জন্মের পরপরই কোনো শিশু পথশিশু হয় না। এর পেছনে থাকে অনেক ঘটনা, যা আমরা অনেকে জানি না। অথচ তাদেরও ছিল নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার। কিন্তু তাদের জীবন তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে রাস্তায়। কেন একজন শিশু ফুটপাতে বড় হয় তা আমরা কেউ জানার প্রয়োজন অনুভব করি না। অথচ তারাও আমাদের মতো মানুষ- আমাদেরই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দাবি করছি তখনো এই দেশের একটি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের ঝলমলে আলোর মাঝে তাদের কান্না যেন অনুরণিত হচ্ছে। তারা হলো পথশিশু। আমাদের শরীর কেটে গেলে যেমন রক্ত বের হয়, তাদের শরীর কেটেও একই ধরনের রক্ত বের হয়। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য শুধু জীবনযাপনে, মানবিক অধিকার পাওয়ার সুযোগে। আমাদের সন্তানেরা যখন নিরাপদ বাড়িতে ঘুমায়, তখন তারা রাস্তায়, ফুটপাতে, ওভারব্রিজের নিচে, বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশনে বা উন্মুক্ত পার্কে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়।
আমাদের মায়েরা যখন শিশুকে ঘুম পাড়াতে ছড়া বলেন- ‘‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি, মোদের বাড়ি এসো, খাট নাই পালং নাই আসন পেতে বস। বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেও, খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে। কিন্তু তাদের মায়েরা ছড়া বলার সুযোগও পায় না। ছড়ার আগেই তারা ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্তির চাপে। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’- এ প্রবাদ বলে দেয়, প্রতিটি প্রাণী তার প্রকৃত পরিবেশে সুন্দর। শিশুর প্রকৃত স্থান তার মায়ের কোলে। বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীরা যেমন- পাবলো পিকাসো, লিওনার্দো ভিঞ্চি তাদের চিত্রকলায় শিশুকে মাতৃক্রোড়ে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা কত নির্মম! বহু শিশুই মায়ের কোলের উষ্ণতা পায় না। অনেক শিশু বড় হয় রেলস্টেশন, ফুটপাত, বাস টার্মিনাল, ফুটওভার ব্রিজের নিচে। অথচ তাদেরও জায়গা ছিল মা-বাবার স্নেহের আশ্রয়ে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস ১৭ জুন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক মিডিয়া পরামর্শ সভায় পথশিশুদের ভয়াবহ এক প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ৫৮% পথশিশুর জন্মসনদ নেই। ৯৪% শিশু সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত। শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা ও জন্মনিবন্ধন বিষয়ক এ সমীক্ষা পরিচালিত হয় ঢাকা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ শহরের ৬৬৭ জন পথশিশুর উপর পরিচালিত এ জরিপে উঠে এসেছে-৫১.৬ % শিশু স্কুল বা মাদরাসায় পড়ে না। শিক্ষা ও জন্মনিবন্ধনের এ ঘাটতি তাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অধিকাংশ শিশুর জন্মসনদ না থাকায় শিক্ষাসহ রাষ্ট্রীয় নাগরিক সেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদের মুখে নেই নিরাপত্তার হাসি, নেই পরিপাটি জামা, নেই কোন খাবারের নিশ্চয়তা, নেই ঘুমানোর ঠিকানা। তবু তারা বেঁচে থাকার সংগ্রামে পিছপা হয় না।
পথশিশু হওয়ার জন্য তারা মোটেও দায়ী নয়। দায়ী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিশেষ করে বাবা-মার বিচ্ছেদ। যখন বাবা-মা তুচ্ছ ঘটনায় আলাদা হয়ে যায়, তখন শিশুরা হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন। ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ যন্ত্রণা। তখন ফুটপাতই হয় তাদের ঠিকানা। আমরা অনেকেই তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করি। অথচ সমাজের উচ্চবিত্তরাই তাদের দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নেয়। কিন্ত প্রয়োজন ফুরালেই তাদের সমাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে। বাসা বাড়ি বা দোকানে যেসব শিশুরা কাজ করে তারাও নানাভাবে নির্যাতিত হয়। তাদের জীবনের বাস্তবতা বড়ই নির্মম ও নিষ্ঠুর। দিনের শেষে ফুটপাতে ভেন্না পাতার ছাউনি তৈরি করে কোনো রকমে তারা রাত কাটায়। একটু খানি বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে। তবু তারা থামে না। কখনো দিনমজুর, কখনো বাসের হেলপার, কখনো কারখানার শ্রমিকের কাজ, কখনো রিকশার চালক, কখনো চা বিক্রেতা, কখনো টোকাই, কখনো ফুল বিক্রেতা হয়ে জীবন চালিয়ে নেয়। যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা, প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে তারা নেমে পড়ে কঠিন জীবন যুদ্ধে। রাজধানীর ফুটপাতে তাকালেই দেখা যায়, শিশুরা মশার কামড় থেকে বাঁচতে পলিথিন মুড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। অথচ আমাদের সন্তানরাও তাদের বয়সী। আমাদের সন্তানদের নিশ্চিত ঘুম হওয়ার জন্য কত ব্যবস্থা করি। কিন্তু তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য পথশিশু দেখা যায়। প্রতিনিয়ত তাদের পাশ দিয়ে চলে যায় মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ল্যান্ড ক্রুজারসহ বিলাসবহুল গাড়ি। আমরা আনন্দ উৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ করি। কিন্তু তাদের জন্য খরচ করতে মন গলেনি। যারা অঢেল সম্পদের মালিক তারা ইচ্ছে করলে কিছু পথশিশুকে পুনর্বাসন করতে পারেন। অথচ এসব শিশুদের দিকে কারো নজর পড়ে না। তাদের বসবাস করার মতো কুটির নেই। ফলে তারা কখনো ফুটপাতে, কখনো ব্রিজের নিচে, কখনো রাস্তার এক কোনায় রাতযাপন করে। কী বৃষ্টি, কী রোদ, কী বৈশাখী ঝড়, কী শীত সবই যেন তাদের গা সওয়া, নিত্য দিনের সঙ্গী। বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের ২০০৫ সালের জরিপে দেখা যায়- পথশিুদের মধ্যে ১৬% ছেলে ও ৮৪ % মেয়ে। ২০১৫ সালে দেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ। ২০২৪ সালে দ্য কোয়ালিটি স্টাডি অন চিলড্রেন লিভিং ইন স্ট্রিট সিচুয়েশনস ইন বাংলাদেশ ২০২৪ শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে পথশিশুর সংখ্যা ৩৪ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায়- প্রতি ১০ জন পথশিশুর ৮ জনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়। শুধু নির্যাতন নয়; তারা নিরাপত্তাহীনতা, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, পুষ্টির অভাবে ভুগছে। ৯ বছরের ২৪ লাখ পথশিশু বেড়েছে। এভাবে যদি সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা। সুতরাং এখই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
পথশিশুদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তা পথশিশুদের কঙ্কালসার শরীর দেখলেই বোঝা যায়। উন্নত দেশগুলোতে শিশুর সকল দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্র নেয়, তেমনিভাবে আমাদের দেশেও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়া প্রয়োজন। সরকার চাইলে দেশের উন্নয়নে পথশিশুদেরকে সম্পদে পরিণত করতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও পথশিশুর সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। পথশিশুদের জীবনকে আলোকিত করার স্বার্থে পুর্নবাসন প্রয়োজন। প্রয়োজন নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা। তা না হলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ভাষ্যমতে ৮৫% পথশিশু মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা সংগ্রহ না করতে পেরে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ফলে তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং, ঘটছে চুরি, ডাকাতি, এমনকি খুন। দিন শেষে এরা হয়ে ওঠে ভয়ংকর অপরাধী। কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছিলেন- ‘‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’’। অর্থাৎ আগামী দিনের সুন্দর নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে শিশুদের জন্য আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। আমরা এ দায় এড়াতে পারি না। শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। যেন আর কোনো শিশুর নামের আগে ‘পথশিশু’ শব্দটি না থাকে। এ কাজে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। কারণ ছোট ছোট ভালো কাজ বদলে দিতে পারে সমাজ, পরিবার, এমনকি দেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক।