ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ হলেও গাজা পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। আজ সে বিষয়েই কিছু লিখতে হচ্ছে। ২১ মাসের ক্রমাগত ইসরাইলী হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাজায় ত্রাণের নামে চলছে মানুষ খুন। আর সে বিষয়টি উঠে এসেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনে । সর্ব সাম্প্রতিক খবরেও তার সত্যতা মিলেছে।

কী বলেছে অ্যামনেস্টি? তারা বলেছে, গাজায় গণহত্যায় ‘ক্ষুধা’কে অস্ত্রে পরিণত করছে ইসরাইল। এমন গুরুতর অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ৩ জুলাই প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানায়, গাজা উপত্যকায় ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য, পানি ও ওষুধ সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করছে।

সংস্থাটির মতে, এ কৌশল আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যার পরিচায়ক। সংস্থাটির মহাসচিব অ্যাগনেস কালামার্ড বলেন, ‘ইসরাইল জানে, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো ধ্বংস করে দিলে জীবন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি শারীরিকভাবে ধ্বংস করে ফেলার একটি পরিকল্পিত উপায়, যা গণহত্যার আওতায় পড়ে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, সহায়তার জন্য আসা অনেক ফিলিস্তিনি ইসরাইলি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে কিংবা পথে বের হলে গুলি বা বোমায় নিহত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি বলেছে, ‘ইসরাইলের অনুমোদিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) এখন কার্যত একটি মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে।’

খুবই ভয়ংকার সংবাদ। তাদের এ প্রতিদেনের সত্যতা আমরা দেখতে পাই প্রতিদিনের সংবাদে। এ বীভৎসতা শুধু নিন্দনীয়ই নয় সভ্য সমাজের জন্য একটি কলংকও বটে। সংস্থাটি আরও জানায়, গাজার সীমান্তে প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক অপেক্ষা করলেও ইসরাইলের বাধায় সেগুলোর অধিকাংশই ঢুকতে পারছে না। এতে খাদ্য ও ওষুধের সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া হামলায় এখন পর্যন্ত অপুষ্টিজনিত কারণে অন্তত ৬৬ শিশু মারা গেছে বলে জানায় অ্যামনেস্টি। আরও বহু শিশু মারাত্মক পানিশূন্যতা, সংক্রমণ ও রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে, যেগুলো পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসা থাকলে প্রতিরোধযোগ্য ছিল। নজির হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র চার মাস বয়সী জিনান ইসকাফি দুধ না পেয়ে মারাত্মক অপুষ্টি ও পানিশূন্যতায় মারা যায়। খান ইউনিস ও গাজার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের ১৫ শতাংশের মধ্যে গুরুতর অপুষ্টির লক্ষণ ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরাও নিজেদের অসহায়তা প্রকাশ করে বলছেন, তারা নিজেরাও বাস্তুহারা, দুর্বল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে কাজ করতে পারছেন না। ক্যাম্পে ফেরত আসা অনেক শিশু প্রাথমিক চিকিৎসার পরও আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

এরপর সংস্থাটি আরো স্পষ্টভাবে বিশ্ব মোড়লদের নিষ্ক্রিয়তার কথা উল্লেখ করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির ভাষ্য, ‘বিশ্ব নেতারা শুধু ব্যর্থ নয়, তারা ইসরাইলের এ ধ্বংসযজ্ঞ চলতে দিচ্ছে।’ তারা জোর দিয়ে বলেছে, ইসরাইলের জন্য সব ধরনের সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ইসরাইলি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও অস্ত্র ব্যবসা ও বিনিয়োগ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমালোচনার সুর আরও তীব্র হলো, যা গাজায় চলমান মানবিক সংকটের গভীরতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। সে মানবিক সংকটটি কতটা গভীর তা নিহতের হিসাব থেকে স্পষ্ট হবে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় শুরু হওয়া ইসরাইলি অভিযানের নামে গণহত্যায় এখন পর্যন্ত ৫৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ। হতাহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব তথ্য দিয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে জানা যাচ্ছে।

ত্রাণের নামে কীভাবে মানুষ খুন করা হচ্ছে তার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসছে আল জাজিরার খবরে। আল জাজিরা জানাচ্ছে, গাজার বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে এখন পর্যন্ত ৭০০-র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের একটি বিতর্কিত সাহায্য প্রকল্পের বিরুদ্ধে নিন্দা জোরদার হয়েছে। ৫ জুলাই গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, জিএইচএফ-এর বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে সাহায্য নিতে গিয়ে কমপক্ষে ৭৪৩ জন নিহত এবং ৪,৮৯১ জনের বেশি আহত হয়েছেন। গত মে মাসের শেষে গাজায় কার্যক্রম শুরু করা জিএইচএফ ইতোমধ্যেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারণ একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের ঠিকাদাররা এবং ইসরাইলি বাহিনী সাহায্য প্রার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। আল জাজিরার প্রতিবেদক হানি মাহমুদ মন্ত্রণালয়ের এ তথ্য সম্পর্কে বলেন, নিহতের এ সংখ্যাটিও আসলে কম। বাস্তবে বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে খাদ্যের প্যাকেটের জন্য অপেক্ষারত মানুষের হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।’ গাজা সিটির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মাহমুদ বলেন, ইসরাইলি অবরোধের কারণে গাজায় খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে এবং পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে সাহায্য নিতে আসছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ ক্ষুধার্ত। তারা যা পাচ্ছে তা দিয়েই সংসার চালাচ্ছে। অনেক পরিবার একেবারেই খেতে পারছে না। মায়েরা তাদের সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য নিজেরা খাওয়া বাদ দিচ্ছেন।’

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা এ চিত্র থেকে স্পষ্ট। আতংকের বিষয় জিএইচএফ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে সাহায্য নিতে আসা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সরাসরি গুলি এবং স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছে। জানা যায়, এ সংস্থাই ‘একমাত্র সংস্থা যারা গাজায় খাদ্য ও সাহায্য পৌঁছে দিতে পেরেছে’। জুনের শেষে ট্রাম্প প্রশাসন সংস্থাটিকে ৩০ মিলিয়ন ডলার সরাসরি তহবিল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

তবে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ত্রাণের নামে তারা আসলে প্রতিদিন অধিক সংখ্যক গাজাবাসীকে হত্যা করতে চায়। আর এ কারণে প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাৎক্ষণিকভাবে জিএইচএফের কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, এ সংস্থা ‘২০ লক্ষ মানুষকে অতিরিক্ত ভিড় ও সশস্ত্র এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রতিদিন গুলি ও ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটছে’। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ প্রকল্পকে ‘অমানবিক ও প্রাণঘাতী সশস্ত্র পরিকল্পনা’ বলে বর্ণনা করেছে।

ইসরাইলের দক্ষিণ অঞ্চলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাস। ওই সময় ১২শ’ ইসরাইলী নিহত হয় এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় তারা। জিম্মিদের মধ্যে ইসরাইলি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, নেপালসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকেরা ছিলেন। যুদ্ধবিরতির মধ্যে বন্দিবিনিময় এবং অন্যান্য চুক্তির মাধ্যমে ১৩৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। এর মধ্যে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সাত দিনের একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি চলে। সে সময় হামাস ১০৫ থেকে ১০৭ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়। ৭ অক্টোবরের পর ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ক্রমাগত পৈশাচিক হামলা চালিয়ে গাজাকে বলতে গেলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজারেরও বেশি সে কথা আগেই বলেছি। ২৩ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত গাজার জন্য এই সংখ্যা বেশ বড় একটি সংখ্যা। কিন্তু এরপরও বিশ্ব বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে জায়নবাদী ইসরাইল সেই হত্যালীলা বন্ধ করছে না। নিকট অতীতে তো নয়ই এভাবে যুদ্ধের নামে নিরপরাধ মানুষ খুনের এ ধরনের কোন নজির বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল।

এ যুদ্ধ ২১ মাস অতিক্রম করেছে। যুদ্ধ বিরতি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গাজা যুদ্ধ অবসানে গত ১৫ জানুয়ারি ইসরাইল ও হামাস যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করে। ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। চুক্তি বর্ধিত করার জন্য কয়েক সপ্তাহের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজায় ফের ভয়াবহ হামলা শুরু করে। তারপর থেকে ক্রমাগতভাবে তা চলছে। গাজায় ছয় সপ্তাহের প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতিকালে আটক জিম্মিদের মধ্য থেকে ২৫ জনকে মুক্তি দেয় এবং ৮ জনের মরদেহ ফেরত দেয় হামাস। এর বিনিময়ে ইসরাইলি কারাগার থেকে ১৮০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়া হয়। এখনো ৫০ জন জিম্মি হামাসের হাতে আটক রয়েছে, তার মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক জিম্মি মৃত বলে জানা যাচ্ছে।

এরপর ইসরাইল আর হামাসের মধ্যে যুদ্ধরিততি আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে কাতারে এ বিষয়ে আলোচনা চলমান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুই মাসের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিলে হামাস তাতে সম্মত বলে জানা যায়। হামাস যে সব দাবি করেছে তা মানতে রাজি নয় ইসরাইল। হামাস চায় স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি ও গাজা থেকে ইসরাইলী বাহিনি প্রত্যাহার। গাজায় নতুন করে যুদ্ধ বিরতির কথা কয়েক দিন ধরে শোনা গেলেও তার বাস্তবায়ন হবে কি হবে না এনিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। গার্ডিয়ান খবর দিয়েছে, কিছু বিষয়ে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে এখনো মতের অমিল থাকায় তা দূর করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাবেন। তার মানে, এ সফর হলে এ সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি হওয়া কঠিন। তবে একটা যুদ্ধ বিরতি ত্রাণের জন্য অপেক্ষমান মানুষের প্রাণ বাঁচাতে খুব প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।