দেশে নারীর জীবন ও ইজ্জত লুটে নেওয়ার মহাউৎসব চলছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। কিন্তু তা বন্ধ হচ্ছে না। ফ্যাসিস্ট বিতাড়িত হওয়ার পরও নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ ভূমি এখনো গড়ে উঠেনি। ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, ট্রেনে-বাসে, হোটেলে, লঞ্চে, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষার্থী, গৃহবধূ কিংবা বৃদ্ধা কেউ ধর্ষণের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক গ্রুপ ইউএনএফপির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোন না কোন সময় শারীরিক, যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিষয়টি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। পত্রিকার পাতা খুললেই কেন জানি মনের ভেতর ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়! ধর্ষকের বিচারের ব্যাপারে এখন সবাই সোচ্চার। সবার একই কথা, একই মত। কোনক্রমেই ধর্ষক যেন ছাড়া না পেয়ে যায়।
ইদানিং ধর্ষণের যত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার ভেতর মাগুরার আছিয়া ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ৮ বছর বয়সী শিশুর জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ স্থাপিত হয়নি। ‘‘সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার আছিয়াকে নিয়ে চমৎকার একটি গান গাইলেন- ‘‘মাগুরার ফুল ছোট্ট মুকুল, ঝরে গেলো ফুটে ওঠার আগেই/ ডাক্তার হবার স্বপ্নটা তার, নিভে গেলো পিশাচের এক ছোবলেই।’’ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এরকম বহু পিশাচ এখনো ওৎ পেতে বসে আছে। ১১ মার্চ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার শিরোনাম- পতিত সরকারের শেষ ৬ বছরে ৭ হাজার শিশুসহ প্রায় ৪৩ হাজারের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ১ লাখ ৩৭ হাজার নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সর্বত্রই ছিল ধর্ষণের মহোৎসব। প্রকাশ্যেই ঘটা করে ধর্ষণের সেঞ্চুরী পালন করা হয়েছে। শাস্তির পরিবর্তে ধর্ষক নেতাকে উচ্চপদের চাকরিতে নিয়োগ দানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়েছে। ধর্ষকদের রাজনৈতিক আশ্রয় দানের কারণে সমাজের কদর্য চেহারা দিন দিন দানবে পরিণত হচ্ছে। সবাই আজ ধর্ষণের বিরুদ্ধে একমত।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকদিনের সংবাদ পর্যালোচনা করে নীচের সংবাদগুলো ডয়চে ভেলে মুদ্রিত হয়েছে। শিশু, গর্ভবর্তী নারী কেউই রেহাই পাননি যৌন নির্যাতন থেকে। নিচে কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো : ০৬ মার্চ : মাগুরার আছিয়া নিজ বাড়ি থেকে বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হন। ১৩ মার্চ দুপুরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশু আছিয়া মারা যায়। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম), ০৭ মার্চ : চিপস কিনে দিয়ে প্রতিবন্ধী তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ (বাংলা ট্রিবিউন), ০৮ মার্চ : খাবার ও বেলুনের লোভ দেখিয়ে দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, বৃদ্ধ গ্রেপ্তার (প্রথম আলো), ৮ মার্চ : ফরিদপুরে সাইকেলে ঘোরানোর কথা বলে শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, কিশোর আটক (যমুনা টেলিভিশন), ৮ মার্চ : শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, সালিসে দেড় লাখ টাকা জরিমানা, বাকি ৫৮ হাজার (আজকের পত্রিকা), ০৯ মার্চ : এবার গাজীপুরে ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, ভিডিও ধারণও করলো ধর্ষক (ঢাকা ট্রিবিউন), ০৯ মার্চ : নরসিংদীতে ৩দিন আটকে রেখে গর্ভবতী নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ (যমুনা টেলিভিশন), ২৮ এপ্রিল : চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার একটি আবাসিক মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদরাসার ৩ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২৮ এপ্রিল ২০২৫ প্রথম আলো। গত ২৯ এপ্রিল নেত্রকোনার দুর্গাপুরে বন্ধুর হবু স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে দুর্গাপুর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল আহমেদ ওরফে দুর্জয়কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। (মানবজমিন)
রাজনৈতিক স্লোগানে নারীর স্বাধীনতার কথা বলা হলেও ভিন্নমতের প্রতীকে ভোট দেয়ার অপরাধে হাসিনা সরকারের শাসনামলে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে স্বামী সন্তানদের বেঁধে রেখে এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন ধর্ষণ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের অপরাধকে উৎসকে দিচ্ছে। দেশের গণমাধ্যমে ধর্ষণের যে সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে তার চেয়েও প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। আমরা যদি বিগত কয়েক বছরের সংবাদপত্রের আলোচিত কিছু প্রকাশিত খবর দেখি, তাহলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারব। ২০১৫ সালের ২১ মে কুড়িল বিশ্বরোডে পাঁচ নরপশু এক গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে গণধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুর্মিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে ছোঁয়া পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার হন জাকিয়া সুলতানা রূপা। ধর্ষণের পর ঘাতকেরা রূপাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক নববধূকে দলবদ্ধভাবে গণধর্ষণ করা হয়। এরকম আরও বহু ঘটনা আছে যা লিখলে সমাপ্তি টানা মেলা ভার।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকা সত্ত্বেও কেন ধর্ষণ কমছে না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে! নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও আজ পর্যন্ত কতজন ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তা জানার অধিকার নিশ্চয়ই জাতির রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সনের ৮নং আইন এর ৩৫টি ধারার ভেতর ৯ নং ধারায় ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধারায় ৯ (১) এ তে বলা হয়েছে- যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। ৯ এর (২) তে বলা হয়েছে- যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ২ (ধর্ষণের শিকার) নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত ৩ [অনধিক বিশ লক্ষ টাকা] অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। ৯ এর (৩) তে বলা হয়েছে- যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে ৪ [বা সংঘবদ্ধভাবে] কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত ৫ [অনধিক বিশ লক্ষ টাকা] অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। তারপরও ধর্ষণ কিছুতেই থামছে না। ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ৬ হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। (সূত্র ঃ ০৮ মার্চ কালের কন্ঠ)
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। তাই ধর্ষণের রুট সবার আগে বন্ধ করতে হবে। ধর্ষণ প্রতিরোধে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অশ্লীল ছায়াছবি, অশ্লীল গান, অশ্লীল বিজ্ঞাপন, অশ্লীল ওয়েব সিরিজ, অশ্লীল নাটক, পর্নোসাহিত্য, ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল বই, ভারত মিয়ানমার থেকে আসা যৌন উত্তেজক ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকসামগ্রী, অশালীন পোশাক ও তরুণ-তরুণীর অবাধ মেলামেশার অবৈধ রুট বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইট মানুষের নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে মানুষের নৈতিক স্খলন ও অবক্ষয় বাড়ছে। শিক্ষা পাঠ্যক্রমে নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা, চারিত্রিক সততা বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতে ধর্ষণের উৎসাহ দেয়ার প্রবণতা ও উন্মুক্ত সংস্কৃতির প্রবাহ রোধ করা প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক