হাসনা হেনা
পালিত স্নেহের লালিত সৌহার্দ্যে ভরা জীবন কানায় কানায় পূর্ণতার পরেও হারায়। যে পূর্ণতার খুঁটিতে বাঁধা থাকে কিছু অমর বাণী, কিছু চিন্তার মৌলিকত্ব। এক মনীষীর বাণী -“যেদিন তুমি হাসলে না, তোমার সে দিনটা নষ্ট। চোখের পানি মোছার জন্য আমি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হাটি।”
একমাত্র বৃষ্টিই পারে চোখের পানির সাথে মিশে যেতে। আর পারে ধৈর্য, সয্য এবং আমাদের সহিষ্ণুতা। কারণ প্রতিনিয়ত আমরা নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হই, খেই হারাই। একদিন বিদায় নেই দুনিয়া থেকে। বিদায়টা যদি স্বাভাবিক হয়, তবে কথা থাকে না, কষ্ট থাকে। কারণ মৃত্যু মানেই কষ্ট। আর সে মৃত্যু যদি অসময়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তখন কষ্ট, ব্যথা, বেদনা সব থাকে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এরকম বেদনা বিধূর কয়েকটি ঘটনার খবর সম্প্রতি এসেছে পত্রিকায়। রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ তিন জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামে র্যাবের এক অফিসার আত্মহত্যা করেছেন। ঢাকায় নিহতরা হলেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শিহাবুল ইসলাম (২৪), যাত্রাবাড়ী দনিয়া এ কে স্কুলের প্রিয়ন্তী সরকার (১৪) ও উত্তর বাড্ডার গৃহিণী বিথী আক্তার (১৯)। মৃত শিহাবুল ইসলামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামে। রাজধানীর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী শিহাবুল। স্কলারশিপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়ালেখা করতেন তিনি। তবে সম্প্রতি তার পড়ালেখা ভালো যাচ্ছিল না এবং তার স্কলারশিপটি থাকবে না বলে ধারণা করছিলেন তিনি। যাত্রাবাড়ী দনিয়া এ কে স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়ন্তী। তবে পড়ালেখা নিয়ে উদাসীন ছিল সে। এজন্য সোমবার রাতে বাবা এবং ভাই তাকে কিছুটা বকাঝকা করেন। সে অভিমান নিয়ে গতকাল রাতে রুমের দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেয় সে।
উত্তর বাড্ডা আব্দুল্লাহবাগ মোড়ে একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় স্বামী এবং পরিবারের সঙ্গে থাকতেন বিথী আক্তার। পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে রাতে রুমের দরজা বন্ধ করে গ্রিলের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেন বিথী। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে র্যাব-৭ ক্যাম্পে নিজের কক্ষ থেকে গোপালগঞ্জ নিবাসী পলাশ সাহার (৩৭) মাথায় গুলীবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় পাশে একটি চিরকুটও পাওয়া যায়। তিনি মৃত্যুর জন্য ক্উাকে দায়ী করেননি। তবে স্ত্রীর সাথে বিরোধের কথা জানা যায়। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া একজন উজ্জ্বল অফিসারের পারিবারিক অশান্তির জেরে জীবনহানি কারোরই কাম্য ছিল না। সবগুলো ঘটনাই দুঃখের। এগুলোর পেছনে পারিবারিক অশান্তিই প্রধান।
পারিবারিক অশান্তি যেটাকে আমরা বলতে পারি অবর্ণনীয় কষ্টের অন্তহীন পথ। যে পথে অনেকের জীবন হারায় যা কখনো ফেরত আসে না। পারিবারিক অশান্তি জীবনে কতটা নেগেটিভ ভূমিকা রাখে তা সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচলের প্রতিবেদন দেখলেই বুঝা যায়। বর্তমানে দেশে আত্মাহত্যা বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছেলেরা এগিয়ে, বাংলাদেশে মেয়েরা। আত্মহত্যার বড় কারণ অভিমান। আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুর জরিপ কষ্টসাধ্য। কারণ বছরে বছরে এর রকম ফের আলাদা হয়। তবুও ২০২৪সালের একটা জরিপ থেকে জানা যায় অভিমান থেকে ১৬৫ জন, প্রেমঘটিত কারণ ১৫শতাংশ, মানসিক কষ্টে ১০ শতাংশ, পারিবারিক কলহ ৬শতাংশ, পারিবারিক নিপীড়নের শিকার ১শতাংসের বেশি, পরীক্ষায় অকৃতকার্য ২ শতাংশ, যৌন হয়রানির শিকার ৩ শতাংশ, অপমানবোধ থেকে ১ শতাংশ।
প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষ হচ্ছে বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন। “আশরাফুল মখলুকাত” সৃষ্টির সেরা। পারিবারিক অশান্তিতে ধূলিসাৎ হয় সে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি যা কোন পদ, পদবী, অর্থ, বিত্ত কিংবা নির্দিষ্ট কোন বয়স সীমার মধ্যে আটকে থাকে না যার জলজ্যান্ত উদাহরণ চিত্র নায়ক রিয়াজের শ্বশুর মহসিন খান। যিনি ৫৮ বছর বয়সে আত্মাহত্যা করেন। রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সাদি মোহাম্মদ যিনি ৭১ বছর বয়সে আত্মাহত্যা করেন।
জীবন যেমন পুষ্প শয্যা নয় জীবন তেমনি কাঁটায় ভরাও না। দুঃখ-কষ্ট জীবনের নিত্য সংগী। যে মৃত্যু আমাদের কাম্য নয় সে মৃত্যু থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। খুঁজতে হবে পরিত্রাণের উপায়। সেক্ষেত্রে কতগুলি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
হত্যা পাপ,আত্মাহত্যা মহাপাপ। এ মহাপাপের শাস্তি মহা হবে এটাই স্বাভাবিক। কুরআন ও হাদিসের আলোকে এ সত্যকে গভীরভাবে বুকে লালন করতে হবে। মানুষের জীবনের মালিক আল্লাহ। তিনি জন্ম দান করেন, তিনিই মৃত্যু দান করেন। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন -”জীবন মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী। অত:পর তোমারা আমার কাছেই ফেরত আসবে” (সুরা- আনকাবুত -আয়াত ৫৭)।
ইসলামে আত্মহত্যা হারাম। এ ব্যাপারে নবী করিম (স:) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মাহত্যা করবে জীবন যাওয়ার পরে ও তার সে যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি ধারালো ছুরি দিয়ে অত্মহত্যা করবে জাহান্নামে ও তার সে যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। কেউ ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলে তার অবস্থাও একই রকম হবে। নবী করিম (সা:) আত্মহত্যাকারীর জানাজাতে অংশ গ্রহণ করতেন না। জাবির ইবনে সামুরা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা:) দরবারে এক ব্যাক্তি এসে হাজির হন এবং জানান তীরের ফলার সাহায্যে এক ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করেছে। প্রিয় নবী তার জানাজা পড়াননি। শরীয়তের বিধান মতে আত্মাহত্যাকারীর জানাজা হয় তবুও তিনি কোন আত্মাহত্যাকরীর জানাজা পড়াননি, সাহাবিদের দিয়ে পড়িয়েছেন।
হিন্দু ধর্মেও আত্মহত্যা মহাপাপ, আধ্যাতিকভাবে অগ্রহনযোগ্য। হিন্দু ধর্ম মতে যারা আত্মহত্যা করে, তারা অধোগতি প্রাপ্ত হয় এবং পূনরজন্ম চক্রে আটকে যায়।
এক যন্ত্রণা কাতর সুধার নাম জীবন। এ যন্ত্রণা কখনো নিরাময়যোগ্য, কখনো নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিরাময়যোগ্য না হলেও নিয়ন্ত্রণযোগ্য যন্ত্রণা হচ্ছে পারিবারিক কলহ। এখানে মানবিক দৃষ্টি ভংগি বাড়ানো অতি জরুরি। জেদ কিংবা একগুয়েমি কখনো মংগল করতে পারে না। পারিবারিক কলহে কেউ কেউ ডিপ্রেস্ড হয়ে যায়। নীরবে নিজেকে শেষ করে দেয়ার ছক কষতে থাকেন। এযেন পাটা পুতায় ঘষাঘষিতে মরিচের দফা শেষ। এ ঘষাঘষির বড় শিকার হলেন উপরে বর্ণিত চার জন।
এভাবে জীবনদান কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে মহাকালের মহাপথের যাত্রী আমরা। মাঝখানের এ জীবনটা খুব ক্ষণস্থায়ী। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন “কুল্লু নাফছিন যায়কাতুল মাওত” প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদ করতে হবে মৃত্যু” সুরা আল ইমরান আায়াত-১৮। এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে আজ আছি, কাল নেই। কাজেই আত্মহত্যার ত প্রশ্নই আসে না, আরও প্রশ্ন আসে না দুঃখ,কষ্ট, ঘৃণায়, অবহেলায় জীবন ধংস করার। আল্লাহতায়ালা সবাইকে এ সত্যটা বুঝার তৌফিক দান করুন।
লেখিকা : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ।