মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের যত বৈরী প্রচারণা তার বেশির ভাগই নারী অধিকার ও নারীর মর্যাদাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাশ্চাত্যের উচ্চ শিক্ষিত নারীরাই সবচেয়ে অধিক হারে ইসলামের দিকে এগিয়ে আসছে। বর্তমানে পাশ্চাত্যে ইসলাম সবচেয়ে বিকাশমান ধর্ম হিসেবে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করে নিচ্ছে। যদিও সেখানে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে যথেষ্ট বৈরী প্রচারণা বিদ্যমান রয়েছে। The Almanac Book of Facts -এর এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পাশ্চাত্যে ইসলাম গ্রহণকারী নারীদের সংখ্যা এক দশকে ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। স্বভাবতই, পাশ্চাত্যের উচ্চ শিক্ষিত প্রগতিশীল নারীরা কেন ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এ বিষয়ে আমাদের দেশের মত সকল মুসলিম দেশের মানুষের মনে কৌতুহল জোরালো হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে যে পয়েন্টগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেগুলো নিম্নরূপ:

১. পাশ্চাত্যের উচ্চ শিক্ষিত নাগরিকদের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ এবং পবিত্র কুরআন চর্চা ও কুরআনকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ গবেষণার কারণে পাশ্চাত্যের খৃস্টান বিজ্ঞানীগণ এমনকি নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানীরাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন যে, ইসলাম একটি সত্য ধর্ম। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের কাছে এটি আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন কোন মানুষের রচনা নয়, বরং এটি সত্যি সত্যিই একটি ঐশীগ্রন্থ এবং বিশ্বস্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ থেকেই এটি প্রেরিত হয়েছে। এ উপলব্ধির কারণে পাশ্চাত্যের বহু বিজ্ঞানী পবিত্র ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছেন এবং ইসলামের সত্যতার ঘোষণা দিচ্ছেন। তাদের এ উপলব্ধি ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সাধারণ মানুষের মনেও ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং তারা ইসলামের প্রতি আরো বেশি আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে উঠছেন।

২. খৃস্টান বিশপ ও ধর্মপ্রচারকগণও স্বীকার করছেন যে, বাইবেলে বহু সমস্যা রয়েছে।

৩. মিডিয়াগুলো অব্যাহতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রপাগান্ডা চালালেও সুখের কথা হচ্ছে, মিডিয়ার ইসলাম বিদ্বেষী এসব প্রপাগান্ডার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমান্বয়েই হ্রাস পাচ্ছে এবং ইসলামী সাহিত্য ও মিডিয়ার প্রতি তাদের আগ্রহের বৃদ্ধির কারণে ইসলাম সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ও বদ্ধমূল ধারণা দূর হচ্ছে। একই সাথে খৃষ্ট ধর্মের অনেক ভুল বিশ্বাস ও কুসংস্কার সম্পর্কেও তারা সচেতন হতে শুরু করেছে।

৪. পাশ্চাত্যের বহু নাগরিকই এখন ত্রিত্ববাদের প্রতি আস্থাবান নয় বরং তাদের অনেকেই মনে করেন জেসাস মানুষ ছিলেন। তিনি খোদার পুত্র বা অবতার কোনটাই ছিলেন না, বরং তিনিও ছিলেন হযরত মুহাম্মদের (স:) মতই একজন মুসলিম ও আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো একজন নবী বা বার্তাবাহক।

৫. বাইবেল ও কুরআনে বর্ণিত নারী বিষয়ক ভাষ্যের তুলনামূলক আলোচনাও নারীদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করছে। উল্লেখ্য, বেহেশতে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের জন্য বাইবেলে ইভকে প্রকৃত অপরাধী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। [এবহবংরং ২:৪-৩:২৪]। অন্যদিকে, কুরআনে এজন্য আদমকেই দায়ী করা হয়েছে, হাওয়াকে (ইভ) নয় [আল আরাফা ৭: ১৯-২৫]।

৬. বাইবেলে কন্যা সন্তানের জন্মকে একটি ক্ষতি বা অভিশাপ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। [The birth of a daughter is a loss]| । অন্যদিকে পবিত্র কুরআনে কন্যা সন্তান ও ছেলে সন্তান

উভয়কেই স্রষ্টার আশীর্বাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

৭. বাইবেলে ব্যভিচারের অভিযোগ শুধুমাত্র নারীর জন্যই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু পুরুষের জন্য কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি: [Matthew 5:31 32]। কুরআনে এ ধরনের দ্বৈতনীতির অস্তিত্ব নেই। কুরআন ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই শাস্তি নির্ধারণ করেছে। আর রূম

৯. বাইবেলে সম্পদের উত্তরাধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং শুধুমাত্র পুরুষকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেয়া হয়েছে। [Numbers27: 1-11 । অন্যদিকে কুরআন সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার সহ আরো কয়েকটি অধিকার প্রদান করেছে, যা তার অর্থনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করেছে- [আন নিসা ৪: ২২]

১০. বাইবেল পুরুষকে বহু স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি প্রদান করেছে [1 Kings 11:3] । কিন্তু কুরআন বলেছে, একজন পুরুষ বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং শর্ত সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ৪ জন স্ত্রী রাখতে পারবে। [আন নিসা ৪:৩]। এভাবে কুরআন পুরুষের বহু বিবাহের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনেছে। এছাড়া, আল কুরআন নারীকে পাত্র পছন্দ করা বা না করার অধিকারও প্রদান করেছে।

এছাড়া পাশ্চাত্য ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা মানুষের মনের শান্তি বা আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় নিজ ধর্ম ও সমাজের প্রতি ঐ সমাজের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারা তাদের এ আধ্যাত্মিকতার সন্ধান পাচ্ছেন ইসলামের মধ্যে। এ কারণেও পাশ্চাত্য নারীদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। Christian Science Monitor এর ওয়েব সাইট csmon-itor.com-এর এক রিপোর্ট থেকে এ তথ্য জানা গেছে। রিপোর্টে উল্লেখিত মেরী ফালট [Mary Fallot] নামের এক ফরাসী নারী সম্প্রতি তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ প্রসঙ্গে নিজ ধর্মের প্রতি এই আস্থাহীনতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ইসলামেই ভালোবাসা, সহনশীলতা ও শান্তির বার্তাগুলো রয়েছে, যা তাকে এই ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। csmon-itor.com মুসলিম ও অমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের গবেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি বার্তা দিয়েছে, আর তা হল ৯/১১ হামলার পর ব্যাপক সংখ্যক ইউরোপীয় নাগরিক ইসলামের প্রতি কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে রিপোর্টটিতে আরো বলা হয়েছে, প্রতি বছর বেশ কয়েক হাজার ইউরোপীয় নারী ও পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করছে। বিশেষজ্ঞগণ আরো মনে করেন, ধর্মান্তরিতদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশই সাম্প্রদায়িক পরণতায় আক্রান্ত হয় এবং পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। বিশেষজ্ঞগণ এ প্রচলিত ধারণার সাথেও দ্বিমত পোষণ করেন যে, মুসলিম পুরুষদের বিয়ে করার জন্যই পাশ্চাত্য নারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। বৃটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. হাইফা জাওয়াদ এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘বিশ্বাসগত কারণেই’ পাশ্চাত্যের নারীরা ইসলামের দিকে ঝুঁকছে।

অবশ্য এ বদ্ধমূল ধারণাটি পাশ্চাত্যের নও-মুসলিম নারীদেরকে যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। ম্যারী ফ্যালটের কথায়ও এ বিব্রতকর ভাবটি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আমি যখন কর্মস্থলে আমার সহকর্মীদের নিকট আমার ধর্মান্তরের কথাটি প্রকাশ করি, তখন তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল আমাকে এ প্রশ্ন করা যে, আমার কোন মুসলিম বয়ফ্রেন্ড আছে কি না। আমি যে সম্পূর্ণ আমার নিজের ইচ্ছাতেই এটি করতে পারি তা যেন তারা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তিনি তার ইসলাম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে তার ইসলাম গ্রহণের কারণ হল, ‘ইসলাম স্রষ্টার সাথে নৈকট্য স্থাপনের দাবি জানায়। ইসলাম তুলনামূলকভাবে সহজ-সরল এবং সুশৃংখল জীবন বিধান এবং এটি সহজতর কারণ এটি স্পষ্ট।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি এমন একটি অবলম্বনই খুঁজছিলাম; কারণ মানুষের অনুসরণের জন্য একটি নিয়ম-নীতি ও আচার-আচরণ প্রয়োজন। খৃস্ট ধর্ম আমাকে এই বিষয়গুলোর সন্ধান দিতে পারেনি।’

আর এ কারণগুলো ধর্মান্তর গ্রহণকারী বহু নারীর চিন্তাকেই স্পর্শ করে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ডঃ জাওয়াদ বলেন, পশ্চিমা সমাজের নৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতি বহু নারীই এখন বীতশ্রদ্ধ এবং তারা ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ও শাসনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক।