এস.এম.নুরুন্নবী
ব্যাংকের মূল কাজ হলো গ্রাহকদের প্রদত্ত আমানত গ্রহণ করা এবং ঋণ বা বিনিয়োগ গ্রাহকদেরকে সুদ বা মুনাফার ভিত্তিতে ঋণ/বিনিয়োগ প্রদান করা। প্রথাগত ব্যাংকগুলো সুদের ভিত্তিতে গ্রাহকের আমানত গ্রহণ করে এবং সুদের ভিত্তিতেই গ্রাহকদেরকে ঋণ প্রদান করে থাকে। অন্যদিকে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো মুনাফার ভিত্তিতে গ্রাহকদের আমানত গ্রহণ করে এবং মুনাফার ভিত্তিতে গ্রাহকদেরকে বিনিয়োগ করে থাকে। এখানে শুধু সুদের পরিবর্তে মুনাফা আর ঋণের পরিবর্তে বিনিয়োগ এ ধরনের পরিভাষাগত পার্থক্য বিদ্যমান নয়। ধারণা এবং কার্যপদ্ধতি উভয়টিতেই পার্থক্য রয়েছে। সুদ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বৈধ হলেও ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী এটি হারাম বা অবৈধ। শরীয়াহভিত্তিক কোন ব্যাংক যদি ইসলামী শরিয়াহ্’র শ্লোগান নিয়ে প্রথাগত ব্যাংকিং করে তাহলে সেটি হবে মানুষের সাথে জঘন্য প্রতারণা। প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও হারাম। যার জন্য অবশ্যই তারা পরকালে আল্লাহর নিকট দায়ী হবেন। তাই শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মালিক, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলকে চিন্তা এবং কর্ম উভয় দিক থেকে শরীয়াহর আলোকে নৈতিকতা সম্পন্ন হওয়া দরকার। শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে শরীয়াহ নৈতিকতার ছাঁকুনি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে যেন গ্রাহকের প্রাপ্ত মুনাফা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন এবং মালিক পক্ষের লভ্যাংশে কোনক্রমেই সুদের ছিঁটেফোটার মিশ্রণ না ঘটে। পবিত্র কুরআনে সুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে (সূরা বাক্বারা ২৭৯)। শুধু মুনাফা সর্বাধিক করাই উদ্দেশ্য হলে শরীয়াহর নৈতিকতায় অটল থাকা কঠিন হবে। এমন অবস্থায় উর্ধ্বতন নির্বাহী থেকে নিম্নতন কর্মচারী পর্যন্ত কারো কাছে শরীয়াহ নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে না। তাই ব্যাংক মালিকদের নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে সর্বাগ্রে। শরীয়াহ’র উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধন করা। মানুষের কল্যাণ সাধনকে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য বানাতে হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়’ (সূরা হাশর ৭)। অর্থাৎ, কুরআন বলছে সম্পদকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। এ আয়াত থেকে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ বিনিয়োগ তথা বিনিয়োগের বৈচিত্র্যকরণের নির্দেশনা পাওয়া যায়। অথচ আমরা দেখেছি, ফ্যাসিবাদী শাসনামলে কিছু শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মালিক নিজেই নামে বেনামে ব্যাংকের অর্থ বিনিয়োগ নিয়েছেন। বিদেশে পাচার করেছেন। যার ফলে ফ্যাসিবাদের পতনের পরবর্তীতে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সম্মানিত গ্রাহকগণ ব্যাংকে গিয়ে নিজ অর্থ তুলতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বিদায় হয়েছেন।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মানুষের পক্ষ থেকে আল-আমীন বা বিশ্বস্ত খেতাব পেয়েছিলেন তাঁর আমানতদারিতার কারণে। মানুষ তাদের অর্থ সম্পদ তাঁর কাছে নির্দ্বিধায় আমানত রাখত। মদিনায় হিজরতের প্রাক্কালে তিনি জনগণের সে আমানত হযরত আলী (রা.) কে বুঝিয়ে দিয়ে মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। বর্তমানে মানুষ ব্যাংককে বিশ্বাস করে অর্থ আমানত রাখে। অর্থ আমানতের ক্ষেত্রে গ্রাহকের নিকট থেকে সাধারণ অনুমতি থাকে যে, তার প্রদত্ত অর্থ ব্যাংক ব্যবসায় খাটাতে পারবে। তবে গ্রাহক আমানত ফেরত চাওয়ামাত্র তার আমানত ফেরত দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক ব্যাংক গ্রাহকের অর্থ চাহিবামাত্র ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ হলো তাদের আমানতদারিতার ঘাটতি। এ কারণে বর্তমানে কতিপয় শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক দুর্নামের ভাগিদার। যারা মনে করেন, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দিলে কিছু হয় না। তাদের জানা থাকার কথা যে, ব্যাংকের টাকা ব্যাংকের নিজের নয়, সাধারণ মানুষের প্রদত্ত আমানত। হাদীসের ভাষ্যমতে, ঋণগ্রস্ত অবস্থায় কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার দায় আল্লাহ মুক্ত করবেন না। যদি ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী হয় তাহলে সে হলো অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী। কেয়ামতের দিন আত্মসাৎকৃত সম্পদ আত্মসাৎকারীর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে এবং আত্মসাৎকারী জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। সমস্যা হলো, মুসলিম হিসেবে আমাদের মধ্যে পরকালীন জবাবদিহিতার যে অনুভূতি থাকার কথা ছিলো তা বহুলাংশে লোপ পেয়েছে।
শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক মালিকদের উচিত নিজেদের ব্যাংকিং ব্যবসার উদ্দেশ্যকে শরীয়াহ-র আলোকে পুন:মূল্যায়ন করা। পাশাপাশি ইসলামী জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং ব্যবহারিক জীবনে ইসলাম অনুশীলন করেন এমন ব্যক্তিদেরকে ব্যাংকের উর্ধ্বতন পদে পদায়ন করা। ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং-এর খুঁটিনাটি জ্ঞান এবং কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এছাড়াও ইসলামী নৈতিকতার বিষয়ে সার্বক্ষণিক প্রেষণা দানের জন্য ব্যাংকের মধ্যে একটি ইসলামী পরিবেশ বজায় থাকা দরকার। যেখানে নামাযের সময় নামাযের জামাত হবে, নারী কর্মীরা পর্দা মেনে চলবে, দিনে বা সপ্তাহে নিয়ম করে কিছুক্ষণ কুরআন হাদীসের তালিম হবে। ষান্মাসিক বা বাৎসরিক গ্রাহক সমাবেশ করে গ্রাহকদেরকে শরীয়াহ বিষয়ে সচেতন করা হবে। কিভাবে ব্যাংকিং করলে তা শরীয়াসম্মত হবে আর কিভাবে হলে তা সুদ হয়ে যাবে এ বিষয়ে গ্রাহকরা সচেতন না হলে শতভাগ ইসলামিক ব্যাংকিং সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-তে একটি ইসলামী পরিবেশ বিরাজমান। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো এমনই হওয়া উচিত। ব্যাংকে শরীয়াহ লংঘিত হয় সাধারণত বিনিয়োগ গ্রাহকদের মাধ্যমে। বিনিয়োগ গ্রাহকদের ভুলের কারণে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রথাগত ব্যাংকের সুদভিত্তিক ঋণে পর্যবসিত হয়। তাই বিনিয়োগ করার সময় গ্রাহকদেরকে শরীয়াহ বিষয়ে জ্ঞান দান করতে হবে। ব্যাংকের উর্ধ্বতন নির্বাহী থেকে নিম্নস্তরের কর্মকর্তা পর্যন্ত সকলকে শরীয়াহ নৈতিকতায় দৃঢ়পদ থাকা উচিত। ব্যাংক মালিক হোক বা সমাজের প্রভাবশালী হোক কারো কোন অনৈতিক আদেশ মেনে শরীয়াহ বহির্ভূত ব্যাংকিং থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। অনৈতিকতার ভিড়ে নৈতিকতার উপর অটল থাকা জিহাদের শামিল। শরীয়াহ পরিপালনে কোন বিচ্যুতি ঘটলো কিনা তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য ব্যাংকে শরীয়াহ অডিট এর ব্যবস্থা থাকতে হবে। শরীয়াহ বিচ্যুতির শতকরা হার হিসাব করে শরীয়াহ বিচ্যুত অর্থ মূল আয় থেকে বাদ দিয়ে সে অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করতে হবে।
দান-সাদাকা ইসলামী অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। দারিদ্র বিমোচন, বেকারত্ব নিরসন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন, রাস্তায় ঘুমানো মানুষদের জীবন মান উন্নয়ন, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দান সাদাকা করে ব্যাংক সমাজের জন্য ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। সামাজিক দায়বদ্ধতা (Corporate Social Responsibility) হিসেবে এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ব্যয় করার সুযোগ রয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর বহুমুখী লাভ হবে। ব্যাংকের প্রচার প্রসার বাড়বে। সুদৃঢ় জনভিত্তি তৈরী হবে। মানুষের উপকার হবে। ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ সাধিত হবে। ওয়াজ মাহফিল, ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা, ইসলামিক টিভি প্রোগ্রাম ইত্যাদিতে শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলো স্পন্সর করে নিজেদের প্রচার প্রসার ঘটাতে পারে। ইসলামী অর্থনীতি এবং ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে মানুষকে বুঝানোর জন্য ব্যাংকগুলো সমাজের আলেমদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারে। এ কাজগুলো শুধু ব্যাংকের প্রচার প্রসারের জন্য জরুরী নয়। বরং শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক মানে হচ্ছে একটি ইসলামী প্রতিষ্ঠান। ইসলামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামের দাওয়াতি কাজ তাদের অতিরিক্ত একটি দায়বদ্ধতা। লেখক : ব্যাংকার।