মহাবিশ্বের ছোট্ট একটি গ্রহ আমাদের প্রিয় পৃথিবী। আজকে আমি গ্রহের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে যাচ্ছি না, জলবায়ু সঙ্কট নিয়েও কথা বলবো না। তবে পৃথিবীটা যে ক্রমেই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে, সে প্রসঙ্গে তো কথা বলতেই হবে। অথচ মহান স্রষ্টা প্রিয় পৃথিবীটাকে মানববান্ধব করেই সৃষ্টি করেছিলেন, স্বল্পজ্ঞানের মানুষদের জন্য দিয়েছিলেন পথ চলার জীবন বিধানও। এ নেয়ামতকে অবজ্ঞা করে অহংকারী মানুষ মানুষের ওপর প্রভুত্ব করতে চেয়েছে। প্রণয়ন করেছে বিবিধ রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং ভূরাজনীতির কর্মকৌশল। এ কর্মকৌশল বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় তৈরি করেছে আস্থার সঙ্কট, যার অনিবার্য পরিণতি মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতা। ফলে মানবজাতি এখন বসবাস করছে গোলা-বারুদে আকীর্ণ বিপদসঙ্কুল এক বৈজ্ঞানিক সভ্যতায়। এমন সভ্যতার প্রভাব পড়েছে বিশ্বরাজনীতিতে। এ রাজনীতিতে ন্যায়নীতি বা মানবিক দর্শনের কোনো জায়গা নেই। বাহুবল তথা মারণাস্ত্র শক্তিই শেষ কথা। বিশ্বরাজনীতিতে যে যার মত কথা বলছে। এখানে কোন মানদণ্ড নেই। আঞ্চলিক রাজনীতিতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানদ-ের জন্য তো প্রয়োজন শাশ্বত বিধান। সভ্যতার শাসকরা তো বহু আগেই সে বিধান থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। যার ফলাফল মহাযুদ্ধ, আঞ্চলিক যুদ্ধ, বিষাক্ত ভূরাজনীতি এবং মারণাস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অঙ্গনে মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। এ দৌরাত্ম্যের মধ্যে বসবাস করাই কি আমাদের ভাগ্যলিপি?
বিশ্বরাজনীতির কথা বলছিলাম। এ রাজনীতিতে অন্যায় ও অসঙ্গতি খুবই প্রবল। আরও গভীর বিষয় হলো-সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ ও উগ্রতার শিকার যারা; তারাই ওইসব অপবাদে কালিমালিপ্ত হয়ে এখন আসামীর কাঠগড়ায়। এমন অদ্ভুত এক সভ্যতায় এখন আমাদের বসবাস। এমন বাতাবরণে আমরা জোহরান মাদানির গল্পটা শুনতে পারি। এ গল্পটা হয়তো আমাদের বিশ^রাজনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির মুখোশ কিছুটা হলেও উন্মোচন করতে পারবে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আগামী নবেম্বর অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হলে জোহরান মামদানি হবেন এ শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র। সেই সঙ্গে শহরটির প্রথম মুসলিম ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়রও হবেন তিনি। জোহরানের এমন পরিচয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক বিশেষ অগ্রণী মুখে পরিণত করেছে। তবে এটিই আবার ভারত এবং প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র বিতর্ক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২৪ জুন ডেমোক্রেটিক পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচনে (প্রাইমারি) ব্যাপক ব্যবধানে জেতার পর থেকেই জোহরানের প্রচারাভিজান ঘিরে একের পর এক বিদ্বেষমূলক মন্তব্য আসতে শুরু করে। এর একটি অংশ আসছে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী মহল থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব আক্রমণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থকদের দিক থেকে আসছে। এ আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জোহরানের ধর্মীয় পরিচয়। ৩৩ বছর বয়সী এ রাজনীতিবিদ একজন মুসলিম। অনেকেই তাকে ‘জিহাদি’ ও ‘ইসলামপন্থী’ আখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার বলছেন, তিনি হিন্দুবিরোধী ও ভারতবিরোধী। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেট’ (সিএসওএইচ)-এর গবেষণা পরিচালক কায়লা ব্যাসেট মনে করেন, জোহরানকে আক্রমণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কেই নিশানা করা হচ্ছে। কায়লা আরও বলেন, ‘এটা শুধু একজন ব্যক্তি নিয়ে নয়। এটি এক ধরনের বর্ণনাকে জোরদারের চেষ্টা- মুসলিম মানেই ‘সন্দেহের পাত্র’ অথবা তারা আমেরিকান হতে পারেন না।’
নবেম্বরে জোহরান লড়বেন সুপরিচিত ও অভিজ্ঞ প্রার্থীদের সঙ্গে। ধারণা করা হচ্ছে, চূড়ান্ত ভোটে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস। ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে তার প্রতিপক্ষ সাবেক গভর্ণর অ্যান্ড্রু কুমো এখনো স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বাতিল করেননি। তবে নিজের মুসলিম পরিচয়কে যেভাবে সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন জোহরান মামদানি, সেটাই আজ তাকে এগিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মুসলিম বিদ্বেষের আশঙ্কা যেভাবে বাড়ছে, মামদানি তার সঠিক জবাব হতে পারেন। মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে বারবার মুখ খুলেছেন জোহরান-তা গাজায় হোক কিংবা ভারতে। জোহরানের এমন স্পষ্ট অবস্থানের জন্য শুধু তার দেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরাই নন, বিদেশের অনেকেও সমালোচনা করেছেন। উল্লেখ্য, জোহরানের এসব বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। বিজেপি সদস্যরা প্রশ্ন তুলেছেন, মেয়র পদে তাঁর উপযুক্ততা নিয়ে। প্রাথমিক নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর বিজেপিপন্থী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘আজতক’ এক প্রতিবেদনে দাবি করে, জোহরান এমনসব সংগঠন থেকে অর্থ সহায়তা পেয়েছেন, যারা ভারতবিরোধী কাজ করে থাকে। এছাড়া প্রতিবেদনে নিউইয়র্কে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন এক ধারণায় উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি পর্দায় আবৃত নারীদের ভিডিওচিত্রও দেখানো হয় গণমাধ্যমটিতে। তবে জোহরানের বিরুদ্ধে প্রচারনা শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্রেও কিছু প্রবাসী ভারতীয় গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। নিউ জার্সিভিত্তিক সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান আমেরিকানস ফর কুমো’ ৩ হাজার ৫৭০ ডলার খরচ করে নিউইয়র্ক শহরের আকাশে উড়োজাহাজ উড়িয়ে একটি ব্যানার প্রদর্শন করেছে। তাতে লেখা ছিল, ‘গ্লোবাল ইন্তিফাদা থেকে নিউইয়র্ককে বাঁচান। মামদানিকে প্রত্যাখ্যান করুন।’ এখানে উল্লেখ্য, ভারতীয়দের নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে বিশেষ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও নরেন্দ্র মোদির সমালোচনায় জোহরান মামদানির রয়েছে সরব অবস্থান। ২০২৩ সালে মোদির নিউইয়র্ক সফরের আগে জোহরান মামদানি জেলে থাকা ভারতীয় অধিকার কর্মী উমর খালিদের লেখা পাঠ করে শোনান। উল্লেখ্য, উমর খালিদ বিচার ছাড়াই ২০২০ সাল থেকে কারাগারে আছেন ‘সন্ত্রাসবাদের’ মামলায়। মোদি সরকারের সমালোচনা করেছিলেন উমর খালিদ। অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মেয়র প্রার্থীদের এক টাউন হলে জোহরানকে প্রশ্ন করা হয়, মোদি নিউইয়র্ক এলে তিনি দেখা করবেন কিনা? স্পষ্ট উত্তরে জোহরান বলেন, ‘না, করবেন না। তিনি একজন যুদ্ধাপরাধী।’ জোহরান বলেন, ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গার সময় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদি সহিংসতা থামানোর জন্য কিছুই করেননি। ওই ঘটনার পর ধর্মীয় স্বাধীনতার চরম লংঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র মোদিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জোহরান বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি পরিকল্পিতভাবে গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন। এমন অবস্থা হয়েছে যে, অনেকেই তো বিশ্বাসই করতে চান না, এখনো গুজরাটে মুসলমান আছে। যখন বলি, আমিগুজরাটি মুসলিম, তখন সবাই অবাক হয়ে যান।
মোদির বিরুদ্ধে, বিজেপির বিরুদ্ধে জোহরান মামদানির দাঙ্গা, বিদ্বেষ তথা সাম্প্রদায়িক উগ্রতার যে অভিযোগ তা কি নিছক কোনো রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, নাকি এর কোনো যথার্থ ভিত্তি আছে? এ প্রসঙ্গে আমরা ভারতভিত্তিক মামনবাধিকার রক্ষা সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটসের (এপিসিআর) জুন মাসের শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করতে পারি। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ (হেট ক্রাইম) বেড়েই চলেছে। শুধু মুসলিম ও খৃস্টান নয়, দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও বিদ্বেষমূলক অপরাধ বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদের সরকারের প্রথম বছরে এ ধরনের অপরাধের হার মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এ সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী-সেসব ঘটনায় রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মদদ, তাদের উৎসাহদান এবং সামাজিক-রাজনৈতিক আদর্শগত পরিবর্তনগুলো এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুনে নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় দফার শাসন শুরুর পর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে ৯৪৭টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪৫টি বিদ্বেষমূলক ভাষণ, বাকি ৬০২টি বিদ্বেষমূলক অপরাধ-যাতে হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর সরাসরি আক্রমণ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ৬০২ ঘৃণা অপরাধের ঘটনার মধ্যে ১৭৩টিতে সংখ্যালঘুরা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫টি ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিহত হয়েছেন এবং তাঁদের সবাই মুসলিম। এ এক বছরে বিদ্বেষমূলক অপরাধে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ জন হিন্দুও আছেন। অবশ্য তাঁরা আক্রমণের মূল নিশানা ছিলেন না। ঘটনাস্থলে থাকার কারণে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্বেষমূলক অপরাধ সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে। বিদ্বেষমূলক ভাষণ ও অপরাধের প্রবণতাও এসব রাজ্যে বেশি। আরও দেখা গেছে, যে রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে সেখানে নির্বাচনী প্রচারে বিদ্বেষমূলক ভাষণ বেশি হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয়মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা বিদ্বেষমূলক ভাষণ দিচ্ছেন। এ বিদ্বেষমূলক ভাষণ অপরাধ ও অপরাধীদের সমর্থন ও মদদ দিচ্ছে। ভারতের মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন এপিসিআর-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বলতে হয়; মোদির বিরুদ্ধে, বিজেপির বিরুদ্ধে জোহরান মামদানি দাঙ্গা, বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক উগ্রতার যে অভিযোগ এনেছেন তার ভিত্তি আছে। বিষয়টি কোনো রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা নয়। অথচ বর্তমান সভ্যতায় মজলুম মুসলমানদের বিরুদ্ধেই সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রতার অভিযোগ বেশি আনা হচ্ছে। জোহরান মামদানি এর এক বড় উদাহরণ। ফলে প্রশ্ন করা যায়, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার শিকার মজলুম মুসলমানরা কেন সভ্যতার কাঠগড়ায়। এর চাইতে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে?