এক সময় আমরা পৃথিবীর বড় বড় নেতাদের কন্ঠে শান্তি ও মৈত্রীর কথা শুনতাম। এখন সেসব কথা শোনা যায় না। বরং শোনা যায় মোকাবিলার কথা। যুদ্ধের ছায়ার বিস্তার ঘটছে চারিদিকে। পহেলা জুনে মুদ্রিত দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে এশিয়ার দেশগুলোকে সামরিক ব্যয় বাড়াতে বলেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। তার ভাষ্য, এতে চীনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রতিরোধ শক্তি বাড়ানো যাবে। তিনি বলেন, তাইওয়ান দখলের পরিকল্পনায় চীন এখন বাস্তব যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে। এখানে প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধের মহড়া কি চীন একাই দিচ্ছে? সিঙ্গাপুরে শাংরি-লা সংলাপে গত শনিবার বক্তব্য প্রদানকালে পিট হেগসেথ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি একাধিক নতুন যৌথ প্রকল্পের রূপরেখা তুলে ধরেন, যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে সামরিক জাহাজ ও যুদ্ধ বিমান মেরামতের সুযোগ সম্প্রসারণ।
পিট হেগসেত বলেন, ভারত-প্রশান্ত মহানাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং তা উচিতও। তিনি আরও বলেন, সবাইকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, বেইজিং সত্যিকার অর্থেই এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনে সামরিক শক্তি ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একে ঢেকে রাখার কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘চীন যে হুমকি তৈরি করেছে, তা বাস্তব এবং খুব শিগগিরই কার্যকর হতে পারে।’ হেগসেথ জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজ নিজ অঞ্চলের সংঘাত মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে এবং দায়িত্বের বোঝা ভাগ করে নিতে চাপ দিয়েছিল। এখন এশীয় দেশগুলোর জন্যও একই কাজ করার সময় এসেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউরোপীয় দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে চাপ দিয়েছিল। এখন এশীয় দেশগুলাকেও একই পথে হাঁটার জন্য বলছে। উদ্দশ্য চীনের মোকাবিলা। ভূরাজনীতি ও প্রতিরক্ষা খাতের হালচাল নিয়ে চীনও বেশ সতর্ক। ইউক্রেন যুদ্ধে বিভিন্ন বলয়ের তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করেছি। রাশিয়ার সমর্থনে এগিয়ে এসেছে চীন, উত্তর কোরিয়াসহ আরও কিছু দেশ। অপরদিকে ইউক্রেনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো, এদের আর এক পরিচয় ‘পাশ্চাত্য’। কিন্তু ‘পাশ্চাত্যে’ এখন আমরা বিভক্তি লক্ষ্য করছি। আমেরিকা এখন ইউরোপকে বলছে, নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিজেরাই দেখ? প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি কর। ইউরোপীয় দেশগুলো ইতিমধ্যে সেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া প্রতিরক্ষা খাতের উন্নয়নে আগে থেকেই ব্যস্ত রয়েছে। চারিদিকে এখন প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির উন্মাদনা। অর্থাৎ প্রতিদিনই এখন উৎপাদিত হবে নিত্য-নতুন মারণাস্ত্র। মারণাস্ত্র তো ঘুমিয়ে থাকার জন্য উৎপাদিত হবে না। মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় বপিত রয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের বীজ। সে ধ্বংস ত্বরান্বিত করার ‘মহৎকর্মে’ এখন ব্যস্ত রয়েছে পৃথিবীর ‘মহান পরাশক্তিবর্গ’!
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান ভন ডার লেন বলেন, বৈশি^ক মঞ্চে গভীর পরিবর্তনের এ সময়ে একটি ‘সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ইউরোপ’ গঠন প্রয়োজন। ভন ডার লেন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের কারণে যে, নিশ্চিত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে’। তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, বিশ^ এখন আবার সা¤্রাজ্যবাদী উচ্চাশা ও যুদ্ধের ছায়ার মধ্য চলে গেছে। ইইউ প্রধান বলেন, ‘আমাদের উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিপক্ষরা আবার নিজেদের সজ্জিত করেছে, সংগঠিত হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের নির্মম ও নিষ্ঠুর যুদ্ধের চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না।’ ভন ডার লেন আরও বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো শতশত বিনিয়ন ইউরো প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে, যা সময়ের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আমরা এটি করছি শান্তিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।’ ইইউ প্রধান আরও বলেন, ‘এ দশকে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। যদি আমরা এর ফলাফল মেনে নিতে না চাই, তাহলে আমাদেরকেই এ নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’ ভন ডার লেন আরও বলেন, ‘ইতিহাস কখনো দ্বিধা বা বিলম্বকে ক্ষমা করে না। আমাদের মিশন হচ্ছে ইউরোপীয় স্বাধীনতা।’
ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রধান ‘ ইউরোপীয় স্বাধীনতার’ কথা বললেন। বর্তমান বিশ^ব্যবস্থায় সংকটটা আর লাল-সাদা বলয়ে সীমাবদ্ধ নেই। পাশ্চাত্যও এখন বিভক্তির মধ্যে পড়ে গেছে। ট্রাম্পের আমেরিকার সাথে এখন ইউরোপের আদর্শিক দ্বন্দ্ব চোখে পড়ার মতো। জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস এখন বলছেন, ‘আমরা শুধু দর্শক হয়ে থাকবো না, আমাদের মহাদেশে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানব মর্যাদাকে রক্ষা ও শক্তিশালী করার ব্যাপারে জার্মানি সক্রিয়া ভূমিকা রাখবে।’ লক্ষণীয় বিষয় হলো, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবার ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ইউরোপের দেশগুলোকে চিহ্নিত করে বিষোদগার করলেন এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও একই মাসে ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে অপমান করলেন। এসব দেখে ইউরোপীয়রা একটি কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করলো, আর তা হলো-ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো ইউরোপের পক্ষে নেই। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ট্রান্স আটলান্টিক অর্থাৎ ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে থাকা জোট এখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ বা দেশগুলোর নেতাদের দিকেই ট্রাম্পের আক্রমণ সীমাবদ্ধ নেই; বরং পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার টার্গেটে পড়ে গেছে।
ট্রাম্প এখন ইইউকে ঘৃণা করেন। তার বিবেচনায় ইইউ একটি অতিরাষ্ট্রভিত্তিক (সুপারন্যাশনাল) উদারপন্থী প্রকল্প। এটি ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে অবস্থান করছে। ট্রাম্প মনে করেন, ইইউ ও ন্যাটো দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছে ইউরোপের দেশগুলোকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রান্স আটলান্টিক অর্থাৎ ইউরোপ-আমেরিকার জোটে এখন যে বিভাজন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা শুধু ভূ-রাজনৈতিক নয়, আসল বিভাজন আদর্শগত। একদিকে রয়েছেন ট্রাম্প, ওরবানসহ চরম ডানপন্থী স্বৈরশাসকদের উত্থান, অপরদিকে রয়েছে উদার গণতন্ত্রে বিশ^াসী উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা। এমন বাস্তবতায় এই দশকে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। এ ব্যাপারে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া সচেতন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো নতুন বিশ^ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে চাইছে। কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ^ কতটা সচেতন? মুসলিম প্রধান দেশের সংখ্যা অনেক, আছে বিশাল জনসংখ্যা, সম্পদও কম নয়। একটি অর্থপূর্ণ জোট গঠনের সামর্থ মুসলিম দেশগুলোর আছে। কিন্তু তারা সে পথে অগ্রসর হবেন কী? শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন আর কতকাল? চলতি দশকের নতুন বিশ^ ব্যবস্থায় শুধু কি দর্শক হয়ে থাকবেন মুসলিম নেতৃবৃন্দ, নাকি পরিচালনায়ও ভূমিকা রাখবেন?