ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয়ের বিষয়টি দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনকেও স্পর্শ করেছে, নানাভাবে নানা মাত্রায়। ফলে উপলব্ধি করা যায়, ভূরাজনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতিকে অবহেলা করা যায় না। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশ ভারতের, বিশেষ করে আমাদের লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনৈতিক ভাবনা ও বিবেচনাবোধকে আমাদের বিবেচনায় আনতে হয়। যে কোনো আলোচনায় ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের ইতিহাস চর্চা যেন ১৯৭১ সালের ফ্রেমে আটকে আছে; এর আগে যে বৃটিশ আমল ছিল, মোগল আমল ছিল, ছিল জমিদারী শাসন- সে কথা যেন আমরা ভুলেই গেছি। ইতিহাস চেতনা এতটা খ-িত হয়ে গেলে, আমরা এই জনপদের মানুষের নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব উপলব্ধি করবো কেমন করে? এমন দৈন্যের কারণে আমাদের অনেকেরই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান গণআকাক্সক্ষা পূরণে সমর্থ হচ্ছে না।

স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জন্য ১৯৭১ সাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় আমরা ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ২০২৫ সালে এসে আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে স্বাধীনতার লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনের ‘পক্ষ শক্তি’ ও ‘বিপক্ষ শক্তির’ পরিচয়ও আমাদের জানতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ট্যাগিংয়ের নেতিবাচক প্রবণতা পরিহার করতে হবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে আমাদের। বলছিলাম, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (ডাকসু) ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয়ের বিষয়টি দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অংগনকেও স্পর্শ করেছে। বিষয়টাকে কেউ কেউ ভালোভাবে নিতে পারেন নি। এখানে কাজ করেছে তাদের সাম্প্রদায়িক চেতনা ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। তারা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের স্বপ্নকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন নি এবং ‘জেন-জি’র রায়কে সম্মান প্রদর্শনে হয়েছেন ব্যর্থ। প্রসঙ্গত এখানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘বাংলা পক্ষ’ দলের কথা উল্লেখ করা যায়। এ দলের প্রধান গর্গ চট্টোপাধ্যায় ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিতে পারেন নি। এ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয়কে তিনি ‘বাঙালি জাতির শত্রু’ এবং ‘রাজাকারের বাচ্চাদের’ বিজয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েল শিক্ষিত ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক আদর্শ হলো ‘পাকিস্তান পন্থা’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা।’ তিনি আরো বলেন, এরা ১৯৭১ সালের গণহত্যা এবং ধর্ষণের সমর্থক। বাংলাদেশকে ‘অসভ্য বাংলা’ বলে মন্তব্য করে গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলেন, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান থেকে পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করা ‘বাংলা পক্ষের’ গুরুদায়িত্ব। এখন থেকে বাংলা ও বাঙালির সব অর্জনের উত্তরাধিকারী কেবল পশ্চিমবঙ্গ। গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের এমন উগ্রতা ও অনধিকার চর্চা থেকে তার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে। তার বিকারগ্রস্ত বক্তব্যের জবাব দেওয়ার মত রুচি আমাদের নেই। সাম্প্রদায়িক উগ্রতার শিখরে অবস্থান করে তিনি নাকি পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান থেকে রক্ষা করবেন! গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের অমার্জিত ও অশালীন বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা মনে করি, পশ্চিমবঙ্গের সবাই গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের মতো কা-জ্ঞানহীন নন। আশা করি, গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের উগ্র ও আপত্তিকর বক্তব্যের বিরুদ্ধে যথাযথ জবাব দিয়ে তারা কা-জ্ঞানের পরিচয় দেবেন।

কা-জ্ঞানহীন আচরণের একটি রূপ হলো, ‘ট্যাগিং’। গর্গ চট্টোপাধ্যায় ট্যাগিংয়ে বেশ পারঙ্গম। এ ঘরানার ছায়া দেখা যায় বাংলাদেশেও। তবে ট্যাগের এ রাজনীতির ভূমিধস পরাজয় হয়েছে ডাকসু নির্বাচনে। এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের কথা উল্লেখ করা যায়। গত বুধবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে দেওয়া পোস্টে তিনি ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এ নির্বাচনের মাধ্যমে ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতির ভূমিধস পরাজয় হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া সব অংশগ্রহণকারীকে অভিনন্দন জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ছাত্রশিবিরের বিশাল বিজয় নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে এখন। আমি শুধু একটা কথা বলব, শেখ হাসিনার আমলে শিবির ট্যাগ দিয়ে অগণিত নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্রকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। শিবির সন্দেহে পেটানোর পর পুলিশে সোপর্দের ঘটনাও ছিল নিত্যনৈমিত্তি ব্যাপার’। এ থিমের বিরুদ্ধে অভিরামভাবে প্রতিবাদ জানানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নানা হুমকি ও আক্রমণ এসেছে, কখনো থামি নি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই থিমের ওপর ‘আমি আবুবকর’ নামের উপন্যাসও লিখেছি। এক বই মেলাতেই এটি ১১ বার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। তখন এর কারণ বুঝি নি, এখন বুঝতে পারছি।” যারা পড়েছেন, তারা বুঝতে পারবেন কেন ‘আমি আবুবকর’ উপন্যাসটি একুশে বইমেলায় ১১ বার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। বিপুল এ পাঠকগোষ্ঠীর বিজয় হয়েছে এবার ডাকসু নির্বাচনে। উপন্যাসটির পাঠক হিসেবে আমি বলতে পারি, ‘আমি আবুবকর’ উপন্যাসটি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বড় সাক্ষী হয়ে থাকবে। ফ্যাসিস্ট আমলে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের মর্মস্পর্শী চিত্র এখানে বর্ণিত হয়েছে। শুধু ছাত্রলীগের নয়, দলীয় ঘরানার শিক্ষকদের নৈতিক ও অধপতনের চিত্রও উপন্যাসটিতে বর্ণিত হয়েছে। সেই দুঃসময়ে এমন একটি উপন্যাস রচনার মতো সাহসী কর্মসম্পাদনের জন্য আমরা ড. আসিফ নজরুলকে শ্রদ্ধা জানাই।

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয়ের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। আলোচনায় কিছু রকমফেরও লক্ষ্য করা গেছে। তবে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায় বলা হচ্ছে, দেশের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কি নতুন ধারার সূচনা হলো? বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের এমন আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণও লক্ষ্য করা গেছে। বলা হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচনের শুরু থেকেই শিবিরের একটি শক্তিশালী এবং সম্ভাবনাময় উপস্থিতি বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছিল। ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, সে পূর্বাভাস যথার্থ ছিল। প্রায় ৮০ শতাংশ আসনে তারা বিজয় অর্জন করেছে। বিশেষত ভিপি, জিএস ও এজিএস-তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে শিবির তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের অর্ধেকের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছে। শিবিরের এমন বিজয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংগঠনটির বিশেষ জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়। এমন জনপ্রিয়তার কারণগুলোও বিশ্লেষকরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তারা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শিবিরের কার্যক্রম এবং সাংগঠনিক উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে আবু সাদিক কায়েমের নেপথ্যের শক্তিশালী অবস্থান, তার দীর্ঘদিনের ত্যাগ, সংগ্রাম ও নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার পাশাপাশি এসএম ফরহাদ, যিনি জিএস পদে বিজয়ী হয়েছেন, তিনিও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। শিবির ডাকসু নির্বাচনে নিজেদের কেবল ‘শিবির’ হিসেবে উপস্থাপন না করে, বরং ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

প্যানেলে হিজাবি ও ‘নন হিজাবি’ ছাত্রী থেকে শুরু করে ভিন্নধর্মের শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি শিবিরের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলেছে। এ কৌশল তাদের দুটি বড় সমালোনা থেকে রক্ষা করেছে। প্রথমত, শিবিরকে নারী বিরোধী বা নারীবান্ধব নয় বলে যে অভিযোগ ওঠে, সেটি কার্যত ভেঙ্গে গেছে। দ্বিতীয়ত, তারা কেবল ইসলামভিত্তিক বা একমুখী সংগঠন নয়, বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের দ্বার অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্যও খোলা। বিশ^বিদ্যালয়ের নির্বাচনে শিবিরের সাফল্যের পেছনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অভিযোগের অভাব। তাদের চরিত্র ও উত্তম আচরণ শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করেছে। শিবিরের জয়ের পেছনে আর একটি বড় কারণ হলো, তারা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা বোঝার চেষ্টা করেছে এবং তাদের দাড়ির প্রতি সম্মান জানিয়েছে। এছাড়া শিবিরের প্রার্থীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অসাধারণ ফল এবং একস্ট্রা একাডেমিক কার্যক্রমে সাফল্য শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফ্যাসিবাদী আমলে শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর যেভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়ছে, তা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের সহানুভূতি সৃষ্টি করেছে। সব মিলিয়ে আসলে যোগ্য প্রার্থী হিসেবেই ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্যানেল ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে।

বিজয়ে শুধু আনন্দ নয়, চ্যালেঞ্জও থাকে। এ চ্যালেঞ্জ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ, এ চ্যালেঞ্জ ইশতেহার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি শিবির নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করছেন বলেই মনে হয়। গত বুধবার সকালে ডাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সিনেট ভবনে সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর নবনির্বাচিত সহসভাপতি আবু সাদিক কায়েম বলেছেন, আমরা সব মত ও আদর্শের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে একসাথে কাজ করবো। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে চমৎকার শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতের প্রতিজ্ঞা করেন। সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস এসএম ফরহাদও কথা বলেন। তারা দুজনই এ বিজয়ে কোনো শোভাযাত্রা না করার ঘোষণা দেন। সাদিক কায়েম বলেন, ডাকসু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের কিছু নেই। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই প্রজন্ম বিজয়ী হয়েছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিজয়ী হয়েছে।

এ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাইয়ের আকাক্সক্ষা বিজয়ী হয়েছে। আমরা স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের সকল শহীদকে, মহান মুক্তিযুদ্ধর সকল শহীদকে, ... আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের অগ্রনেতা শহীদ আবরার ফাহাদকে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরকেও আজকে আমরা স্মরণ করছি। সাদিক কায়েমের বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে তারা সচেতন আছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাকসুর নতুন অভিযাত্রার সাফল্য কামনা করে আজকের লেখা শেষ করছি।