এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের শাসনামলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা হয়েছিল। যে শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে প্রাসঙ্গিক ছিল না। পাকিস্তান জন্মের পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ইতিহাসে সংঘটিত নানা ঘটনার মধ্যে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত। ৫০দশকের স্বাধিকার আন্দোলন এবং ষাটের দশকের শেষ নাগাদ স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হয়েই শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের সচিব ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সাবেক শিক্ষক এসএম শরিফকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। তার নামেই শিক্ষার উন্নয়নের জন্য শরিফ কমিশন গঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬ জন ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪ জন নিয়ে কমিশনটি গঠন করা হয়েছিল। ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্টে কমিশনের সুপারিশসমূহ প্রতিবেদন আকারে প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করা হয়। আর ১৯৬২ সালে তা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। ৬২ সালের আগস্ট মাসেই পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলনের একটি নতুন দিগন্ত শুরু হয়। ততদিনে শরিফ কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে, যা ছাত্রদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য ছিল না।
৬২’র ‘শিক্ষা আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিত এ গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন রাজনৈতিক ভাবেও ইতিহাসে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সে আন্দোলনই সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন, ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং অবশেষে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সমগ্র জাতিকে অন্রপ্রানিত করেছে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে দমন-পীড়ন ও রাজনীতিকদের ধ্বংস করার সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছিল। তার অত্যাচার নির্যাতনের ফলে পাকিস্তানে তথা পূর্ব পাকিস্তানে এক চরম রাজনৈতিক শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৬২-এর ‘শিক্ষা আন্দোলন’ আইয়ূব শাহির ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে রাজনৈতিক শূন্যতা ভেঙে গোটা পরিবেশকে রাজনীতির পক্ষে নিয়ে এসেছিল। আর সে আন্দোলনের অনুঘটক হিসাবে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এ দেশের ছাত্রসমাজ। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঐক্যবদ্ধ করে সামরিক শাসনকে আঘাত করা। তাই এ আন্দোলন ছিল সরকারের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির জন্য পথ নির্দেশনা।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি পর্যন্ত সংসদীয় রাজনৈতিক কাঠামো টিকে ছিল। কিন্তু এক দশকের বেশি এ সময়কালে ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত, হানাহানি তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম দুর্বলতার কারনেই ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য সে সময় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বা প্রতিক্রিয়া খুব বেশী লক্ষণীয় ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় হতাশ ও ক্লান্ত জনগণ অল্প সময়ের জন্য সামরিক শাসকের অনুগত হয়ে পড়েছিল। মূলত সে সময়কাল রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রকৃত কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৌল কাঠামোর মধ্যেই নিহিত ছিল। কিন্তু, ’৬২-এর আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জনগণের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ও শাসকদের মূল চরিত্র উদঘাটিত হয়েছিল। সুতরাং, সামরিক শাসন ও এর প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ জনগণ তাই আশাও করেছিল কিছুটা। কিন্তু অচিরেই তাঁদের সকল আশাভঙ্গ ঘটে।
১৯৪৭-৫৮ পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্ব তেমন সাফল্যের পরিচয় দিতে না পারলেও এ সময় বাঙালিদের অর্জনও কম ছিল না। এ সময়ই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালি জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয় ছিল বাঙ্গালি রাজনীতিক নেতৃত্বের ঐতিহাসিক অর্জন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির জাতিসত্তা বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়, পক্ষান্তরে ১৯৫৪-র নির্বাচনে বাঙালির ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে সৃষ্ট আন্দোলনের পথ উন্মোচিত হয়। পঞ্চাশের দশকের এ দুটি ঘটনা বাঙ্গালির চেতনাবোধকে জাগ্রত করেছিল। বস্তুত এ সময় থেকেই জনগণ চিন্তায়, মননে, প্রথা-প্রতিষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা স্পষ্ট রূপ লাভ করতে শুরু করে।
সামরিক শাসক ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে যে শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধেই ’৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহবান করা হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল দুর্বার আন্দোলন। সে ধর্মঘট পালনকালেই মিছিলে গুলি করে পুলিশী এই হত্যাকান্ডের সূচনা হয়। আন্দোলনের তীব্রতায় বেগতিক হয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খান শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ’৬২ শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতর বাঙ্গালি জনগোষ্টির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বাংলা ভাষা ধংসের চক্রান্ত শুরু করে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্দূর কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশী হামলায় ৭ জন বামপন্থী রাজনীতিককে হত্যা ও ৩২জনকে আহত করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে গুলি বর্ষনের মাধ্যমে হত্যা করে সালাম, বরকত, রফিক, সফিক ও জব্বারকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ’৯২-এর ‘ক’ ধারা জারির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।
স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থবিরোধী নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের শাসকেরা, শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিকশিত করার পরিবর্তে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এসকল ঘটনার কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন এবং রাজনৈতিক মহলে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবেই ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল।
শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান অনগ্রসরতা সত্ত্বেও তিন বছরের সামরিক সন্ত্রাস ও জুলুমের ফলে আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক ইস্যুই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ জন্য পরোক্ষ প্রস্তুতি ও প্রত্যক্ষ পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছিল সেসময় এদেশের ছাত্র সমাজ। পরোক্ষ প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৬১ সালের শহীদ দিবস উদযাপনের সাংগঠনিক উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৬১ সালেল শহীদ দিবসকে সামনে রেখে সামান্য হলেও রাজনৈতিক শক্তি ও ছাত্রসম্প্রদায় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ছাত্র সংগঠনসমূহও এ ব্যাপারে অগ্রসর ভূমিকা পালন করেছিল।
সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ছাত্রলীগ, ছাত্র শক্তি ও ছাত্র ফেডারেশনের এক যৌথ সভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি জাহান আরা আখতার সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র রাজনীতি সাংগঠনিকভাবে নিষিদ্ধ থাকায় এ সভায় নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদেরকে সরকারের নিকট ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার দাবি জানাতে বলা হয়। তাছাড়া যথাযথ মর্যাদায় শহিদ দিবস পালনের কর্মসূচিও গৃহীত হয় এবং ছাত্ররা তা যথাযথভাবে পালন করে। সামরিক শাসনের আওতায় পূর্ববর্তী দু’বছরের তুলনায় ১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনে অধিকতর ব্যাপক কর্মসূচি পালন ছাত্রদের সামরিক শাসন উপেক্ষা করার মানসিক প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত দেয়া হয়।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক সামাজিক সংগঠনের তৎপরতা বেআইনি করে সকল ধরনের মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, চলেছিল চরম দমননীতি। এরই মধ্যে ’৬০ সালের দিকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা গোপন সমঝোতা ও যোগাযোগ রেখে নিজ নিজ সংগঠন গোছানোর এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেন। এভাবে ছাত্র সংগঠন দু’টি ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে এবং সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তোলে।
তৎকালীন দুই বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এবং ডাকসু ও বিভিন্ন হল ও কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সাধারণ ছাত্র সমাজের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। যার ফলে সকল আন্দোলন ও কর্মসূচির প্রতি সাধারণ ছাত্র সমাজের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সূচিত আন্দোলন দমন করার জন্য গ্রেফতার, মামলা, হয়রানি, নির্যাতন, এমনকি বেত্রাঘাতসহ বর্বরোচিতভাবে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন ও হরতাল কর্মসূচি ঠেকানোর জন্য চরম নির্যাতনমূলক পথ গ্রহণ করা হয়। ঐ দিন ঢাকাসহ দেশের সকল শহরের রাজপথে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকে। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ইত্যাদি সেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ দমন করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে ছাত্রদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল আব্দুল গণি রোড হয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ পেছনে থেকে অতর্কিতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। সেদিন পুলিশের গুলিতে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। সারা দেশে পুলিশ ও ইপিআর-এর নির্যাতন ও গুলিতে বহু ছাত্র-জনতা আহত হয়।
১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ছাত্র আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠে। ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ জনগণ ছাত্র সমাজের প্রতি আরও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন। সারা দেশে তিন দিনব্যাপী শোকের কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে এক ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনগণের সমর্থিত ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়ে আইয়ুবের সামরিক সরকার তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও শিক্ষার অধিকার এবং বিশেষ করে পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির স্বার্থে প্রণীত গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল, আধুনিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরেই ছাত্রসমাজ পরবর্তীকালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছিল।
দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি মানচিত্র, স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছে জাতি। পেয়েছে একটি শিক্ষা দিবস। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ দিবসটি এখন আর কেউ স্মরণ করে না। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে শিক্ষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অথচ, সেই দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবেও পালন করা হয় না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষা ও ছাত্র আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ এ ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই অজানা ইতিহাসের এ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা। তারা বঞ্চিত এর তাৎপর্য অনুধাবন থেকে।
এত সময় পড়ে এসেও শিক্ষায় অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলোতে দলীয়করণের ভূত চেপে আছে। ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার লোক অগ্রাধিকার পায়। ফলে শিক্ষার গুণগতমানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের টাকার কমিশন বণ্টনে সমঝোতা করতে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালীদের। সৃজনশীল আর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ+ আর গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারছে না। ফলে নতুন করে কারিকুলামের বিষয়টি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে টাকা বৃদ্ধির কোনো লক্ষণ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিকমানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা শিক্ষা ব্যবসা শুরু করে শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো, যার টাকা আছে সে সেটা কিনতে পারবে। এটি জীবন দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক, তবে এটিই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে।
ছাত্রসমাজের সার্বজনীন শিক্ষার যে আকাক্ষা, তা আজও পূরণ হয়নি। কিছুটা সংশোধন হলেও সেই ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলে কেরানি কর্তৃক নির্মিত শিক্ষাব্যবস্থা এখনও বহাল আছে। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। ১৯৬২ সালের এ দিনটিকে স্মরণ করে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈরাজ্যকর অবস্থার বিরুদ্ধে দেশেপ্রেমিক জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ’৬২-এর শরীফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, পরবর্তী সময়ে ৬৬’র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী ও ছয় দফার আন্দোলন, ১৯৬৯-এর নুর খান শিক্ষা কমিশন ও গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ এ স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলন ও ২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণআন্দোলনে ইতিহাস রচনায় গভীর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এ শিক্ষানীতির প্রতিবাদ ও আন্দোলনগুলো। সেদিন বাংলার ছাত্রসমাজই পালন করেছিল নতুন ইতিহাস নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা।
লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।