॥ লুৎফর জামান ফকির ॥
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তের অভ্যন্তরে ভূমি দখল ও জোরপূর্বক রাস্তা নির্মাণে তৎকালীন বিডিআর প্রতিবাদ করায়, বিএসএফ বিডিআর এর টহল সদস্যদের ধরে নিয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন বিডিআর ২০০১ সালে ১৫ এবং ১৬ এপ্রিল বেদখল পাদুয়া গ্রাম পুনরুদ্ধার করে সেখানে ৩টি বিওপি ক্যাম্প স্থাপন করে। তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্প স্থাপনকে কেন্দ্র করে মেঘালয় রাজ্যে বিএসএফ বিডিআর পর্যায় সমঝোতার আলোচনার মাধ্যমে সময়ের কালক্ষেপণ করে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ভারতীয় বিএসএফ পাদুয়া ঘটনার মাত্র তিনদিন পর ১৮ই এপ্রিল রৌমারী সীমান্তের বড়াইবাড়ীতে বিডিআর এর ক্যাম্প দখলের উদ্দেশ্যে ভারতের সেনাবাহিনী ও বিএসএফের যৌথ সমন্বয়ে আক্রমন করে। বিএসএফের যৌথ দলের বিরুদ্ধে আক্রমন প্রতিহত করতে ক্যাম্পে উপস্থিত ৮জন বিডিআর সদস্য সহ স্থানীয় জনসাধারনের সহযোগিতায় বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের মধ্যদিয়ে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
বড়াইবাড়ি যুদ্ধে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্বন্ধে তৎকালীন বিডিআর এর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব:) আ. ল. ম ফজলুর রহমানের বাংলাভিশন টিভির দেশের কথা অনুষ্ঠানের উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী ভারতের প্রায় ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য বড়াইবাড়ি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। তার মধ্যে এক কর্ণেল সহ প্রায় ৪০০ ভারতীয় সেনা ও বিএসএফ সদস্য নিহত হন। দুজন সদস্যকে জীবিত আটক করে সেই সাথে ১৮টি সৈন্যের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। বিজয়গাঁথা এ যুদ্ধে তৎকালীন বিডিআর এর ৩জন জোয়ান শাহাদত বরণ করেন। সেই সাথে বিএসএফের গুলিবর্ষনে স্থানীয় ৬জন বাসিন্দা গুলি বিদ্ধ হন। তাদের মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশের ১৭৯ টি বাড়ীঘর ধ্বংসস্থুপে পরিণত হয়।
সীমান্ত হত্যা : বাংলাদেশ সরকার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যগত পার্থক্য থাকলেও বেসরকারি সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারত ৪০৯৭ কিলোমিটার সীমান্তে ২০০৯ হইতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৬ বছরে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ এর হাতে ৫৮৮ জন হত্যাসহ ৭৭৩ জন বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিককে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে আহত করেছে।
২০০৯ হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সীমান্তে বাংলাদেশের বেসামরিক হত্যার ক্রমাগত বাৎসরিক চিত্র : ২০০৯-৯৮ জন, ২০১০-৭৪ জন, ২০১১-৩১ জন, ২০১২-৩৮ জন, ২০১৩-২৯ জন, ২০১৪-৩৫ জন, ২০১৫-৪৪ জন, ২০১৬-২৯ জন, ২০১৭-২৫ জন, ২০১৮-২১ জন, ২০১৯-৪১ জন, ২০২০-৫১ জন, ২০২১-১৭ জন, ২০২২-১৮ জন, ২০২৩-২৮ জন, ২০২৪-২৯ জন। ১৬ বছরে সর্বমোট : ৫৮৮ জন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তথ্য অনুযায়ী এক বছরের সীমান্ত চোরাচালানের বিস্তারিত : বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২০২৪ সালের ০১ জানুয়ারি হতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে সর্বমোট ২,১৮৪ কোটি ২৮ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। জব্দকৃত চোরাচালান পণ্যের মধ্যে রয়েছে- ১৩১ কেজি ৪২৪ গ্রাম স্বর্ণ, ১৩৭ কেজি ২৮৯ গ্রাম রৌপ্য, ২,১৪,৮০৫টি শাড়ি, ২,১০,০৬৩টি থ্রিপিস/ লেহেঙ্গা/ তৈরী পোশাক, ৩৩,২২,৩৬১টি কসমেটিক্স সামগ্রী, ৭০,১৫,৮২৪ কেজি চিনি, ৫৮,২৭৪ কেজি চা পাতা, ২,৩৫,৪৪৬ কেজি পিঁয়াজ, ৩,৩৮,৪৯৭ কেজি রসুন, ৬৫,২৯৮ কেজি জিরা, ৮৯,৩৬৫ কেজি মাছ, ৪,৩১,৪০৭ কেজি সুপারি, ৪৮, ৫৯৮ ঘনফুট কাঠ, ৬,০৫৩ ঘনফুট পাথর, ৭,৩৭,১৮০ কেজি কয়লা, ৬১,১৪৪টি ইমিটেশন গহনা, ১৭টি কষ্টি পাথরের মূর্তি, ১৪ কেজি ৮১ গ্রাম সাপের বিষ, ৮ কেজি ৩৯৮ গ্রাম তিমির বমি (অ্যাম্বারগ্রিস), ৩৩,১৩২ কেজি কারেন্ট জাল, ১২,৬৭,১৪৮ প্যাকেট বিড়ি ও সিগারেট, ২৫,৬২৪ কেজি সার, ১২,২৬২ লিটার ডিজেল/ পেট্রোল/অকটেন, ৯,৯০৭টি মোবাইল, ১,০০,০০৫টি মোবাইল ডিসপে, ৩,৬০,২৮৮পিস চশমা, ১০,৩২,০৯৪ পিস চকলেট, ২,৭৮,২৫৩ প্যাকেট বিস্কুট, ২,১৮০ প্যাকেট কীটনাশক, ৩৮ কেজি ৪০০ গ্রাম কচ্ছপের হাড়, ২,৫১,৬৪,৫০৭ পিস আতশবাজী, ২০৭টি ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান, ০৮টি বাস, ৪৭টি প্রাইভেটকার/ মাইক্রোবাস, ৯১টি পিকআপ, ৩৮৩টি সিএনজি/ ইজিবাইক, ৮৭৩টি মোটরসাইকেল এবং ২৩৫টি বাই-সাইকেল। একই সময়কালে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৩৮টি পিস্তল,৫টি এসএমজি, ১৮টি গ্রেনেড, ৮টি রাইফেল, ৬টি রিভলভার, ৫২টি সকল প্রকার গান, ৮,৮৫৯ গোলাবারুদ, ৪৫টি ম্যাগাজিন, ৪টি মর্টার শেল, ৪১টি ককটেল, ১০.৪৪ কেজি গান পাউডার, এবং ২৩৩টি ব্ল্যাংক কার্টিজ।
সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান : সীমান্ত আদালত : সীমান্ত আদালতের মাধ্যমে উভয় দেশের জুডিশিয়াল বডি থাকলে অনুপ্রবেশ সহ সীমান্তের বিভিন্ন অপরাধের তাৎক্ষনিক বিচারকার্যের মাধ্যমে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে আটক ব্যক্তিবর্গের দ্রুত সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব। অন্যথায় দুইদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে আটক ব্যক্তিকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করায় প্রচলিত আইনে বিচার করতে বা মুক্তি পেতে কাগজের জটিলতায় ভারতে কারাগারে ১০৬৪ জন বাংলাদেশের কারাগারে ১৫৭ জন বিনা অপরাধে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। যেমন নেত্রকোণা কারাগারে মইনুল ইসলাম নামের এক ভারতীয় নাগরিকের সাজা শেষ হওয়ার পরেও ২০২২ সাল থেকে শুধু কাগজের জটিলকায় জেলহাজতে আটক আছে। তারা নাগরিক অধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জুডিশিয়াল সীমান্ত আদালতের প্রয়োজনীয়তা : কুড়িগ্রাম সীমান্তে ১০ বছর বয়সী ফেলানী খাতুনকে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যা করে প্রাণহীন দেহটি তাঁরকাটার বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখার দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও ন্যায় বিচারের দাবী থাকলেও প্রধান আসামী বিএসএফের সদস্য অমির ঘোষ সহ তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিএসএফের নিজস্ব আদালতে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হন। রায় পূর্ণ বিবেচনা করেও একি আদালত পূর্বের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশনা থাকলেও আমলে নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ভারতের দু’দেশের সরকার পর্যায়ে একাধিকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের উভয়পক্ষ আশ^স্থ করে। সেইসাথে বিজিবি এবং বিএসএফের ডিজি পর্যায়েও ৫৪ বার সংলাপের মাধ্যমে সীমান্ত হত্যা বন্ধে সমঝোতা চুক্তি হলেও দিল্লির কম গুরুত্বের কারণে সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুই দেশের সরকারের সীমান্তে হত্যাকা-ের দায়মুক্তির কোন সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলেও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফ ও বিজিবি কে ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকায় সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলো উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও সংঘবদ্ধ অপরাধ গবেষক।