॥ প্রজ্ঞা দাস ॥

সমাজের অভ্যন্তরে বহু সংকট নীরবে শিকড় বিস্তার করে, কখনো কখনো যা ধ্বংসের মহাপ্রলয় ডেকে আনে। অনলাইন জুয়া ঠিক এমনই এক আধুনিক দুর্যোগ, যা সামাজকে ধ্বংসের প্রান্ত সীমায় ঠেলে দিচ্ছে। সমাজ ধ্বংসের জন্য ক্ষেপণাস্ত্রের দরকার নেই, বন্দুকের গর্জন লাগবে না, শুধু একটি মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগই যথেষ্ট। তথাকথিত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার আড়ালে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এক ভয়ংকর ফাঁদ তৈরি করেছে যেখানে প্রবেশ একবার ঘটলে মুক্তির পথ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। অভ্যস্ততা, আসক্তি এবং দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভ এক অনিবার্য সামাজিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। এটি শুধু একটি আসক্তিই নয়, এটি চারপাশের মানুষকে নিঃশেষ করে দেওয়া এক সর্বগ্রাসী অগ্নিকু-, যেখানে পুড়ছে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং পারিবারিক বন্ধন। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীদের একটি বড় অংশ আজ এ অন্ধকার জগতে নিমজ্জিত। অনলাইন বেটিং, ক্যাসিনো গেম, স্পোর্টস বেটিং এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে চালিত জুয়ার জালে আটকে পরছে হাজারো মানুষ। যে যুবসমাজ দেশের ভবিষ্যৎ, তারা এখন অদৃশ্য ভয়ানক সর্বগ্রাসী শৃঙ্খলে আবদ্ধ। অনলাইন জুয়ার আগ্রাসন এমন এক মহামারী পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা টের পাওয়ার আগেই পরিবার ধ্বংস হয়, সম্পদ শেষ হয়ে যায়, যুবক নিঃস্ব হয়, আত্মহত্যা বাড়ে, অপরাধের হার আকাশ ছোঁয়।

যারা একবার এ ফাঁদে পরে, তাদের বেঁচে থাকার অর্থ শেষ হয়ে যায়, স্বপ্নগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, সম্পর্ক ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং স্মার্টফোনের ব্যাপক ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে অনলাইন জুয়া আজ ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছে। এক ক্লিকেই তরুণরা ঢুকে পরছে জুয়ার জগতে। এটি মূলত ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালিত এক প্রকারের বাজি বা বেটিং ব্যবস্থা, যা অনলাইনে ক্যাসিনো, পোকার, রুলেট, স্পোর্টস বেটিং কিংবা ভার্চুয়াল লটারির মতো নানা রূপে বিস্তার লাভ করেছে। গ্লোবাল অনলাইন বেটিং মার্কেট বর্তমানে বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশও একটি লক্ষণীয় অংশীদার। এদেশে আন্তর্জাতিক জুয়া সাইটগুলো ঠচঘ (VPN (Virtual Private Network), ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং মোবাইল পেমেন্ট সার্ভিসের মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করছে। প্রথমে তরুণদের বিনামূল্যে ‘ওয়েলকাম বোনাস’ দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। পরবর্তীতে গেম কিংবা বাজি শুরুর প্রথম দিকে কিছু অর্থ জেতানো হয়, যেন তারা মনে করে এটি খুব সহজেই টাকা উপার্জনের একটি মাধ্যম। এভাবে টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে আসক্তি বাড়ানো হয়, এরপর আরো বেশি টাকা পাবার আশায় খেলোয়াড় তার নিজের টাকা বিনিয়োগ করা শুরু করে। যখন থেকে খেলোয়ার নিজের টাকা বিনিয়োগ শুরু করে তখন থেকে ধীরে ধীরে অন্ধকার ধ্বংসকূপের দিকে ধাবিত হতে থাকে।

একসময় তারা সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরে। ব্যাংক লোন নেয়, মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের থেকে টাকা নেয়, বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার চায়, তারপর একটা সময় যখন সকলে তাকে টাকা দিতে অস্বীকার করে তখন তারা জুয়া খেলার টাকা যোগাড় করতে যেকোনো ধরনের অপরাধ করতেও পিছপা হয় না। এসব জুয়া সাইডগুলোতে এমনভাবে ট্রাপ তৈরি করা হয়, যেখান থেকে মানুষ সহজে বের হতেও পারে না। তাই মানসিক হতাশার বসবর্তী হয়ে অনেক সময় অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। এ সকল অ্যাপ এ ঢুকতে কোনরকম কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকা জুয়া সাইডগুলোকে আরো উৎসাহিত করছে তাদের পরিসর বিস্তৃত করতে। এ সকল জুয়ার ফাঁদে সবচেয়ে বেশি পরে নতুন নতুন ফোন হাতে পাওয়া স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর, বেকার ও হতাশাগ্রস্ত যুবকের, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি।

ফলাফল পারিবারিক ও মানসিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট, অপরাধমূলক কার্যকলাপের প্রসার ও আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে জুয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৮৬৭ সালের ‘Public Gambling Act’ অনুসারে জুয়া খেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। তাছাড়া, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে সমস্যার মূল জায়গা হচ্ছে আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা। অনলাইন জুয়া সরাসরি কোনো ক্যাসিনো বা জুয়ার আসরের মতো দৃশ্যমান নয়, বরং এটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফলে প্রচলিত আইনের আওতায় একে ধরা কঠিন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সীমিত প্রযুক্তিগত দক্ষতার কারণে এসব প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি সরকার অনলাইন বেটিং ও ক্যাসিনো সংক্রান্ত ওয়েবসাইট বন্ধে পদক্ষেপ নিলেও ঠচঘ ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে এগুলো সহজেই চলছে। ফলে শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডিজিটাল অপরাধ দমন কৌশলী ও দক্ষ করে তোলাই একমাত্র কার্যকর উপায়। পাশাপাশি যারা জুয়ার বিজ্ঞাপন চালায়, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তরুণদের জন্য সঠিক অর্থ উপার্জনের পথ তৈরি করতে হবে। উদ্যোক্তা কর্মসূচি, ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং, দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প বাড়াতে হবে। শুধু তাই নয় সমাজের এত বড় একটি সমস্যা দমনে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।

তাই স্কুল-কলেজ থেকে এ বিষয়ে শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালু করতে হবে। মিডিয়ায় প্রচার ও অভিভাবকদের সতর্ক করতে হবে। সর্বস্তরের জনসাধারণেকে এটা বোঝাতে হবে শর্টকাট পথে কখনো টাকা উপার্জন সম্ভব নয়। কিংবা সেটা সম্ভব হলেও সেটা ক্ষণস্থায়ী এবং ভবিষ্যতে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে চলেছে। অনলাইন জুয়া বাংলাদেশের জন্য এক প্রচ্ছন্ন মহামারী ও সামাজিক ধ্বংসের সূতিকাগার। যা সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, পারিবারিক বন্ধন ও যুবসমাজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশ এক জুয়াড়ি জাতিতে পরিণত হবে এবং আগামী প্রজন্ম একটি পঙ্গু সমাজের দিকে ধাবিত হবে। যেখানে মূল্যবোধ থাকবে না, নৈতিকতা থাকবে না, এবং থাকবে না কোনো আশার আলো। তাই রাষ্ট্রের উচিত শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে এই সর্বনাশা জুয়ার অন্ধকার নির্মূল করা। এটি পুরো একটি জাতির স্বার্থ ও সুরক্ষার প্রশ্ন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ।