কওমী মাদরাসা শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা। এ শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভালো মানের আলেম তথা সুনাগরিক তৈরি করা; যারা দ্বীন, দেশ ও জাতির খেদমত করবে যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সাথে। মূলত, কওমী ধারার মাদরাসা শুধু বাংলাদেশ নয় বরং ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত প্রধান দু’ধারার মাদরাসার মধ্যে একটি। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধারার মাদরাসা শিক্ষা চালু আছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত ও দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ, মূলনীতি ও মত-পথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিকসহ সার্বিক সহযোগিতায় বরণ্যে আলেমদের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রগুলো কাওমী মাদরাসা হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের এক ক্রান্তিকালে ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের গোড়াপত্তনের মাধ্যমে এ ধারার শিক্ষা পদ্ধতির সূচনা হয়।

সে ধারার অনুসরণে ১৯০১ সালে দারুল উলুম হাটহাজারী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে কওমী মাদরাসা শিক্ষার সূত্রপাত ঘটে। কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান আইন, ২০১৮-র মাধ্যমে কওমী মাদরাসা শিক্ষাকে সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। যদিও এ বিষয়ে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি-বিচ্যুতি এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে। মূলত, আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমীয়া বাংলাদেশ কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। এর অধীনে সরকার স্বীকৃত ছয়টি শিক্ষাবোর্ড রয়েছে। ২০২২ সালে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ১৯ হাজার ১৯৯টি। সাম্প্রতিক সময়ে এসব মাদরাসার সংখ্যা আরো বেড়েছে।

যেহেতু কওমী মাদরাসাগুলো সরকারি অনুদানের পরিবর্তে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর অর্থানুকূল্যে জনসাধারণের কল্যাণে পরিচালিত হয়। তাই এ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কওমী বা জাতীয় মাদরাসা বলা হয়। কওমী মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান আইন, ২০১৮-তে কওমী মাদরাসার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কওমি মাদরাসা অর্থ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত ও দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ, মূলনীতি ও মত-পথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তায় উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহীর শিক্ষাকেন্দ্র। বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার মাওলানা ইসহাক ফরিদীর ভাষায়, ‘ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের এক সমন্বিত শিক্ষাকেন্দ্রের নাম কওমি মাদরাসা’। বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, সরকারি সাহায্য ও প্রভাবমুক্ত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মাদরাসাই কওমী মাদরাসা। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশের কওমী ধারার মাদরাসা শিক্ষার সাথে দেশের ধর্মপ্রাণ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আত্মার সম্পর্ক রয়েছে।

ভারতবর্ষের প্রায় ৮শ বছরের মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের শিক্ষার অদ্বিতীয় একমাত্র মাধ্যম ছিলো মাদরাসা শিক্ষা। কিন্তু মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর পরই উপমহাদেশের শিক্ষা নিয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মূলত, পলাশী ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তন শুরু হয়েছিলো। কিন্তু মুসলমানরা এ বৃত্ত থেকে কোনভাবেই বেরিয়ে আসতে পারেনি বরং সার্বিক পরিস্থিতির উত্তরোত্তর অবনতিই হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় ক্রমেই মুঘল সাম্রাজ্যের পরিধিও সংকুচিত হতে থাকে। একের পর এক মোঘল সম্রাটরা পরিণত হতে থাকেন নামমাত্র পুতুল শাসকে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে মুঘল সম্রাজ্যের শেষ নিশানাটুকুও মুছে যায়। বৃটিশ শাসকরা উপমহাদেশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঔপনিবেশিক পূর্ব উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মভিত্তিক তথা মাদরাসা ও টোলকেন্দ্রিক। সে শিক্ষা গ্রহণ করেই মুসলমানরা এক সময় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। মাদরাসাতে শিক্ষা গ্রহণ করেই তারা তাজমহলসহ অনেক ঐতিহাসিক ও নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাজমহল ও লালকেল্লাসহ ভারতের অনেক রাজকীয় স্থাপনার স্থপতি উস্তাদ আহমদ লাহোরী ছিলেন তৎকালীন মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি দিল্লি জামে মসজিদের নকশাও তৈরি করেছিলেন। তবে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর দেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছিলো। কিন্তু ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী সে শিক্ষার মৌলিকত্ব ধ্বংস করে দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা মনে করেছিল ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা না গেলে তাদের শাসন দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হবে না। তাই তারা শুরুতেই উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো। আর এতে তারা পুরোপুরিই সফল হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের দীর্ঘকাল পরেও আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা সে গোলামীর জিঞ্জিরেই আবদ্ধ রয়ে গেছে।

মূলত, ইংরেজদের ‘Devide & Rule’ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যই উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়। এর একটি হলো সাধারণ শিক্ষার নামে ইউরোপীয় পদ্ধতির ধর্ম ও মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষা। অন্যটি কথিত ধর্মশিক্ষার নামে খণ্ডিত মাদরাসা শিক্ষা। সে ধর্ম শিক্ষার নামেই ১৭৮০ সালে গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক কলকাতায় ‘কলকাতা আলিয়া মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এভাবেই উপমহাদেশে আলীয়া পদ্ধতির মাদারাসা শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছিলো। কিন্তু বৃটিশরাজ নিয়ন্ত্রিত এ ধারার শিক্ষায় ভারতীয় মুসলমানদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বা তাদের উদ্দেশ্যও ভালো ছিলো না। আর সে শূন্যস্থান পূরণের জন্যই উপমহাদেশের আত্মসচেতন আলেম সমাজ ‘কওমী’ শিক্ষা নামে নতুন এক শিক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। যা কওমী তথা জাতীয় শিক্ষা নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু নানাবিধ বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ শিক্ষাকে খুব একটা সামনের দিকে এগুতে দেওয়া হয়নি।

মুসলিম জাতির এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে কওমী ধারার মাদরাসা তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামক স্থানে ‘আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ’ নামে। কওমী মাদরাসাগুলো সাধারণত সরকারি সহায়তার পরিবর্তে মুসলিম জনসাধারণের সহায়তায় পরিচালিত হয়। মূলত, ‘কওম’ শব্দটি আরবী। এর অর্থ গোষ্ঠী, গোত্র, জাতি, সম্প্রদায় ও জনগণ। ‘কওমী’ শব্দের অর্থ জাতীয়। ‘মাদরাসা’ শব্দটিও আরবী। এর অর্থ হলো অধ্যয়নের স্থান বা বিদ্যাপীঠ। বাংলা একাডেমির অভিধান মতে, ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতিসংক্রান্ত উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রকে মাদরাসা বলা হয়। সুতরাং কওমী মাদরাসা অর্থ দাঁড়ায় জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

মুসলমানরা সবসময়ই শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পৃষ্ঠপোষক ছিল। পৃথিবীর যত ধর্ম, দর্শন ও সভ্যতা রয়েছে, তার মধ্যে ইসলামই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানচর্চার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছে। মুসলমানরাই একসময় জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে তমসাচ্ছন্ন ইউরোপকে শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানের জগতের সঙ্গে পরিচিত করেছে। আর এভাবেই তারা অর্ধেক পৃথিবী শাসন করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু সে অবস্থা আর অবশিষ্ট থাকেনি। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে। মূলত, ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ভারতে মুসলিমরা হারিয়ে বসে নিজস্ব স্বকীয়তা ও গৌরবোজ্জ¦ল ঐতিহ্য। আর কওমী ধারার শিক্ষা সে স্বকীয়তা ফিরিয়ে আনার এক দুরন্ত প্রচেষ্টা। যা আজও মুসলিম সমাজে আলোর মশাল জ¦ালিয়ে রেখেছে।

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। শুধু মুসলিমদের শিক্ষাই নয় বরং হিন্দুদেরসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের শিক্ষাও ছিলো ধর্মাশ্রয়ী। হিন্দুদের প্রাথমিক শিক্ষা ছিলো টোল কেন্দ্রিক। যেখানে হিন্দু ধর্মের আদর্শে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হতো। মুসলিম সমাজে যে মাদরাসা শিক্ষা চালু ছিলো তা সমসাময়িক যুগ-জিজ্ঞাসার সম্পূর্ণ অনুকূল ছিলো বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত UNESCO-i Studies onCompulsory Education-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মুসলিম শাসনামলে শিক্ষা ও ধর্মকে অত্যন্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে বিবেচনা করা হতো।’ ইতিহাসবিদ এ আর মল্লিকের ভাষায়, ‘বাংলার মুসলমানদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর পূর্ণ হতো, তখন তার শিক্ষার সূচনা হতো। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো। এটা ছিল প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের ঐতিহ্য।’ (A. R. Mallic, British policy And Muslim in Bengal, p.149)

ধর্মকেন্দ্রিক ব্রিটিশপূর্ব ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী ছিল, তা হান্টারের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উইলিয়াম হান্টারের ভাষায়, ‘এ দেশটা আমাদের শাসনে আসার আগে মুসলমানরা শুধু শাসনের ব্যাপারেই নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল। ভারতীয় মুসলমানদের এমন একটা শিক্ষাপ্রণালী ছিল, যেটা আমাদের আমদানি করা প্রণালীর চেয়ে নিম্ন হলেও কোনো ক্রমেই ঘৃণার যোগ্য ছিল না। তার দ্বারা উচ্চস্তরের জ্ঞান বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিচ্ছন্ন হতো। সেটা পুরনো ছাঁচের হলেও তার ভিত্তিমূল সুদৃঢ় ছিল এবং সেকালের অন্য সব প্রণালীর চেয়ে নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট ছিল। এ শিক্ষাব্যবস্থায়ই তারা মানসিক ও আর্থিক প্রাধান্য সহজেই অধিকার করেছিল।’ (সূত্র : উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, আবদুল মওদুদ অনূদিত, পৃ. ১১৬)

ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। এ শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব পড়ে লর্ড মেকলের ওপর। সে শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ কী তার বর্ণনাও পাওয়া যায় মেকলের আত্মস্বীকৃতিতে। ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়রি বৃটিশ পার্লামেন্টে লর্ড মেকলে বলেন, ‘I

have traveled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief, such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such caliber that I don’t think we would ever conquer this country unless we break the very backbone of this nation which is her spiritual and cultural heritage and therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native culture and they will become what we want them, a truly dominated nation.

(সূত্র-Saving Humanity-স্বামী বিবেকানন্দ, পৃষ্ঠা-১৬৯-১৭০)

ইংরেজদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য সম্পর্কে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ সালে কলকাতার গভর্নর কাউন্সিলে লর্ড মেকলের বক্তব্য হচ্ছে, ‘.They Will be Indian in Blood and Color but Appetite and thought Will be an European’ (woodrow, Macaulay’s Minutes on Education in India-1862 : Translated by Abdul Maudud.) ) অর্থাৎ ‘ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে এ দেশে এমন একটি শ্রেণি গড়ে উঠতে হবে, যারা ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। এরা রক্ত-মাংসের গড়নে ও দৈহিক রঙে ভারতীয় হবে বটে; তবে রুচি, নীতিবোধ ও বুদ্ধির দিক থেকে হবে খাঁটি ইংরেজ।’ মূলত, এর মাধ্যমেই উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

শিল্প বিপ্লবোত্তর সময়ে যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কথিত উন্নয়ন, প্রগতি ও প্রযুক্তির মোহে সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠে, তখন তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে আসেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভি (রহ.)। তিনি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক বিধি-বিধান বিশ্লেষণ করে পেশ করেন ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সার্বিক রূপরেখা। সে ধারাবাহিকতায় মাওলানা কাসেম নানুতভি (রহ.) ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতি অনুসরণ করে একটি সমন্বিত শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানের নাম ‘দেওবন্দ মাদরাসা’। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেওবন্দের মনীষীরা লর্ড মেকলের শিক্ষানীতিকে অসার, অগ্রহণযোগ্য ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আর এতে তারা পুরোপুরি সফলও হয়েছেন।

১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ৩৪ জন শীর্ষস্থানীয় আলেম ঐক্যবদ্ধভাবে বৃটিশদের প্রতিরোধের ডাক দেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে বালাকোটের ট্র্যাজেডির আগে সাড়ে ৫৭ হাজার আলেম শাহাদাতবরণ করেছেন। (সূত্র : ইতিহাসের ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা) আর বালাকোটের ট্র্যাজেডির পর স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াকু ১৪ হাজার আলেমকে ফাঁসি দেয় ইংরেজ শাসকরা। (সূত্র : জিয়াউর রহমান ফারুকির ভাষণ, যাঁদের ত্যাগে এ দেশ পেলাম)

মূলত, উপনিবেশবাদ নিয়ন্ত্রিত আলীয়া নেসাবের মাদরাসা শিক্ষা ভারতীয় মুসলিমদের আশা-আকাক্সক্ষা, তাহজীব-তামুদ্দন সংরক্ষণে পুরোপুরি সহায়ক হয়নি। সর্বোপরি সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিপুলসংখ্যক আলেম শহীদ হওয়ার ফলে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির সংরক্ষণ করা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সঙ্গত কারণেই পশ্চিমা শিক্ষা ও কালচারের আগ্রাসন থেকে ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষা করতে কয়েকজন আলেমের উদ্যোগে ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৬ সালের ৩০ মে তদানীন্তন অখণ্ড ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে মাওলানা কাসেম নানতুভি (রহ.)-এর নেতৃত্বে ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

মূলত, এটিই সর্বপ্রথম কওমি মাদরাসা। এর ছয় মাস পর দারুল উলুমের আদর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সাহারানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুজাহেরুল উলুম মাদরাসা’। সে ধারাবাহিকতায় ১৯০১ সালে বাংলাদেশের প্রথম কওমি মাদরাসা দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৩৭ সালে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ দেশে প্রায় ৪৪৩টি কওমি মাদরাসা ছিল। এর মধ্যে প্রায় ৫১টি ছিল দাওরায়ে হাদিস মাদরাসা। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদরাসা আছে। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। (প্রথম আলো : ২৯-০৯-২০১৬)

প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ছাড়াও কওমী কারিকুলামে মসজিদ, মক্তব ও ফোরকানিয়া মাদরাসাকেন্দ্রিক আরো লাখো প্রতিষ্ঠানে কওমী ধারার শিক্ষা দেয়া হয়। দেশের প্রতিটি জনপদে, শহর-বন্দরে, গ্রামেগঞ্জে হাজারো মসজিদ-মাদরাসা স্থাপন করে মুসলমানদের জন্য ঈমানী দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেছে কওমি মাদরাসা। যা বৃটিশদের ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী ষড়যন্ত্রকে কিছুটা হলেও রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে।

মুসলমানদের এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে উপমহাদেশে কওমী ধারার মাদরাসা শিক্ষার পথচলা শুরু হয়। মূলত, সরকার নিয়ন্ত্রিত আলীয়া ধারার মাদরাসা শিক্ষা যখন মুসলমানদের আশা-আকাক্সক্ষার, আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাসের জন্য পুরোপুরি সহায়ক হয়নি, সর্বোপরি সিপাহী বিদ্রোহে অসংখ্য আলেমের শাহাদাতের কারণে আলেম সংকটের আশঙ্কা দেখা দেয়, সে প্রেক্ষাপটেই সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে ও ধর্মপ্রাণ মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় উপমহাদেশে কওমী ধারার মাদরাসা শিক্ষার উৎপত্তি ঘটে। যা আজও চলমান আছে এবং এখনো অসংখ্য নতুন নতুন কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

সে থেকে দেড়শো বছরের অধিক সময় ধরে উপমহাদেশের কওমী মাদরাসাগুলো দেশের সাধারণ ও আলীয়া ধারার সমান্তরালে মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনি শিক্ষা সম্প্রসারণে অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু এ ধারার শিক্ষা অতীতে নির্বিঘ্ন ছিল না; এখনো নয় বরং নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই সামনের দিকে এগুতে হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা সগৌরবে টিকে থেকে ওহীর শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে।

তবে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কওমী শিক্ষা নিয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ফলে এ শিক্ষার বিষয়টি নতুন করে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছিলো। বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার কথা বলে এ শিক্ষা সংস্কার, শিক্ষার কারিকুলাম পরিবর্তন ও সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছিলো। যদিও দাবিগুলোর অধিকাংশই যৌক্তিক নয় বরং প্রায়গুলোই ছিলো উদ্দেশ্যপ্রণোগিত। তাই অনেক চেষ্টা করেও তাদের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

আমাদের দেশে মাদরাসা বা ইসলামী শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। মূলত, আওয়ামী লীগ এদেশে যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। এজন্য কওমি মাদরাসাসহ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর করার কথা বলে নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া মাদরাসাগুলোকে সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আনতে একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়। এমনকি কওমি মাদরাসা সংক্রান্ত পরিচালিত ছয়টি শিক্ষা বোর্ডকে সমন্বয় করে একটি কওমী শিক্ষা বোর্ড গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। সে সময় কওমি মাদরাসা নিবন্ধনের নীতিমালা প্রণয়ন ও কওমি শিক্ষা বোর্ড গঠনের প্রস্তাব তৈরিতে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

১৫ সদস্যের ওই কমিটিতে মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, জননিরাপত্তাবিষয়ক বিভাগের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কওমি মাদরাসার ছয় বোর্ডের চেয়ারম্যানকেও পদাধিকার বলে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কওমী অঙ্গনে ও ইসলামপ্রিয় মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। তারা এ ধারার শিক্ষায় সরকারের যেকোন হস্তক্ষেপের সম্পূর্ণ বিরোধী। তাদের ধারণা সরকার যদি কওমী শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণে নেয় তাহলে এ শিক্ষা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা হারাবে। কওমী কারিকুলাম সময়োপযোগী করার নামে দ্বীনি শিক্ষা সংকোচিত হবে এবং পর্যায়ক্রমে তা আলীয়া নেসাবে রূপ নেবে। যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।

মূলত, কওমী বোর্ডগুলো সরকারের সংস্কার ভাবনাকে যৌক্তিক ও কাক্সিক্ষত মনে করেনি। তাদের দাবি, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডে হাজার হাজার কওমি মাদরাসা শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে গেলেও কোথাও সরকারের নজরদারি ও হস্তক্ষেপ নেই। এমতাবস্থায় কওমী শিক্ষা সরকারের নিয়ন্ত্রণে গেলে শিক্ষার স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কওমী মাদরাসা নিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

তবে একথা সত্য যে, দেশের কওমী মাদরাসা শিক্ষার সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এ সংস্কার অবশ্যই হতে হবে এ ধারার শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ঐতিহ্যকে সামনে রেখেই। সংস্কারের নামে যাতে কোন অবস্থাতেই অহীভিত্তিক এ শিক্ষাপদ্ধতির মৌলিকত্ব ও আবেদন নষ্ট না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংস্কারের নামে কওমী শিক্ষা যাতে ঔপনিবেশিক ধারার শিক্ষায় পরিণত না হয় সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় করতে গিয়ে যাতে কোন অবস্থাতেই শিক্ষার দ্বীনি চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নষ্ট না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা একথা বলতে চাই, কওমী শিক্ষার স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য বজায় রেখে সংস্কার অবশ্যই জরুরি। কারণ, এ ধারার শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা কোন বিতর্ক করার সুযোগ নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষাবিদ, কওমী ধারার আলেম-উলামাসহ শিক্ষাবিশেষজ্ঞদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার।