সালমান ফারসি

বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব, মানবতার মা (তকমা নেয়া) থেকে দানবী হয়ে উঠা শেখ হাসিনা ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে সম্প্রতি একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক নিউজ চ্যানেল আল জাজিরা। যেখানে শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদ তাড়িয়ে বাংলাদেশে নতুন যুগের সূচনা হলো নাকি আসলে মিথ্যা ভোর ছিল জুলাই বিপ্লব? এ মিথ্যা ভোরের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে যেসব বিষয় তুলে আনা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে, এক বালতি দুুধে যেন এক ফোঁটা গোচনা।

৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড এর ওই তথ্যচিত্রে ৪২ মিনিট থেকে মূলত এর শুরু। সেখানে দেখানো হচ্ছে, পুরান ঢাকায় এবারে সাকরাইন উৎসব হয়নি। কারণ কট্টরপন্থীরা এটা বন্ধে প্রতিবাদ করেছে। সাকরাইন উৎসব প্রসঙ্গে বাংলা সাবটাইটেলে বলা হয়েছে (অবশ্য এটা আলজাজিরা নিজে দিয়েছে, নাকি ইউটিউব থেকে অটো হয়েছে তা বুঝা যাচ্ছে না। তবে ইংরেজির সঙ্গে মিলে যায়) প্রতি জানুয়ারিতে, পুরান ঢাকার বাসিন্দারা সাকরাইন উৎসবের জন্য ঘুড়ি ওড়ান এবং আতশবাজি ফোটান, যা একটি নতুন ফসল কাটার মৌসুমের সূচনা করে।

আর এই উৎসব বন্ধ করা প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, ধর্মীয় রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের ছাদের পার্টিতে ডিজে, নাচ এবং কখনও কখনও মদের আয়োজনের বিরোধিতা করে আসছে। এই বছর তারা তাদের থামাতে সাহসী বোধ করেছে। কেন সাহসী বোধ করছে আল জাজিরার ভাষায়, ”কিন্তু অনেক হিন্দু এবং ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম আশঙ্কা করছেন যে, কট্টরপন্থীরা ক্ষমতার শুন্যতা পূরণের চেষ্টা করছে। এমনকি এই পারিবারিক ঘুড়ি উৎসবও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

যে উৎসব বন্ধ হওয়াকে আলজাজিরার মত একটি নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আবারো বাংলাদেশের ইসলামোফোবিয়াকে সামনে নিয়ে আসছে, সেই উৎসব যে একটা ভুয়া উৎসব, আদি উৎসবের সঙ্গে কোন মিল নেই সেটা একটু পরই আমরা দেখবো। তার আগে, একটু দেখে নিই নিউজ তথ্যচিত্রেই এই উৎসবকে একবার বলছে নতুন ফসল কাটার মৌসুমের উৎসব। আবার বলছে পারিবারিক উৎসব।

ফসল কাটার সূচনা বললে, বুঝতে হবে এটা ঐতিহ্যবাহী উৎসব। বহুকাল ধরে চলে আসছে। আর পারিবারিক ঘুড়ি উৎসব হলে, এটাতে ডিজে পার্টি বা মদের আয়োজনতো থাকার কথা নয়। যেটা আলজাজিরাই উল্লেখ করেছে (উপরেই বলেছি) এ কারণে ধর্মীয় রক্ষণশীলরা এর বিরোধিতা করছে। তার মানে, উৎসবের নামে এক ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ হতো যেটার বিরোধিতা হয়েছে। টুপি পরা কিছু মানুষ তার বিরোধিতা করায় এখানে ধর্মীয় রক্ষণশীল কোথায় দেখলো আলজাজিরা?

এটাতো ওখানকার একটি সামাজিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই উৎসবের নামে সেখানে যেভাবে শব্দ দূষণ হতো তাতে পুরান ঢাকার সব বয়সী মানুষেরা বিরক্ত ছিল। এসব আয়োজনের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পাতি নেতারা জড়িত ছিল। যারা ডিজে ভাড়া, মদ বিক্রি এবং আরো নানা ধরনের অসামাজিক কাজের মহড়া বাসাতো টাকা আয়ের জন্য। দেশের গণমাধ্যমগুলোতে এ সংক্রান্ত নিউজও বার বার এসেছিল (https://www.jugantor. com/capital/903712)। বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনেও এই উৎসবকে বলা হয়েছে, শব্দ দূষণের উৎসব (https://www.bbc. com/bengali/news-46874687)।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তারা ছোট বেলায় পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে যে ঘুড়ি উৎসব দেখেছেন তার কিছুই এখন নেই। তার বদলে ডিজে পার্টি মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর এটা সেখানে তৈরি করছে মারাত্মক শব্দ দূষণ। আর এর প্রতিবাদ করেছে কিছু দাড়ি টুপি পরা এলাকার যুবক, যেটাকে ইসলামোফোবিয়া হিসেবে তুলে আনছে আলজাজিরার মত মিডিয়া? আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না।

এই উৎসবের সঙ্গে হিন্দুদের পূজার একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেই পূজা কি বন্ধ করে দিয়েছে এসব ইসলামিস্টরা? নাহ, সেরকম কিছু আলজাজিরার তথ্যচিত্রে নেই। যেটা আছে সেটা ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর একটি মন্দিরে হামলা সংক্রান্ত। তবে এই ধরনের হামলাকে ভারত যেভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা বলছে, এগুলো সেই ধরনের কোন হামলা নয় বলে নিশ্চিত করেছে আলজাজিরা। তাহলে সাকরাইন উৎসবকে কেন্দ্র করে কেন আবারো ইসলামোফোবিয়াকে সামনে আনা হলো?

শুধু তাই নয় উৎসব বন্ধ হওয়াকে কিভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে দেখুন, “একমাত্র কোলাহলপূর্ণ উদযাপন, প্রকৃতপক্ষে, একমাত্র আতশবাজি, মূলত হিন্দু ভবনগুলিতেই হয়। বেশির ভাগ মুসলিম তাদের জানালার আড়াল থেকে দেখেছেন। গত বছর ছিল একটি সাধারণ পার্টি, এই বছর একই ছাদ খালি।”

মুসলিমদের কথা যখন বলা হচ্ছে তখন একটি বাচ্চাকে দেখানো হচ্ছে। এখানে কিভাবে তার মুসলিম পরিচয় ফুটে উঠলো বুঝা যাচ্ছে না। আবার হিন্দুদের কথা বলা হচ্ছে, সেই সিম্বলও তথ্যচিত্রে নাই। এই ইস্যুতে চাইলে সেখানকার স্থানীয়দের বক্তব্য নিতে পারতো আলজাজিরা। সেটা করা হয়নি। কী কারণে সাকরাইন উৎসব বন্ধ হলো তার সঠিক ব্যাখ্যা আসতে পারতো এই তথ্যচিত্রে। কিন্তু সেটা অনুপস্থিত ছিল।

যিনি তথ্য চিত্রটি বর্ণনা করছিলেন, তিনি পুরান রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বলছিলেন, ”উৎসব শুরু হওয়ার আগে, তরুণ ইসলামী কর্মীরা এই পাড়া দিয়ে এসে লোকদের এই উৎসবে অংশ না নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এখন সব দিক দিয়েই তারা বেশ ভদ্র ছিল, কিন্তু বাসিন্দারা বার্তাটি বুঝতে পেরেছিল।”

খেয়াল করুন এখানে তরুণ ইসলামী কর্মীর বর্ণনা করা হচ্ছে। এরা তাহলে কোন ইসলামী দলের কর্মী? সেটা বলা হয়নি। আলজাজিরার মত নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের তথ্যচিত্রে এমন দুর্বলতা সচেতন দর্শক আশা করে না। কেন এমন করলো তা ভাবতে গিয়ে একটা বিষয় চোখে আসলো। এই তথ্যচিত্রটি চারজন মিলে তৈরি করেছেন, তার মধ্যে একজন ছিলেন জুলকারনায়েন সায়ের। যাকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি।

তিনি জুলাই বিপ্লবের পক্ষে এবং হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে অসাধারণ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি সব সময় ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু তার মধ্যে ইসলামোফোবিয়া কাজ করে, যেটা তার ফেসবুক ঘাটলে বুঝা যায়। অথচ এই ইস্যুকে সামনে রেখেই হাসিনা হাজার হাজার মানুষকে গুম, খুন করেছে। জনাব সায়ের হাসিনার গুম, খুনের বিরোধী কিন্তু এই ফোবিয়া থেকে বের হতে পারছেন না।

এর ছোট্ট প্রমাণ মিলে, শনিবার ৩ মে হেফাজতের সমাবেশে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নারী কমিশন নিয়ে করা মন্তব্য তার ফেসবুকে শেয়ার নিয়ে। তিনি শেয়ার দিয়ে বলছেন, “জনাব, একটি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হইয়া রাজনীতিবিদদের সাথে একই মঞ্চে দাঁড়াইয়া জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়া তো সাংবাদিকতার সাথে সাংঘর্ষিক! তার উপ্রে আপনি সাংবাদিক হিসেবে একুশে পদক জয়ী বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব!”

সায়ের হয়তো ভুলে গেছেন, হেফাজতে ইসলাম কোন রাজনৈতিক দল নয়। তারা অরাজনৈতিক ইসলামিক প্ল্যাটফর্ম। নারী কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতিবাদ হিসেবে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মাহমুদুর রহমানকেও তারা দাওয়াত দিয়েছেন। আর একুশে পদক পেয়েছেন বলে এসব প্রোগ্রামে যাওয়া যাবে না, সেটা কি পদকের শর্তে লিখা আছে কিনা আমাদের জানা নেই।

যাহোক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, নারী কমিশন তৈরির জন্য জুলাই বিপ্লবে কেউ জীবন দেয়নি। জনাব সায়ের বলুক তাহলে জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা কেন জীবন দিয়েছিল? তিনিতো অন্য অনেকের চেয়ে এ বিষয়ে আরো ভালো জানেন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তো তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।

আসলে, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে ব্যবহার করে কিছু রাজনৈতিক ফায়দা হয়তো কেউ নিতে চায় কিংবা নেয়, সেটার জন্য জুলাই বিপ্লব পরবর্তী ফ্যাসিবাদ তাড়ানোর সফলতাকে আবারো আগের মত ইসলামোফোবিয়া দিয়ে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা এই দেশকে আগের মতই অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার শামিল বলেই মনে হয়।

একটি সমাজে হিন্দু জনগোষ্ঠী বা অন্য ধর্ম বা বিশ্বাসের কেউ যেমন তার ধর্মীয় সিম্বল নিয়ে গর্ব করবেন, ঘুরে বেড়াবেন একই ধরনের অধিকার মুসলিমেরও আছে। তারা কোন অন্যায় নিয়ে প্রতিবাদ করলে কট্টরপন্থী, রক্ষণশীল হিসেবে কেন চিহ্নিত হবেন সেটার ব্যাখ্যা জনগণের জানার অধিকার আছে বলে মনে হয়। আলজাজিরার উচিত হবে এই বিষয়ে আলাদা করে একটি তথ্যচিত্র করে সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরা।

লেখক-সাংবাদিক ও গবেষক।

[email protected]