দুই
আমার ধারণা সম্মানিত পাঠকদের অনেকেই যারা Concept of Transformation বা রূপান্তরের ধারণা অধ্যয়ন করেছেন তারা নিশ্চয়ই Egg Analogy বা ডিম্ব তত্ত্ব সম্পর্কেও অবহিত আছেন। আমরা সবাই জানি ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। কিন্তু সব ডিম বা ডিম সদৃশ বস্তু থেকে কি বাচ্চা ফোটে? বাচ্চা ফোটার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। Egg Analogy অনুযায়ী উর্বর ডিম (Fertile Egg),, অনুর্বর ডিম ও ডিমের ন্যায় দেখতে এমন একটি পাথর ইনকিউবেটরে রাখতে হয়। এরপর নিয়মানুযায়ী সঠিক তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বায়ু চলাচলের সুবিধার জন্য নির্ধারিত সময়ে ডিম উলোট-পালোট করে দিতে হয় এবং এ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে উর্বর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে, অনুর্বর ডিম পচে যায়। পাথর পাথরের অবস্থানে থাকে। উর্বর ডিমে internal factor কাজ করে ও বাচ্চা ফোটার মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে; অনুর্বর ডিমে তা অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উপাদান কাজ না করায় পচে যায়। পাথর পাথরই থেকে যায়। কেননা External Factor বা বাহ্যিক উপাদান তার বেলায় কাজ করে না। এখানে যে বিষয়টি অত্যন্ত অপরিহার্য সেটা হচ্ছে Potentiality বা সম্ভাব্যতা অথবা অনুদ্ভূত বৃত্তিশক্তি। ডিম পাড়া অবস্থায় মোরগ-মুরগি বা হাঁসা-হাঁসির মিলন হলে ডিম উর্বর হয়, নতুবা তা অনুর্বর থাকে। এ উর্বরতাই হচ্ছে Potentiality বা অনুদ্ভূত বৃত্তি শক্তি।
আগের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম, কোনও জাতি, গোষ্ঠী বা সমাজ তার আদর্শ, ইমান, দর্শন, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের পরিপন্থি বা তার সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনও মতবাদ যদি আমদানি করে এবং নিজস্ব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে অভ্যন্তরীণ Potentiality’র অভাবে ডিম্ব তত্ত্বের ন্যায় তা হয় অস্তিত্ব হারাবে (পচে যাবে) অথবা অনুৎপাদিত অবস্থায় পাথরের ভাগ্য বরণ করবে। এক্ষেত্রে চীন, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহে সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজমের উত্থান ও পতন বা আত্মহত্যার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশেও এর ঢেউ লেগেছিল। কিন্তু মানুষের ফিতরাত পরিপন্থি হওয়ায় এ ব্যবস্থার এখন অনেকটা অপমৃত্যু হয়েছে।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যবৃন্দের তালিকাটি আমি বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। যে দশজন ‘মহিয়সী’ নারী নেত্রীকে নিয়ে কমিশনটি গঠিত হয়েছে তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতিমান হতে পারে, কিন্তু ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ও পারিবারিক আইন, এমনকি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি বিষয়ে তাদের অধ্যয়ন সম্পর্কে তাদের অতীত কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। তাদের শীর্ষস্থানীয় নেত্রীরা পূর্ব থেকেই সমাজ ও পরিবারকে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি পক্ষ তথা নারী পক্ষ ও পুরুষ পক্ষে বিভক্ত করে কাজ করে আসছেন। বিবাহের তাৎপর্য এবং পারিবারিক বন্ধন প্রভৃতি সম্পর্কে তাদের ধারণা স্বচ্ছ বলে মনে হয় না। আমি জানি না তারা সবাই বিবাহিত কিনা কিংবা পারিবারিক জীবনে তাদের স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন কেমন। তারা জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে তথা শিক্ষা-সংস্কৃতি, পরিবার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, রাজনীতি, উত্তরাধিকার, সম্পদে অধিকার, জাতীয় সংবিধান, চাকরি-বাকরি, আইন ও বিধিবিধান সর্বত্র শিশু, কিশোরী, যুবতী থেকে সকল শ্রেণির নারীর প্রতি বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন এবং তার প্রতিকার কামনা করে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। তাদের অবস্থানও পর্যবেক্ষণ এবং সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার গঠিত অপরাপর সংস্কার কমিশনসমূহ ছাড়াও তারা বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, নারী বিশেষজ্ঞ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নারী প্রতিনিধি, আদিবাসী নারী এবং আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করেছেন এবং ব্রেন স্টর্মিং সেশন করে করণীয় নির্ধারণ করেছেন। তাদের এ উদ্যোগ ও পরিশ্রম প্রশংসনীয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, তাদের এই এজেন্ডায় কোনও ইসলামী ব্যক্তিত্ব, আলেম-ওলামা বা ইসলামী সংগঠন নেই। অথচ যে দেশটির নারীদের জন্য তাদের এত পরিশ্রম সে দেশটির জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান, ৮ শতাংশ হিন্দু এবং বাকি ২ শতাংশ খৃষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। এদের মধ্যে মুসলমান ছাড়া বাকি সবার কথাই এতে বলা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ইসলামে নারী-পুরুষ বৈষম্য বলতে কিছু নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি (খলিফা) হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সূরা বাকারায় এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। এখানে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনও ব্যবধান নেই। উভয়ে সম মর্যাদাসম্পন্ন তার খলিফা। তারা নিজ কাজের জন্য আল্লাহর কাছে যেমন পুরস্কৃত হবেন, তেমনি খারাপ কাজ করলে তিরস্কৃতও হবেন। একইভাবে সূরা আর রুম-এর ২১ নং আয়াতে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, তিনি মানুষের মধ্য থেকেই সঙ্গী বা জোড়া সৃষ্টি করেছেন যাতে করে তারা অন্তরে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, দয়া ও অনুকম্পা নিয়ে পরস্পর প্রশান্তি লাভ করতে পারে।
আগেই বলেছি স্বামী-স্ত্রী নিয়ে পরিবারের সৃষ্টি। পরিবার হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বা জাতির ভিত্তি। বিয়ে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী বা পরিবারের ভিত্তি। রাষ্ট্র যেমন একজন নেতা বা রাষ্ট্রনায়ক ছাড়া চলতে পারে না তেমনি একটি পরিবারও নেতা ছাড়া চলতে পারে না। নেতার কাজ হচ্ছে অন্যদের পরিচালনা করা, তাদের খোরপোষ, শিক্ষা-দীক্ষা, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা, ব্যবস্থা করা। পরিবারের এ দায়িত্বটি আল্লাহ পুরুষের ওপর ন্যস্ত করেছেন। স্ত্রীদের ঘরের সম্রাজ্ঞী হিসেবে মায়ের দায়িত্ব দিয়েছেন।
এখন বিবাহের প্রসঙ্গে আসি। ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি একটি ধর্মীয় বিধান, নিছক সামাজিক চুক্তি নয়। পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন যে, বিবাহ অনুষ্ঠানে একটি খুতবা পাঠ করা হয়। জুমার নামায বা ঈদের নামাযে এবং হজে¦র দিনও খুতবা যেমন অপরিহার্য, তেমনি বিবাহ অনুষ্ঠানে খুতবা অবশ্য পাঠ্য একটি বিষয়ে। রাসূল (সা.) এটা পাঠ করতেন এবং তার অনুসারী হিসেবে সারা দুনিয়ার মুসলিম সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠানে এ খুতবা পাঠ করা হয়। বিয়েতে খুতবা পাঠ সুন্নাহ এবং এটি বিবাহ ও খুতবা দু’টিরই গুরুত্ব প্রমাণ করে।
এ খুতবায় ইসলামী জীবন দর্শনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হাজেরানে মজলিসকে অবহিত করা হয়, বিবাহ সংক্রান্ত শিক্ষাগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়, নারী-পুরুষের অধিকার আলোচনা করা হয়, যাতে করে তারা শুরুতেই তাদের পারস্পরিক দায়িত্বসমূহ সম্পর্কে অবহিত হয়ে বিবাহিত জীবন শুরু করতে পারে। ইসলাম অনুষ্ঠান সর্বস্ব নিছক কোনও ধর্ম নয়। এটি শুধু মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কই নিয়ন্ত্রণ করে না বরং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককেও নিয়ন্ত্রণ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের তিনটি চাহিদা আছে; যেমনÑ আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৈহিক। এ তিনটি চাহিদা পূরণের ভারসাম্যপূর্ণ সুষম ব্যবস্থা একমাত্র ইসলামেই আছে।
রাসূল (সা.) বিয়ের খুতবায় কুরআনের কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করতেন। এর মধ্যে একটি ছিল সূরা নিসার প্রথম আয়াত। এতে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মানুষ! আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহকে মান, তাকে মেনে চল যিনি তোমাদের একটি সত্ত্বা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সে সত্ত্বার মতো করেই তার সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন। যিনি তাদের দু’জন হতে সারা দুনিয়ায় বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন এবং আল্লাহকে ভয় কর যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাক এবং গর্ভকে ভয় করো (আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ককে বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর রকিব (তীক্ষè দৃষ্টি রাখেন)। (সূরা নিসা, আয়াত : ১)।
ইসলামের উত্তরাধিকার আইন, পারিবারিক আইন ও সাক্ষ্য আইনের বিষয়টি যেহেতু অনেক বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম সেহেতু সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরিবর্তে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন সেহেতু উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আগামীতে স্বতন্ত্র একটি নিবন্ধ লেখা আমি শ্রেয় মনে করি।