয়তাই বিপথ ডেকে আনে গ্রিসের মহাজ্ঞানীর জন্য। তখনকার দিনের প্রচলিত ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে তরুণদের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এথেন্সের তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা। এথেন্স সরকার তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে সক্রেটিসকে। সক্রেটিসকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়। ক্ষমা প্রার্থনা না করায় হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদ- দেওয়া হয় তাকে। যে গণতন্ত্রের জন্য এথেন্সের সংগ্রাম, সেই গণতন্ত্রের নানা দিক সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছেন সক্রেটিস। তিনি ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। এ বিষয়টি রাষ্ট্রের পছন্দ হয়নি। সক্রেটিস তার জবানবন্দিতে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি তার বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতে চান এবং দেশের নীতি ও রীতির চেয়ে ¯্রষ্টাকে মানা শ্রেয় মনে করেন। সক্রেটিসের শিষ্যরা তাকে গোপনে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ন্যায়পরায়ণ সক্রেটিস ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা গোপনে পলায়নÑ এর কোনোটিই করতে রাজি হননি।

মানুষ জানে, সত্য বলার অপরাধে সক্রেটিসকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। কিন্তু কী সে সত্য। তার সত্যের সংগ্রামে অনেক বিষয় ছিল। এর একটি ছিল মূর্তির বিরোধিতা। সক্রেটিস প্রতিমা, প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে চেয়েছিলেন। মাটি বা ইট-পাথরের ভাস্কর্য, ম্যুরাল নির্মাণ, স্থাপন মিথ্যা প্রতিষ্ঠার নামান্তর বলেই মনে করতেন সক্রেটিস। শাসকদের সাথে তার দ্বন্দ্বের এটা একটা বড় কারণ। সক্রেটিস মনে করতেন, মূর্তির স্বপক্ষ শক্তি অসত্যের পক্ষভুক্ত আর এর বিরোধিতাকারীরাই সত্যের পক্ষে। সক্রেটিস গভীরভাবে বিশ^াস করতেনÑ শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিক্ষা অন্ধকার দূর করে মানুষের মনকে জ্ঞানের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত করতে পারে। জ্ঞানের কাছে সত্যের স্বরূপ যখন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তখন সে আর পাপ করে না। সক্রেটিস আরও বিশ^াস করতেন, অজ্ঞতা থেকেই সব পাপের জন্ম।

৩৯৯ ক্রিস্ট-পূর্বাব্দে যখন সক্রেটিসের বিচার হয়, তখন তার বয়স ছিল ৭০ বছর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি যুব সমাজকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ ওঠে রাষ্ট্রদ্রোহেরও। আরও অভিযোগ ছিল, সক্রেটিস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ধর্মের ক্ষতিসাধন করেছেন। ৫০১ জন বিচারকের সামনে তার বিচার হয়। ২৮০ জন বিচারক তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন, আর ২২১ জন বলেন, সক্রেটিস নির্দোষ। ৬০ বিচারকের ভোটাধিক্যে সক্রেটিসকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। তবে অবাক ব্যাপার হলো, গ্রিসের এ মহাজ্ঞানীর মৃত্যুর প্রায় আড়াই হাজার বছর পর গ্রিসের আদালতের এক রায়ে বলা হয়, সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন। ২০১৭ সালের গ্রিসের এথেন্সের শাসকরা সক্রেটিসকে যে শাস্তি দিয়েছিলেন, তা কোনোভাবেই আইনসম্মত ছিল না। আর সক্রেটিস সে ব্যক্তি, যার জ্ঞানের মূলধন দিয়ে পরবর্তী দু’হাজার বছর ধরে উপকৃত হয়েছে পশ্চিমা দর্শন, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এমন উদাহরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, সব শাসকের আমলে আদালত ন্যায়বিচার করতে সমর্থ হন না। পরবর্তী সময়ে ভিন্ন আদালত সে ভুল সংশোধন করে দেন। তাই আবারও বলতে হয়, পৃথিবীর ইতিহাস হলো ন্যায় এবং অন্যায়ের দ্বন্দ্বের ইতিহাস।