রাজনীতিতে আলোচনা থাকে। এখন আলোচনার বিষয় হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান এবং মধ্যপন্থার রাজনীতি। কিছুদিন আগে মৃত্যুর পূর্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বাম রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর এক সমাবেশে বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রগতিশীলরা এখন মোটামুটি বিলুপ্ত। মধ্যপন্থীরাও দিনদিন সংকুচিত হচ্ছেন। এমন অবস্থায় তিনি বিএনপির ওপর ভরসা করতে চেয়েছেন। তবে তার বিবেচনায় বিএনপি একটি হাইব্রিড বা দো-আঁশলা দল। তাদের মধ্যে আছে একটু একটু জামায়াত, আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, মুক্তিযোদ্ধা, বামপন্থীÑসবই। জাতীয়তাবাদ বিএনপির মূল স্লোগান। কিন্তু আজকাল জাতীয়তাবাদ তার পূর্বগৌরব হারিয়ে ফেলেছে। জাতীয়তাবাদী দলগুলো জাতীয়তাবাদকে দলীয় সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে বারবার, বড় তাঁবু গড়তে পারেনি। প্রসঙ্গত বিএনপি সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরের ধারণার কথা আমরা জানলাম। দলটি সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের আরো আলোচনা-পর্যালোচনা আছে, তা এখানে তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ আমাদের আজকের মূল বিষয় দক্ষিণপন্থার উত্থান এবং মধ্যপন্থার রজানীতি।
বদরুদ্দীন উমর তার আলোচনায় বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রগতিশীলরা এখন মোটামুটি বিলুপ্ত। মধ্যপন্থীরাও দিন দিন সংকুচিত হচ্ছেন। ফলে প্রশ্ন জাগে, মধ্যপন্থী রাজনীতি যদি আসলেই দুর্বল হতে থাকে, তবে তার স্থান দখল করবে কে? এমন প্রশ্নও আছে, মধ্যপন্থার রাজনীতি কি আসলেই দুর্বল হচ্ছে? কেউ কেউ আবার মধ্যপন্থার বিপরীতে দক্ষিণ পন্থাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন। এমন আলোচনায় বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপন্থার রাজনীতি যদি দুর্বল হয়ে থাকে, তবে সে স্থান দখল করবে কে? তথাকথিত প্রগতিশীল ও বামরা যখন দৌড়ে নেই, তখন ধর্ম-দর্শনভিত্তিক রাজনীতি সে শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসবে এবং এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য এদেরকে কেউ বলছেন ডানপন্থী, কেউবা দক্ষিণপন্থী। এ আলোচনায় মুখ খুলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, জুলাই অভ্যুত্থানের পরে কি শুধু দক্ষিণ পন্থীদেরই উত্থান ঘটেছে, বিএনপিরও কি উত্থান ঘটেনি? বিএনপি নিজেদের মধ্যপন্থার দল হিসেবে অভিহিত করতে চায়। ধর্ম-দর্শনভিত্তিক প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীও নিজেদের মধ্যপন্থী দল হিসেবে দাবি করে। তারা আরও বলেন, ইসলামই আমাদের মধ্যপন্থী হতে অনুপ্রাণিত করেছে। দক্ষিণপন্থীদের উত্থান প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের আগে বিএনপির অবস্থা কেমন ছিল? বিএনপির নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার ছিল না। জেল-জুলুম, গুম ছিল তাদের ভাগ্যলিপি। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে গেলেই নেমে আসতো জুলুম-নির্যাতন। হতাহত হয়েছেন বিএনপির বহু নেতা-কর্মী। একই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদেরও। বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে তাদের অফিসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সভা-সমাবেশের অধিকার ছিল না। ঘরোয়া বৈঠক করলেও গ্রেফতার করা হতো। মহিলা কর্মীদেরও রেহাই দেওয়া হতো না। নিষ্ঠুর নির্যাতন, গুম, হত্যা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। তবে জুলাই বিপ্লবের পর সেই দুঃসময় কেটে গেছে। বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা এখন মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে পারছেন। পারছেন বড় বড় সভা-সমাবেশ করতে। জেল-জুলুম ও গুমের আতঙ্ক নেই। এমন পরিবেশে জামায়াতের স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্যকে যদি দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হিসেবে অভিহিত করা হয়, তাহলে বিএনপির বড় বড় শোডাউনকে কোন নামে অভিহিত করা যাবে? একই নামে অভিহিত করাই কি সঙ্গত নয়? আসলে একই রকম তৎপরতাকে একই নামে অভিহিত করাই সমীচীন। এখানে তারতম্য ঘটলে রাজনৈতিক ন্যায্যতা এবং যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতাকে আসলে উত্থান হিসেবে অভিহিত করা যায় না। শুধু সভা-সমাবেশ দিয়ে কোনো উত্থান হয় না। কোনো রাজনৈতিক উত্থানের জন্য প্রয়াজন হয় রাজনৈতিক দর্শন, যৌক্তিক কর্মসূচি, প্রশিক্ষিত নেতা-কর্মী, নৈতিক মান, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং জনকল্যাণের চেতনা। এসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আবেগঘন বক্তব্য প্রদানে পারঙ্গম হলেও কর্মক্ষেত্রে সক্ষমতার পরিচয় দিতে তেমন সমর্থ হন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই হলো মূল সংকট, কথা ও কাজে গড়মিলের সংকট। ফলে রাজনীতির গতিপথে পড়ে যায় যতি চিহ্ন। এমন যতি চিহ্ন নিয়ে দক্ষিণপন্থা কিংবা মধ্যপন্থার উত্থান সম্ভব নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যোদ্ধারা এই যতি চিহ্ন সরাতে চান, অচলায়তন ভাঙতে চান। প্রচলিত রাজনীতির সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি, দোষারোপ ও চরিত্র হননের তৎপরতা নতুন প্রজন্ম দেখতে চায় না। ভুক্তভোগী জনগণও প্রচলিত রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তারা কথা ও কাজে মিল দেখতে চান। এটা তো নীতি ও নৈতিকতার বিষয়, ত্যাগ-তিতিক্ষার বিষয়, যোগ্যতাকে শাণিত করার বিষয়। মেদ বহুল স্থূল রাজনীতি দিয়ে কথা-কাজে মিল রাখা সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন নীতিনিষ্ঠ স্লিম ও স্মার্ট রাজনীতি। যা লক্ষ্য করা গেছে এবার ডাকসুর রাজনীতিতে।
বিএনপি মধ্যপন্থী রাজনীতির কথা বলে, একই কথা বলে জামায়াতে ইসলামীও। তাহলে ‘মধ্যপন্থা’ বিষয়টা আমরা কোথায় খুঁজবো? মধ্যপন্থা কি কোনো আদর্শের নাম, নাকি কর্মপন্থা বা আচরণের নাম? পৃথিবীতে মানুষ তো একরকম আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেনি, মানুষের রাজনীতিতে বিভিন্ন দর্শন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ এবং ধর্ম-দর্শনভিত্তিক রাজনীতি। এখন কোনটিকে আমরা মধ্যপন্থা হিসেবে অভিহিত করবো? এখানে বোধহয় সমস্যা আছে। আসলে মধ্যপন্থা আমাদের খুঁজতে হবে দলগুলোর কর্মপন্থা বা আচরণে। শুধু দাবির কারণে কিংবা কথামালার চাতুর্যে কেউ মধ্যপন্থী হয়ে যাবেন না। মধ্যপন্থী রাজনীতির কর্মসূচি ও কর্মপন্থায় সীমালঙ্ঘন থাকবে না, উগ্রতা থাকবে না, বাড়াবাড়ি থাকবে না। বরং দেশ ও জনগণের কল্যাণে থাকবে ছাড় ও সমঝোতার মনোভাব। আদর্শ বিসর্জন না দিয়েও এ কাজটি করা যায়। অবশ্য এর জন্য প্রয়োজন হবে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য খোঁজার মতো দার্শনিক মনন। মধ্যপন্থার রাজনীতির জন্য কিছু বিষয় বর্জনও আবশ্যক। এখানে ক্ষুদ্র স্বার্থ, অহংকার ও পেশি শক্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
মধ্যপন্থার রাজনীতি করার ক্ষেত্রে জামায়াতের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। শুধু জামায়াত কেন, ইসলামের ধর্ম-দর্শনে বিশ^াসী যে কোনো দল এ সুবিধা পেতে পারে। কারণ, মুসলমানদের বলা হয় ‘মধ্যপন্থী উম্মত’। পবিত্র কুরআনে সূরা আল বাকারার ১৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাদেরকে (উম্মাতাও ওয়াসাতা) মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের উপর....।’ এছাড়া সহী বুখারির হাদিসে রাসূল (স.) বলেছেন, ‘.....মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে।’ যারা ইসলামী ধর্ম দর্শনের আলোকে রাজনীতি করেন, তাদেরতো মধ্যপন্থা অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই। কারণ তাদের নবী বলেছেন, মধ্যপন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। এমন বক্তব্য জামায়াতসহ অন্যদের মধ্যপন্থা অবলম্বনের ব্যাপারে বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে।
বর্তমান সেক্যুলার তথা ইহলৌকিকবাদী সভ্যতায় ইসলামী ধর্ম-দর্শনের রাজনীতি করা কোনো সহজ বিষয় নয়। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বোধ-বিশ^াসে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। পাশ্চাত্যের শাসনে যে বিশ^ব্যবস্থা, সেখানে ইহলোকটাই সবকিছু, পরলোকের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। ¯্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টিও তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। সভ্যতার যে চৎড়ফঁপঃরারঃু বা উৎপাদনশীলতা, তার ভিত্তি পর্যালোচনা করলে আমরা উপলব্ধি করবো, কেন আর একটি বিশ^যুদ্ধের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হচ্ছে। এখনকার প্রোডাক্টিভিটির ভিত্তি হলো- ১. বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কা-জ্ঞানহীন চর্চা। ২. শিল্প বিপ্লবের নামে ‘পারসোয়েড অব ম্যাটেরিয়ালিজম’-এর চর্চা, যা মানুষকে টাকার পেছনে অন্ধের মত ছুটতে বাধ্য করছে। ৩. সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বহিষ্কার।
প্রোডাক্টিভিটির এ তিন ভিত্তি শাসকদের ছোট ছোট প্রভুতে পরিণত করেছে। স্বার্থান্ধতা ও দম্ভের কারণে এসব প্রভুরা আবার পরস্পরের শত্রু। শত্রুদের মধ্যে রয়েছে আস্থার সংকট। ফলে পরস্পরকে ঘায়েলের লক্ষ্যে তাদের মধ্যে চলছে মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। ভূরাজনীতির নামে বিভিন্ন এলাকায় তারা লাগিয়ে রেখেছেন যুদ্ধ। মহান প্রভুতো এ বিশ^কে মানববান্ধব করে সষ্টি করেছেন, কিন্তু বর্তমান সভ্যতার ক্ষুদ্র প্রভুরা সে ভারসাম্য বিনষ্ট করে সৃষ্টি করেছে জলবায়ু সংকট, পরিবেশদূষণসহ নানা বিপর্যয়। এসব করা হয়েছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চর্চার নামে! বর্তমান সভ্যতার ক্ষুদ্র প্রভুরা লাল কিংবা সাদা, যে পতাকাই ওড়ান না কেনÑ তারা কিন্তু মানবমুক্তির পথে নেই। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা কিংবা উৎপাদন ও বন্টনে ইনসাফের চেতনা তাদের নেই। শোষণ-শাসন ও বঞ্চনা এসব নেতাদের প্রিয় বিষয়। তারা আলোকিত সভামঞ্চে প্রগতি ও উন্নয়নের যত কথাই বলুন না কেন, তারা আসলে মনোজাগতিক উগ্রতা ও বর্ণবাদের দাস। মানবিক বিশ^ নির্মাণের জন্য, সবাইকে নিয়ে বাঁচার জন্য যে মধ্যপন্থা প্রয়োজন, তা ধারণে সভ্যতার শাসকরা অক্ষম। তাদের অনুসরণে কোনো নেতা বা দলের পক্ষে কি সম্ভব মধ্যপন্থার রাজনীতি করা?