মো. জাহিদ হোসেন
চাঁদপুর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরও বটে। ঢাকা, বরিশাল, ভোলা, হাইমচর, শরীয়তপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের বহু জেলায় যাতায়াতের জন্য চাঁদপুর একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। এটি দেশের প্রাচীন ও ব্যস্ততম নৌরুটগুলোর একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এটি বাণিজ্য ও যাতায়াতের জন্য অত্যন্ত উপযোগী স্থান হয়ে ওঠেছে।
ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চল প্রথমে ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত ছিল। পরবর্তীতে এটি কুমিল্লা জেলার (তৎকালীন টিপেরা জেলা) অংশ হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রমে যুক্ত হয়। চাঁদপুর ১৯৭৭ সালে মহকুমা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অবশেষে ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে চাঁদপুরকে কুমিল্লা জেলা থেকে আলাদা করে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একটি প্রচলিত মত অনুসারে, চাঁদ সওদাগর নামে এক ধনী বণিকের নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয় চাঁদপুর।
চাঁদপুর “ইলিশের বাড়ি” হিসেবে সর্বাধিক খ্যাত। ২০১৫ সালে, তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর মণ্ডল চাঁদপুর জেলার ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শুরু করেন, যার অংশ হিসেবে “ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর” স্লোগানটি প্রচলিত হয়। এ ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে চাঁদপুরের ইলিশের খ্যাতিকে তুলে ধরা হয় এবং ২০১৭ সালে চাঁদপুরকে বাংলাদেশের প্রথম ব্র্যান্ডিং জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ।
চাঁদপুরকে “ইলিশের বাড়ি” বলা হয় এক বিশেষ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির কারণে। এ উপাধির পেছনে রয়েছে চাঁদপুরের ভৌগোলিক অবস্থান, নদীর বৈচিত্র্য এবং ইলিশের প্রাচুর্যের এক অনন্য সংযোগ। চাঁদপুর জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এখানে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া-এ তিনটি বড় নদীর মিলনস্থল রয়েছে, যাকে বলা হয় “ত্রিমোহনা”। এ মিলনস্থল ইলিশ মাছের জন্য এক আদর্শ প্রজনন ও বিচরণ এলাকা। এ তিন নদীর মিলনস্থল ইলিশের প্রজনন ও বিচরণস্থল হিসেবে একেবারে আদর্শ। নদীর গভীরতা, পানির প্রবাহ ও স্বল্পমাত্রার লবণাক্ততা ইলিশের ডিম পাড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ইলিশ একটি anadromous মাছ-অর্থাৎ, সাগরে বড় হয় কিন্তু ডিম পাড়ে মিঠা পানির নদীতে এসে। চাঁদপুরের নদীগুলোতে জোয়ার-ভাটার গতি ইলিশের আগমনকে বাড়িয়ে দেয়।
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ইলিশের প্রধান প্রজননকেন্দ্র হিসেবে চাঁদপুর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এজন্য সরকার ২০০৬ সালে চাঁদপুরের একটি বড় অংশ মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিলোমিটার নদীপথকে “ইলিশের অভয়াশ্রম” ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ অভয়াশ্রম এলাকায় সব ধরনের মাছ ধরা, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ ও ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকে। এটি “মৎস্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ (Fish Conservation Act, 1950) এর সংশোধিত রূপ অনুসারে কার্যকর হয়।
চাঁদপুরে প্রতিদিন শত শত মণ ইলিশ মাছ আহরণ ও বিক্রি হয়। চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছঘাট দেশের অন্যতম বৃহৎ ইলিশের বাজার। এখান থেকে ইলিশ সরবরাহ হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ সারা দেশে। এমনকি রপ্তানির কাজও হয়। চাঁদপুর জেলার প্রায় ১ লাখ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইলিশ মাছের উপর নির্ভরশীল। জেলে, মাঝি, ব্যবসায়ী, বরফকল শ্রমিক, ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক-সব মিলিয়ে একটি সমগ্র অর্থনৈতিক চক্র গড়ে উঠেছে ইলিশকে কেন্দ্র করে।
চাঁদপুরের মানুষজন ইলিশকে শুধু জীবিকা নয়, সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ঈদ, পূজা বা বিশেষ দিনগুলোতে ইলিশকে কেন্দ্র করে চলে নানা আয়োজন। চাঁদপুরে গেলে “ইলিশ ভাজি”, “ইলিশ পোলাও”, কিংবা “সরিষা ইলিশ” খাওয়া যেন এক বাধ্যতামূলক অনুষঙ্গ। সময় গড়ানোর সাথে সাথে চাঁদপুরের এ ইলিশ ঐতিহ্য বিভিন্ন মিডিয়ায় উঠে এসেছে-পত্রিকা, টেলিভিশন, এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও। ফলে “ইলিশ মানেই চাঁদপুর” এই পরিচিতি জনমনে গেঁথে গেছে।
চাঁদপুরে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ইলিশের জীবনচক্র, প্রজননকাল, পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা চলছে। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, চাঁদপুর অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ও ওজনদার ইলিশ ধরা পড়ে। ‘Silver Hilsa’ev ’Chandpur Premium Ilish’- যেগুলোর গঠন, স্বাদ ও চর্বির মাত্রা অন্য অঞ্চলের তুলনায় আলাদা। চাঁদপুরে ধরা ইলিশের ৬৫% হয় ৭০০ গ্রাম থেকে ১.৫ কেজি ওজনের। এ কারণেই চাঁদপুরের ইলিশ আলাদা কদর পায়। চাঁদপুর জেলা থেকে বছরে গড়ে প্রায় ২০,০০০ টন ইলিশ আহরিত হয়। ইলিশ খাত থেকে শুধু চাঁদপুরেই বছরে কয়েক ’শ কোটি টাকা আয় হয়।
সব মিলিয়ে, চাঁদপুর শুধু একটি জেলা নয়- এটি একটি ইলিশ-ঐতিহ্যের শহর। চাঁদপুরকে “ইলিশের বাড়ি” বলা হয় শুধু ইলিশ ধরার পরিমাণের জন্য নয়, বরং এটি একটি জীবনযাপন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক।
লেখক : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।