DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার নেপথ্যে

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মহাখালি ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘অর্থনীতির পুনর্গঠন-সংক্রান্ত টাক্স ফোর্সের সুপারিশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় ব্যাংকিং ব্যবস্থার সমস্যা

Printed Edition
Default Image - DS

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মহাখালি ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘অর্থনীতির পুনর্গঠন-সংক্রান্ত টাক্স ফোর্সের সুপারিশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় ব্যাংকিং ব্যবস্থার সমস্যা এবং প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, সুশাসনের মাধ্যমে দেশের কিছু ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু কিছু ব্যাংক বাঁচানো সম্ভব হবে না। কারণ এসব ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের প্রচণ্ড অভার রয়েছে। এদের খেলাপি ঋণের হার ৮৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ জন্য একটি বিশেষ পরিবার দায়ী মন্তব্য করে তিনি বলেন, ১০০ টাকা ঋণ দেয়া হলে ৮৭ টাকাই এ পরিবারের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সরকারি সমর্থনপুষ্ট এ পরিবারটি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য অভিশাপ হিসেবে কাজ করেছে। তিনি আরো বলেন, ব্যাংকিং খাত উদ্ধারের জন্য ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোনো কোনো ব্যাংকেও সমস্যা রয়েছে। অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যাতে ব্যাংকিং খাতে কোনো রকম প্রভাব ফেলতে না পারে তা নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। গভর্নর অবশ্য এটা সুস্পষ্টভাবে বলেননি যেসব ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না তাদের পরিণতি কী হবে বা তাদের কিভাবে ব্যাংকিং খাত থেকে বিদেয় করা হবে। তবে গভর্নরের বক্তব্যে এটা সুস্পষ্ট যে, দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের এ বক্তব্য নানা কারণেই আলোচনার অবকাশ রাখে। অনেক দিন ধরেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। সরকার সমর্থক একটি লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংকিং সেক্টরকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আন্তর্জাতিক মানের আইন ছিল তা পরিবর্তনের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিদের আনুকূল্য দেয়া হয়েছিল। সাধারণ মানুষ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। ব্যাংক এমনই একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান যার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে আস্থা ও বিশ্বাসের উপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যে মন্তব্য করেছেন তা হয়তো ঠিক কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করতে পারেন কিনা? তার এ বক্তব্যের কারণে সাধারণ আমনতকারীদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা ব্যাংকিং সেক্টরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় আমানতকারীরা যদি আমানত প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে তার দায় কার উপর বর্তাবে। নিশ্চয়ই ভুলে যাবার কথা নয়, ২০২৩ সালে নভেম্বর মাসে ইসলামি ব্যাংকে বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটে। সে সময় একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে ‘ভয়ঙ্কর নভেম্বর’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সারা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। আমানতকারীরা আমানত প্রত্যাহার করে নিতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বক্তব্য যদি তেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তাহলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

ব্যাংকিং খাতকে একটি দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ বলা হয়। ব্যাংকিং খাত যদি ভালোভাবে পারফর্ম না করে তাহলে অর্থনীতি সঠিকভাবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত শুরু থেকেই নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশর সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেও রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। রাষ্ট্রীয়করণের পর পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অরাজকতা শুরু হয়। পরবর্তীতে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয়। সে সময় অনেকগুলো ব্যাংক ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু সেখানেও নানা অভিযোগ শোনা যায়। পানির দরে ব্যাংকগুলো দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের নিকট বিক্রি করে দেয়া হয়। ’৮০র দশকে ব্যক্তি মালিকানায় নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। প্রতিটি সরকার আমলেই রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। সবচেয়ে বাজে অবস্থার সৃষ্টি করা হয় গত সরকারের আমলে। সর্বশেষ ব্যক্তিখাতে ৯টি ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক অনুমোদন দানের বিরোধিতা করলেও তা ধোপে টেকেনি। সেই সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, এ মুহূর্তে দেশে নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে দ্বৈত শাসন চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থমন্ত্রালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যৌথভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের যতটা নিয়ন্ত্রণ আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা নেই। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয়। ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ। এম. সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে একবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করেছিলেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করে ব্যাংকিং সেক্টরের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে যেসব দুর্নীতিবাজ এবং দলবাজ কর্মকর্তা আছেন তাদের চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুত করে সৎ এবং দক্ষ লোকবল নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।

বিশ্বে দু’ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং এবং অন্যটি ইউনিট ব্যাংকিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইউনিট ব্যাংকিং পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। আর বৃটিশ ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। ইউনিট ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সামান্য কিছু সংখ্যক শাখা নিয়ে একটি ব্যাংক স্থাপিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে ৩/৪টি শাখা নিয়েও ইউনিট ব্যাংক স্থাপিত হয়। ইউনিট ব্যাংকিং ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সামান্য আঘাতেই একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়তে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক দেউলিয়া হয় সবচেয়ে বেশি। ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকের সংখ্যা থাকে তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু শাখা সংখ্যা থাকে প্রচুর। তারা শত শত এমনকি হাজার হাজার শাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাতেও পুরো ব্যাংক বিপর্যস্ত হয় না। বৃটিশ উত্তরাধিকার হিসেবে উপমহাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা কার্যত ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুরোপুরি ইউনিট ব্যাংকিং নয় আবার ব্রাঞ্চ ব্যাংকিংও নয়। এক ধরনের মিশ্র ব্যবস্থায় চলছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। ভারতে জনসংখ্যার অনুপাতে ব্যাংকের যে সংখ্যা বাংলাদেশে ব্যাংকের আনুপাতিক সংখ্যা তারচেয়ে অনেক বেশি। ব্যাংকগুলো একই ধরনের পণ্য ও সেবা নিয়ে বাজার অসম প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত রয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাতের যে ক্ষতি করা হয়েছে অতীতে কোনো সরকার আমলেই তা করা হয়নি। আ হ ম মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকিং খাতে অনুসৃত আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলো এমনভাবে পরিবর্তন করা হয় যার ফলে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বল এবং বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ব্যাংকিং আইনগুলো এমনভাবে পরিবর্তন করা হয় যাতে কিস্তি আদায় না করেও কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো যায়। ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। ঋণ খেলাপিদের নতুন করে ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে কোনো উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর একটি প্রকল্প ঋণ খেলাপি হলে অবশিষ্ট প্রকল্পগুলো ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির অযোগ্য বিবেচিত হতো। কিন্তু সে আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মোতাবেক, গত ডিসম্বের কোয়ার্টারে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, যা মোট ছাড়কৃত ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। কিন্তু এটা খেলাপি ঋণের প্রদর্শিত অংশ মাত্র। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকাও বেশি হবে। ঋণ খেলাপিদের মধ্যে দু’টি শ্রেণি আছে। এক শ্রেণির ঋণ খেলাপি আছেন যারা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃত ঋণ খেলাপি। আর একটি শ্রেণি আছেন যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করেই গৃহীত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না। এরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। এরাই ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। এরা সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের অনুগত্য প্রদর্শন করে থাকেন। কাজেই কোনো সরকারই এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। যারা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ঋণ খেলাপি তাদের কিস্তি পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। আর যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তাদের ‘জাতীয় শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে সমস্ত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে বয়কট করা যেতে পারে। তাদের সন্তানদের ভালো এবং অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার সুযোগ বন্ধ করা যেতে পারে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের পাসপোর্ট বাতিল করে তাদের বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের ন্যূনতম ছাড় দেবার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, কিছু ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। যেসব ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখা যাবে না তাদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তা তিনি বলেন নি। যেসব ব্যাংক কোনোভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় তাদের ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তুলনামূলক শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। অথবা তুলনামূলক সবল ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংককে অধিগ্রহণ করতে পারে। বিগত সরকার বিদায় নেবার কিছুদিন আগে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগের মধ্যেই কিছু প্রশ্ন ছিল। পদ্মা ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একইভাবে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসিকে সোনালী ব্যাংক পিএলসি’র সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একীভূতকরণের কথা বলা হলেও উদ্যোগটি ছিল কার্যত অধিগ্রহণের মতো। কারণ একীভূতকরণ করা হলে দু’টি ব্যাংকের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে নতুন একটি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করবে। যেমন, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত হয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নাম ধারণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। একীভূতকরণ করা উভয় প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিলীন করে নতুন নামে কার্যক্রম শুরু করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিলীন করে যদি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয় তাহলে সেটা একীভূতকরণ নয় সেটা হবে অধিগ্রহণ। কাজেই আমরা কি একীভূতকরণ করছি নাকি অধিগ্রহণ তা আগে নিশ্চিত হতে হবে।

সমস্যাগ্রস্ত যেসব ব্যাংক আছে যাদের কোনোভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় তাদের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে বলে দেয়া যেতে পারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা যদি ভালো করতে না পারে তাহলে তাদের কার্যক্রমক বন্ধ করে দেয়া হবে। একই সঙ্গে কোনো কোনো ব্যাংককে সরাসরি অবসায়ন করা যেতে পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই তাদের নিজস্ব যোগ্যতা বলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানকেই পেছন থেকে সহায়তা করে টিকিয়ে রাখার যুক্তি থাকতে পারে না। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে ৬১টি ব্যাংক ব্যবসায় পরিচালনা করছে। এটা দেশের জনসংখ্যা এবং আর্থিক সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি। ব্যাংকের সংখ্যা ২৫টি হবে নাকি ৩০টি হবে তা নির্ধারণ করে দেয়ার কোনো দরকার নেই। কর্তৃপক্ষকে বলে দেয়া যেতে পারে, তোমরা যদি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারো তাহলে বিদায় নিতে হবে। কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। ব্যাংক উদ্যোক্তাগণই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা টিকে থাকতে পারবেন না চলে যাবেন।

বিগত সরকার আমলে ব্যাংকিং খাতে চলমান যেসব আন্তর্জাতিক মানের আইন পরিবর্তন করা হয়েছে সেগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে পুনর্বহালের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে যারা কর্মরত আছেন এবং ভবিষ্যতে কর্মরত হবেন তাদের যোগ্যতার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হতে হবে সততা এবং সততা। কর্মীদের প্রশ্নাতীত এবং পরীক্ষিত সততা ব্যতীত ব্যাংকিং খাতে কোনো লোকবল নিয়োগদান অথবা নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কর্মজীবন অব্যাহত রাখা যাবে না। ব্যাংক এমন একটি খাত যেখানে পুঁজি গঠনের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের অবদান বা অংশীদারিত্ব খুবই কম। মোট পুঁজির ৯০ শতাংশই আসে সাধারণ আমানতকারীদের সংরক্ষিত অর্থের মাধ্যমে। কাজেই উদ্যোক্তাগণ ব্যাংকের মালিক হলেও তারা বিনিয়োজিত পুরো পুঁজির মালিক নন। আমানতকারীদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব এবং নিরাপত্তা দিতে হবে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেনো ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে কোনো পর্যায়েই দলীয় বিবেচনায় কর্মকর্তা নিয়োগদান করা যাবে না। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তাহলেই অর্থনীতি তার আপন গতিতে চলতে পারবে।