॥ ড. মো. নূরুল আমিন ॥
আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল, ঢাকা মহানগরীর সাবেক আমীর, অনলবর্ষী বক্তা ও ইকামতে দ্বীনের অকুতোভয় দা’য়ী জনাব আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে জামায়াতের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য পতিত স্বৈরাচার, খুনি ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য ও বাংলাদেশ থেকে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করাসহ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অংশ হিসেবে জামায়াতের অন্য সিনিয়র নেতাদের সাথে জনাব আজহারুলকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন যুদ্ধাপরাধ ও কথিত মানববাতবিরোধী মামলায় জড়িয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ফাঁসির দ-াদেশ দেন। এর বিরুদ্ধে তার পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করা হয়। হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে এ আপিল নিষ্পত্তি হয়নি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়ন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এর মধ্যে মামলাটি তিন বার কজ লিস্টে আসে কিন্তু শুনানি অথবা মামলার নিষ্পত্তিকরত তাকে মুক্তি দানের বিষয়ে কোনে অগ্রগতি হয়নি। মামলার এমন শম্বুক গতি অনেককেই হতাশ করেছে। কেউ কেউ এজন্য রাষ্ট্রপতি জনাব শাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের ভূমিকাও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাদের মতে বিচারপতি শামসুদ্দীন মানিকের নেতৃত্বে আওয়ামী আমলে বাংলাদেশে মৌলবাদী সন্ত্রাস তদন্তে গঠিত গণকমিশনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জনাব শাহাবুদ্দিন চুপ্পু অন্যতম সদস্য ছিলেন। কমিশনের যুগ্ম চেয়ারম্যান ছিলেন ফজলে হোসেন বাদশা এবং সদস্য সচিব ব্যরিস্টার তুরিন আফরোজ। ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শিরোনামে প্রকাশিত এ কমিশনের রিপোর্টটি এখনো বাজারে পাওয়া যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় খ-ে বিভক্ত এই রিপোর্টের কলেবর হাজার পৃষ্ঠার উপরে এবং এতে ইসলাম, ইসলামী দলসমূহ ও তাদের কার্যাবলী, ইসলামী সংস্কৃতি ও আকিদা বিশ্বাসকে চরমভাবে আঘাত করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র প্রকাশিত ‘একাত্তরের ঘাতক জামায়াতে ইসলামীর অতীত ও বর্তমান’ শীর্ষক পুস্তকটিও প্রণিধানযোগ্য। এতে ইসলাম ও জামায়াতকে বিষোদগার করে লিখিত অন্যান্য নিবন্ধের সাথে ‘জামায়াতে ইসলামীর ধর্ম ব্যবসা : আলেমদের অভিমত’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ যৌথভাবে মাওলানা আবদুল আউয়াল ও আসিফ নজরুল এবং আরেকটি নিবন্ধ ‘আক্রমণাত্মক ভূমিকায় জামায়াত-শিবির’ যৌথভাবে শাহরিয়ার কবির ও আসিফ নজরুল প্রণয়ন করেছেন। রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের আদর্শগত চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটেছে কিনা আমি জানি না তবে জাতীয় দায়িত্ব পাবার পর তাদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতা থাকবে এটাই সকলের কাম্য।
জনাব আজহারুল ইসলামের বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। কিছুকাল আগে দুরারোগ্য রোগে তার সহধর্মিণী মারা গেছেন। কোনো প্রকার অপরাধ না করেও তিনি শাস্তি ভোগ করছেন। এ অবিচারের অবসান প্রয়োজন। তার ওপর আওয়ামী জুলুম ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দিন বদলের রাজনীতি এত শিগগির এদেশের শতাব্দী পুরাতন ঐতিহ্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি-সংহতি, মূল্যবোধ এবং জনহিতকর আইন ও বিধি-বিধান প্রথা কনভেনশানকে ধ্বংস করে হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার বিস্তৃতি ঘটাবে, এটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। আমি বিষয়টি উপলব্ধি করলাম জামিনে মুক্ত একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার অবস্থা দেখে।
২০১১ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল জনাব এটিএম আজহারুল ইসলাম ১১ মাসেরও বেশি সময় জেল খেটে গত আগস্টে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পান। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জামায়াত-শিবিরের মিছিলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের বাধা এবং হামলাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে সরকারের নির্দেশে পুলিশ জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে এবং আজহারও ঐ সময় গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর পর্যায়ক্রমে তার বিরুদ্ধে আরও ১০টি মামলা দেয়া হয়। তাকে পুলিশি রিমান্ডে নিয়ে ৩ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। ডা-াবেড়ি পরিয়ে তাকে আদালতে আনা হতো। সম্ভবত এ উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক বন্দীদের ডান্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনা অত্যন্ত বিরল। পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ছিল।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তারা অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে রাজবন্দী হিসেবে তারা কারাগারে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। এদের কাউকেই ডা-াবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করার নজির নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আজহার ও জামায়াত নেতাদের ব্যাপারে এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে । জনাব আজহারুল ইসলামের একমাত্র ছেলে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতেন। ছেলেটি বোনের বিয়ে ও ঈদ উপলক্ষে ছুটিতে দেশে এসেছিল। আজহার গ্রেফতার হওয়ার পর ছেলেটি পিতার অবস্থা জানার জন্য বাসা থেকে নিচে নেমে এসেছিল। পুলিশ তাকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং আদালত তাকে তার পিতার সাথে জেলে পাঠিয়ে দেয়। ছেলেটির সাথে কোন রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা ছাত্র সংগঠন অথবা মিছিল-মিটিং-এর সম্পর্ক ছিল না। দীর্ঘ ৮ মাস জেল খাটার পর হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে তাকে মুক্ত হতে হয়েছিল। একটি প্রতিভাবান তরুণের মূল্যবান জীবনের ৮টি মাস আওয়ামী লীগ সরকার এভাবে কেড়ে নেয় ।
জনাব আজহারের জামিন প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আগেই বলেছি, ২০১১ সালের ১৬ আগস্ট তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন। কিন্তু তার এ মুক্তির ধরন-প্রকৃতি ছিল অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব। পরপর ১১টি মামলায় আদালত তাকে জামিন দেয় এবং এর কোন জামিনই শর্তসাপেক্ষ ছিল না। ইতোপূর্বে একটি মামলায় জামিন পাবার পর তার আইনজীবী ও আত্মীয়-স্বজন যখনই তাকে জেলগেটে অভ্যর্থনা জানাতে গেছেন তখনই দেখা গেছে যে, অন্য একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর প্রায় প্রত্যেক জামিনের পরই তার বিরুদ্ধে নতুন মামলা দিয়ে তার মুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ১১তম মামলায় আদালত যখন তাকে জামিন দেন তখন সরকার পক্ষকে এই মর্মে নির্দেশও দেন যে, তাকে যেন পুনরায় হয়রানি করা না হয়। কিন্তু সরকার ও তার পুলিশ বাহিনী আদালতের এই নির্দেশ মানেনি। তার আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব ও দলীয় নেতা-কর্মীরা তাকে আনার জন্য জেলগেটে গিয়েছিলেন কিন্তু পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছেন। পুলিশ সম্পূর্ণ বন্দী অবস্থার পরিবেশে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তার মগবাজারের বাড়িতে তাদের গাড়িতে করেই নিয়ে এসেছিলেন। কারোর সঙ্গে কথা বলতে দেননি। গাড়িতে তার ডানে-বামে-পেছনে ছিল পুলিশ। যে ড্রাইভার গাড়ি চালিয়েছিল সেও ছিল পুলিশ বাহিনীর সদস্য। ড্রাইভারের পাশে সম্ভবত অত্যন্ত মেহেরবানি করে জামায়াত নেতা সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ তাহেরকে বসতে দিয়েছিল।
ঐ গাড়ির সামনে ও পেছনে ছিল পুলিশ ও র্যাাব সদস্যদের বহনকারী অসংখ্য যান। কারামুক্ত একজন নেতাকে পুলিশ হেফাজতে বন্দী অবস্থায় বাড়ি পৌঁছানোর এ ধরনের ঘটনা এর আগে কখনও শোনা যায়নি। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। মগবাজারের এফ-টাওয়ারটি পুলিশ বাহিনী দখল করে নেয়। এ ভবনটির গেটে, সামনের রাস্তায়, ওপরে-নিচে, লিফটে, ছাদে এবং ৭ম তলায় তার ফ্ল্যাটের সামনে ৯ জন মহিলা পুলিশসহ ৫০ জন পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং এ ভবনে বসানো হয়েছিল ১১টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এ ভবনের প্রত্যেকটি তলার বাসিন্দারা পুলিশের হাতে শুধু জিম্মি হয়নি, তাদের ভাষায় গোটা ভবনটি কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছিল। কাজের বুয়াদের পর্যন্ত বাসায় আসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তার আত্মীয়-স্বজন, ভাই, ভাতিজা, ভাইজি, বোন, ভাগিনা, শালা কেউই বাসায় আসতে পারেননি। পুলিশ তাদের গেট থেকে ফেরত দিয়েছে। তার বড় ভাইয়ের ছেলের বউ সদ্য প্রসূত সন্তানকে চাচা শ্বশুরকে দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাকেও পুলিশ বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। পরে ঐ শিশুটিকে ভবনের কেয়ারটেকার ওপরে নিয়ে তাকে দেখিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু শিশুটির মা যেতে পারেননি। ‘জামিনে মুক্ত’ আজহার প্রায় ৭ দিন পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় তার বাসায় ছিলেন। তাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়া হয়নি, মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে দেয়া হয়নি। জুমাতুল বিদার দিনেও তাকে মসজিদে গিয়ে জুমআর নামায পড়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। যখনই তিনি যেতে চেয়েছেন পুলিশ তখনই ওপর মহলের নির্দেশের দোহাই দিয়েছেন।
ঈদের দিন ভোর ৬টা পর্যন্ত তাকে যেটা জানানো হয়েছিল সেটা হচ্ছে তার ঈদের নামায পড়ার অনুমতি নেই। কিন্তু হঠাৎ করে ৬টার পর পুলিশ এসে তাকে কাপড়-চোপড় পরে ঈদের নামাযে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলেন এবং তারা তাদের গাড়িতে করে তাকে রমনা থানা মসজিদে নিয়ে গিয়ে নামাযে অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেয়। তার সাথে তার সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনকে যেতে দেয়া হয়নি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কারোর সাথে তার ঈদের মোলাকাত হয়নি। তাকে বহনকারী পুলিশের গাড়ির সামনে ও পেছনে ছিল অনেকগুলো পুলিশ ভ্যান।
আদালতে জামিন নিয়ে কোন রাজনৈতিক নেতা অথবা সাধারণ কোন মানুষ এ ধরনের পুলিশ কাস্টোডিতে থাকার ঘটনাটি এবারই দেশবাসী সম্ভবত প্রথম জানলো। কেয়ারটেকার আমলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫টি মামলার আসামী ছিলেন। জামিন নিয়ে তিনি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ চষে বেড়িয়েছেন। পুলিশ তাকে কোন বাধা দেয়নি।
ছাত্রলীগ আওয়ামী সরকারের আমলে খুন রাহাজানিসহ অসংখ্য অপরাধ করেছে। তাদের হাতে খুন হওয়া ছাত্রের সংখ্যা কয়েক হাজারঅতিক্রম করেছে এবং এসব খুনের ঘটনায় আসামীদের নামধাম উল্লেখ করে মামলাও হয়েছে। আন্তঃদলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগের বহু নেতা নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা আছে। খুনের মামলার এ আসামীরা সকলেই জামিনে মুক্ত হয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। মুক্তির পর তাদের কাউকেই পুলিশ কাস্টডিতে যেতে হয়নি। কিন্তু জনাব আজহারুল ইসলামের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে এবং তাদের কাস্টডিতে থাকা অবস্থাতেই ঈদের দু’দিন পর ১৯৭১ সালে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ দেখিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তাকে গ্রেফতার করে ডিবি অফিস ও ট্রাইব্যুনাল ঘুরিয়ে পুনরায় কারাগারে নেয়া হয়েছে। গ্রেফতার অবস্থায় গ্রেফতারের সংবাদই অদ্ভুত লেগেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে জনাব আজহার রংপুর কারমাইকেল কলেজে ছাত্র থাকাকালে জেলার বিভিন্ন স্থানে ১২০০ লোককে হত্যার নির্দেশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ঐ কলেজেরই ৬ জন শিক্ষক এবং শিক্ষকপতিœসহ ৭ব্যক্তিকে হত্যা করিয়েছেন।
এদের মধ্যে ৫ জন ছিল হিন্দু, দু’জন মুসলমান আবার দু’জন মুসলমানের মধ্যে একজন ছিলেন উর্দুভাষী, উর্দু বিভাগের শিক্ষক, অন্যজন বাংলার শিক্ষক। অভিযোগ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ১৯৭২ সালে পাকিস্তান চলে যান এবং সেখান থেকে সৌদি আরবে গিয়ে আশ্রয় নেন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর জনাব আজহার দেশে ফিরে আসেন এবং রাজনীতি শুরু করেন। প্রাথমিক অভিযোগটি শুনতে ভালই লাগে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে এবং অভিযোগটি যে বানোয়াট ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিব্যক্তি তাই প্রমাণিত হয়।
এলাকা এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে খবর নিয়ে জানা গেছে যে, জনাব আজহার ১৯৭১ সালে কারমাইকেল কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ঐ বছরই তিনি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজ জীবনে তার রাজনৈতিক তৎপরতা অথবা অপরাধমূলক কোনও তৎপরতার সাথে সম্পৃক্ততার তথ্য মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। ঐ সময়কার ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র শত শত লোক এবং কলেজ ক্যাম্পাসে বসবাসরত শিক্ষকদের ধরে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করার ঘটনা নাটক-নভেলে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে বাস্তবে নয়। ’৭১ সালে জুলাই মাসে তিনি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে যথারীতি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। কারমাইকেলের তৎকালীন সময়ে শিক্ষক হত্যা করে তিনি সে কলেজেই লেখাপড়া করে তিহাত্তর সালে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করার কথা নয়। জনাব আজহার অপরাধী বা সাধারণ কোনও পরিবারের সদস্যও ছিলেন না। তার পিতা ডা. নাজির আহমদ এমবিবিএস ডিগ্রিধারী একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক ছিলেন। তার বড় ভাইও ডাক্তার ছিলেন। অবশ্য তার মামাদের প্রায় সকলেই বামধারার রাজনীতি করতেন। জনাব আজহার কিংবা তার পরিবারের কেউ কখনো কোনও অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন ১৯৭১ সাল থেকে ২০১২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ ধরনের অভিযোগ উঠেনি এবং সুনির্দিষ্ট অপরাধ উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে থানায় কোনও জিডিও হয়নি। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তান বা সৌদি আরবে পালিয়েও যাননি। ৭৩ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সেখান থেকেই অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। ৭৭ সালে তার মাস্টার্স সম্পন্ন হবার কথা থাকলেও সেশন জটের কারণে ৭৯ সালে তা সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি যদি মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতই থেকে থাকতেন তা হলে ৭২ সাল থেকে অব্যাহতভাবে তিনি মুক্ত অবস্থায় ছিলেন কিভাবে? এ অবস্থায় এটা পরিষ্কার যে জামায়াতকে পঙ্গু করা এবং সরকার বিরোধী আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্যই জনাব আজহারের যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছেÑ যেমনটি করা হয়েছে জামায়াতের অপরাপর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। ঐ সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করেছিল এর মাধ্যমে তাদের দুটি লাভ হবে। একটি হচ্ছে নিরাপদে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং আরেকটি হচ্ছে দেশ ও জাতীয় সম্পদের নিরুপদ্রব লুটপাট ও ভোগবিলাস। তারা দেশ এবং দেশের সম্পদকে নিজেদের উত্তরাধিকারের সম্পদ বলে মনে করে এবং তাদের ধারণা, ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র অধিকার তাদেরই। সেটা বৈধ পন্থায় হোক বা অবৈধ পন্থায়। ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ১৬ বছরে তারা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধকেই শুধু ধ্বংস করেনি বরং দুর্নীতি ও লুটপাটের অগণিত সড়ক, মহাসড়কও খুলে দিয়েছেন। শেয়ার বাজারের ৩৫ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা লোপাট, ডেসটিনির ৩২৮৫ কোটি টাকার অর্থ পাচার, যুবকের ৪২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ইউনিপে টুইউএর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট, আইটিসিএল-এর ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহকে দেউলিয়া করে প্রায় ২৮ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের, দফতর, অধিদফতরে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি প্রভৃতি আগামী দিনগুলিতে আওয়ামী লীগের কীর্তি হয়ে থাকবে। তাদের অনিয়ম, আত্মসাৎ ও দুর্নীতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে গেলে একটি মহাভারত রচনা করতে হবে। তাদের অন্যায়-অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেষ পর্যন্ত খুনি ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা জীবন রক্ষার জন্য ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তার অপরাধের বিচার এখনো হয়নি। তার উপযুক্ত বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়।