আসাদ পারভেজ

ফিলিস্তিন বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু যেখানে মানবতা প্রশ্নবিদ্ধ! ফিলিস্তিন সংকট মূলত একটি ভূরাজনীতি ও মানবিক সংকট, যার মূল শিকড় ২০শতকের গোড়ার দিকে। এটি অবৈধ রাষ্ট্র ইজরাইল ও ফিলিস্তিনীদের মধ্যে স্বাধীকার, জমি ও জাতীয় স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের বিরোধ। অথচ এ ভূমির ইতিহাস সমৃদ্ধ।

ফিলিস্তিনের আদি হিব্রু জনগোষ্ঠীরাই ৬৩৬-৩৭ সালে ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়েছিল। এরা জেরুজালেমকে মধ্যমনি করে আবাদের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০৪২৯ বর্গমাইলের দেশ ফিলিস্তিনকে উর্বর করে তুলেছিল। শান্ত প্রকৃতির এ সকল মুসলমানেরা বুক আগলে স্থান দিয়েছিল দু’হাজার বছরের যাযাবর জাতি ইহুদিদের। আজ সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। হত্যা, খুন, গুম সেখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। দখলদার ইজরাইলি পাপিষ্ঠরা ফিলিস্তিনীদের স্বীয় মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করার বীভৎস খেলায় মেতে উঠেছে। অথচ গল্পটা ছিল ভিন্ন। সারা পুথিবীতে প্রত্যাখ্যাত ইহুদিরা উদার ফিলিস্তিনীদের সরলতার সুযোগে পবিত্র ভূমিতে গেঁড়ে বসে। কৌশলে দখল করতে থাকে ফিলিস্তিনীদের মাতৃভূমি। আরবদের অভ্যন্তরীণ দলাদলি আর আমির-ওমরাদের ঔদাসীন্য ইজরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের ভিত মজবুত করে দেয়। তাতেই নিজভূমে পরবাসী হয়ে উঠার বেদনাময় উপাখ্যান তৈরি হয়।

আরব ফিলিস্তিনীদের হাতে ১৪শ’ বছরের গড়ে উঠা উর্বর ফিলিস্তিনে ১৯৪৮ সালে বিষবৃক্ষ রোপন করে জায়নবাদীরা। এতে করে ফিলিস্তিনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য অস্তিরতায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছে— যার পুরোটা সুবিধা নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় খ্রিষ্ট সমাজ। প্রতিনিয়ত আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ রাষ্ট্র ইজরাইল। এরইমধ্যে বৃহৎ আকারে ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ (ইওম কিপুর যুদ্ধ) এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালের যুদ্ধ চলমান।

৭ অক্টোবর, ২০২৩ শনিবার স্থানীয় সময় ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে গাজার শাসকগোষ্টি হামাসের মিলিটারি উইং কসম ব্রিগেড নজিরবিহীন আক্রমণে ইজরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করে— হামলায় হামাস যোদ্ধারা ইজরাইলের কিবুজ, সামরিক ঘাঁটি ও বেসামরিক এলাকা দখল করে। এতে ইজরাইলের এতোদিনের নিরাপত্তা বিষয়ক যাবতীয় দম্ভ চুরমার হয়ে যায়। অবশ্য এর কারণে আরেকটি অসম যুদ্ধের দ্বার খুলে যায়। এ যুদ্ধের পরিণাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে-তা যুদ্ধরত পক্ষ দুটিরও জানা নেই। এ আক্রমণে ইজরাইলের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য’সহ ১২ শতাধিক মানুষ নিহত এবং শতাধিক ইজরাইলিকে অপহরণ করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে কি, এ হামলায় ইজরাইল হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। হামাস সদস্যরা গাজা থেকে সময় হামাসের সশস্ত্র সদস্যরা কাঁটাতারের বেড়া বুলডোজার দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ হাজার রকেট হামলা চালিয়েছে। ঠিক সে সময় হামাসের সশস্ত্র সদস্যরা কাঁটাতারের বেড়া বুলডোজার দিয়ে ছিঁড়ে ইজরাইলের সীমানায় প্রবেশ করেছে এবং একই সঙ্গে প্যারাগ্লিডার ব্যবহার করে উড়ে গিয়ে ইজরাইলের ভূখণ্ডে নেমেছে। সমুদ্রপথেও স্পিডবোটযোগে হামলা চালায় হামাস। হামাস এ হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’।

কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে এমন হামলা হঠাৎ শুরু হবে এবং ইজরাইল এতটা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে-তা ভাবতে পারেনি। ইজরাইলের গোয়েন্দা ব্যবস্থা পৃথিবীখ্যাত। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হামাসের মতো একটি সংগঠন এমন হামলা চালাতে পারে, সেটা অনেকের কাছেই কল্পনাতীত। এমন ভয়াবহ হামলার ঘটনা গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে তারা দেখেনি। এত মৃত্যুর ঘটনাও গত ৫০ বছরে ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের পর ইজরাইল প্রত্যক্ষ করেনি। সে ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ একই সঙ্গে রমজান মাসের যুদ্ধ বা অক্টোবর যুদ্ধ নামেও পরিচিত। সে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর। সে কারণে কেউ কেউ বলছেন, সে যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ হামলা চালানো হয়েছে। সেটা খুব একটা সঠিক কথা বলে মনে হয় না। কারণ হামাস এ বিষয়ে সেরকম কোনো স্টেটমেন্ট দেয়নি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, হামাস বেশ কিছুকাল ধরে রকেট জমিয়েছে এ হামলা করার জন্য। হামাসের জানা ছিল, দু-একশ রকেট ছুড়লে তা ইজরাইলের বিশেষ প্রযুক্তির আয়রন ডোম ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু অসংখ্য রকেট ছুড়লে, তা ধ্বংস করতে পারবে না। বিষয়টা তাই হয়েছে। প্রথমদিকের কিছু রকেট ইজরাইল ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু হামলার সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, আয়রন ডোমে কাজ হয়নি।

এ ঘটনার পরপরই ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘উই আর অ্যাট ওয়ার’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পরে ইজরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হেরসগও বলেছেন, এ যুদ্ধ অনেকদূর গড়াবে। গাজার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে এবং মুহুর্মুহু বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা লাগাতার চলছে। ইজরাইল এক লাখের অধিক সৈন্য নামিয়েছে। অন্যদিকে হামাসের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলারা লেবানন থেকে ইজরাইলে রকেট ছুড়তে শুরু করে। যে কারণে ইজরাইলের বাহিনী লেবাননেও সুনির্দিষ্ট স্থানে হামলা করতে শুরু করে।

আন্তর্জাতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি দেশকে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলো ইজরাইলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবিচল সমর্থনের কথা বলেছেন। জার্মানি ফিলিস্তিনে প্রদত্ত আর্থিক সহায়তা বন্ধের বিবেচনার কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে ইরান হামাসকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া এবং ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ জেনারেল সেক্রেটারি জিয়াদ আল নাকালার সঙ্গে টেলিফোনে এ হামলার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। কাতারও হামাসের হামলাকে সমর্থন জানিয়েছে।

অবশ্য ইজরাইল এ হামলায় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও নতুন করে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছ থেকে গাজায় হামলার অনুমোদন পেল। ২০০৫ সালে গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পর পশ্চিমা বিশ্বের এক ধরনের চাপে ছিল ইজরাইল, যাতে গাজায় অযাচিত হামলা না করে। অসম এ যুদ্ধে এখন ইজরাইল যে মাত্রার হামলাই চালাক না কেন, তা পশ্চিমা দেশগুলো মেনে নেবে বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। হামাস কেন এ সময় এমন আক্রমণের পথ বেছে নিল তার কিছু কৌশলগত রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে। ইজরাইল ২০২১ সালে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৩২ মাইল দীর্ঘ একটি অত্যাধুনিক দেয়াল নির্মাণ করতে শুরু করে, যা দ্রুত শেষ হতে চলেছে। এ দেয়াল মাটির ওপরে ২০ ফুট উঁচু এবং মাটির নিচে এতটাই গভীর পর্যন্ত, যাতে হামাস বা ফিলিস্তিনী যোদ্ধারা কোনোক্রমেই টানেল খুঁড়তে না পারে ।

অন্যদিকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত ইজরাইলের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান ইজরাইলকে সৌদি আকাশ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি কয়েকটি মুসলিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেও ইজরাইলকে সহায়তা করেছেন। সালমান ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বেশ কয়েক বছর ধরে উদাসীন রয়েছেন বলেও ঠেলে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের চরম বৈরিতা ফিলিস্তিনের স্বার্থ থেকে সৌদি আরবকে আরও দূরে দিয়েছে।

ইজরাইলের একজন সামরিক অফিসার হামাসের হামলাকে ৯/১১ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১-এর পর যে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, ইজরাইলও তাই করতে যাচ্ছে। কিন্তু গবেষক হিসেবে আমাদের ভাবনার বিষয় হচ্ছে নিরীহ মানুষ। সে হোক ইজরাইলি অথবা ফিলিস্তিনী। যারা যুদ্ধ পছন্দ করে না, যারা নিজ পরিবার, আত্মীয়স্বজন নিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবন চায়; তাদের জন্য আজও, এত বছর পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি।

জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদ নিয়ে গত কয়েক বছর বিশ্ব মঞ্চে প্রশ্ন উঠেছে। এরা কি মানবতার জন্য প্রতিষ্ঠিত নাকি মার্কিনিদের জন্য যুদ্ধরীতিকে সহজকরণে কাজ করছে! জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যুদ্ধের ১১তম (১৭ অক্টোবর, ২০২৩ মঙ্গলবার রাত) দিনে গাজা ভূখন্ডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আল-আহলি হাসপাতালে বিমান হামলা করে ইজরাইল। এতে অন্তত ৫০০ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। এর আগে ইজরাইলি হামলায় আহত শত শত রোগী ও গৃহহীন অসংখ্য বাসিন্দা নিরাপদ ভেবে ওই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল।

প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের জেনারেল সেক্রেটারি মুস্তাফা বারঘৌতি বলেন, ইজরাইলের প্রকাশিত ভিডিওতে যা দেখা গেছে, তা তো তারাই সেখানে রাখতে পারে। এটি তো খুব বেশি কিছু নয়। তিনি আরো বলেন, ইজরাইল প্রথমে কিছু দর্শককে আল শিফার ওই অব্যবহৃত কামরায় নিয়ে যাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেছে, সেখানে তারা দাবি করেছিল যে কোনো সম্পাদনা বা কাটছাট ছাড়াই তারা ভিডিওটি প্রকাশ করেছে। পরে তারা ওই ভিডিওটি আবার ডিলেট করে দেয়। এরপর তারা পুনরায় ভিডিওটি প্রকাশ করছে। কিন্তু নতুন ভিডিওর সাথে পুরোনো ভিডিও-এর অভিন্নতা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়টিও ইজরাইলি বাহিনীর দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহকে ঘনীভূত করে।

হামাস ইজরাইলি বাহিনীর সর্বশেষ বিবৃতি অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করেছে। কাতারভিত্তিক হামাসের সিনিয়র সদস্য ইজ্জাত আল রাশক বলেছেন, দখলদার বাহিনী এখনো মিথ্যাচার করছে। তারা কিছু অস্ত্র, কাপড় ও সরঞ্জাম পাওয়ার দাবি করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা নিজেরাই সেগুলো আগে এনে রেখেছে। তিনি আরো বলেন, হামাস বারবার জাতিসঙ্ঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও রেড ক্রিসেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির অধীনে ইজরাইলের দাবির সত্যতা যাচাইয়ের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু তারা তো ওই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ইজরাইল বরাবরই আল-শিফা হাসপাতালের পরিস্থিতি তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে তদন্তের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। কারণ, তারা নিজেদের মিথ্যাচার সম্পর্কে সচেতন। তাই অন্যদের সামনে মিথ্যা যেন প্রকাশ না পায়, সেজন্য ওই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে।

আল জাজিরার হানি মাহমুদ বলেন, ইজরাইলের সামরিক বাহিনী আল-শিফাতে আক্রমণ চালিয়ে হাসপাতালের অপারেশন সেক্টর ধ্বংস করে ফেলেছে। এছাড়া কক্ষের মাঝখানের দেয়াল ও ভেতরের চিকিৎসাসামগ্রীও সম্পূর্ণ অকেজো করে ফেলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, গাজার সবচেয়ে বড় এ হাসপাতালে সাতশ’ রোগী, চারশ স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রায় তিন হাজার বেসামরিক লোকের অবস্থান। এ দিকে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে হাসপাতালের ভেন্টিলেটরে থাকা অধিকাংশ রোগীই মারা গেছে। বিশ্ব মিড়িয়ার বদৌলতে দেখা যাচ্ছে, অবরুদ্ধ হাসপাতালে ১৫০-এর অধিক মৃতদেহ পড়ে আছে। তাদের দেহে পচন ধরেছে। চারদিকে দুগন্ধ ছড়াচ্ছে। আশপাশের মৃতদেহ কুকর পর্যন্ত খাচ্ছে। কোনভাবেই মৃতদেহ দাফন করতে পারছে না হাসপাতালগুলো । ইজরাইলের স্নাইপাররা কাউকে বাইরে দেখলেই গুলি ছুঁড়ছে।

স্পষ্টভাবে বলা যায়, ‘আমরা আজকে যা দেখছি তা হলো এ যুদ্ধটি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আক্রমণ, হাসপাতাল আক্রমণ ও চিকিৎসাসামগ্রী ধ্বংসের জন্য করা হয়েছে। অবশেষে কাতারের সহায়তায় চারদিনের যুদ্ধ বিরতির ধার উম্মোচিত হয়েছে- বিনিময়ে ৫০ জন ইজরাইলি মুক্তি পাবে। অপরদিকে ১৫০ জন ফিলিস্তিনী নারী ও শিশু ইজরাইলের কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবে।

১২০০ ইজরাইলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হয়েছিল হামাসের হাতে। বিপরীতে জায়নবাদী অবৈধ ইজরাইল গত প্রায় ২২ মাসের যুদ্ধে ১ লাখ-এর অধিক ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে। এটি এ উপত্যকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশের সমান (হারেজের প্রতিবেদন, আনাদোলু, ইস্তাম্বুল) । গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, প্রথম ১২ মাসেই ৪৬ হাজার ৭৮৮ জন (এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৩০০ জন) মৃত্যুবরণ করেছে- যারমধ্যে ৫৯ শতাংশ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। নভেম্বর ২০২৪-এ জাতিসংঘের বিশ্লেষণে নারী ও শিশুর সংখ্যা ৭০শতাংশ প্রতীয়মাণ। জাতিসংঘের আরেক (ইউএনওস্যাট) বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ২০২৪-এর ডিসেম্বরেই গাজার ৬৯ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সাথে ৬৮ শতাংশ রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়েছে। তাছাড়া ১০৬০জন চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছে। মূলকথা হলো এ যুদ্ধে গাজার চিকিৎসা, শিক্ষা ও নাগরিক জীবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) ধারণা করছে, গাজায় অন্তত ১৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হয়েছে— যা অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যার ৯০শতাংশ ।

মানবিক বিশ্বে চলছে এক অমানবিক তাণ্ডব- যা বিশ্ববাসী বসে বসে দেখছে। বলতে গেলে গাজার ২৩ লাখ মানুষই আজ বাস্তুচ্যুত। জাতিসংঘের হিসেব মতে, ৯১শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে। গাজায় চলছে দুর্ভিক্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যান্য প্রায় সব সংঘাতের সঙ্গে তুলনা করলে এ সংখ্যা ব্যতিক্রমী। স্পষ্টত, এই গাজা যুদ্ধ ‘একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘাত’ হিসেবে চিহ্নিত। সিরিয়া, ইউক্রেন ও সুদানে যুদ্ধে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা গাজার তুলনায় হয়তো বেশি। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও যোদ্ধাদের মৃত্যুর হার এবং জনসংখ্যার অনুপাতে মৃত্যুর হারে গাজা সম্ভবত শীর্ষে। গাজায় সহিংস মৃত্যুর শিকার নারী ও শিশুদের অনুপাত প্রায় সব সাম্প্রতিক সংঘাতের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কসোভোতে এ হার ছিল ২০শতাংশ ও সুদানে ২৩ শতাংশ।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইজরাইল গাজায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪-এর নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বুিদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এ ছাড়া গাজায় ইজরাইলের হামলাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) মামলা চলছে। এসবকিছু প্রমাণ করে যে, আধুনিক এ বিশ্বে মানবতা আজ প্রশ্নাতীত। কেননা, জাতিসংঘই প্রমাণ দিচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় বহু দেশের সহায়তায় ইজরাইল সরকার গাজায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান কোথায়! আমরা চূড়ান্ত ইজরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান চাই। এ সংঘাত এখন কত শিশুর, কত মায়ের, কত নিরীহ পিতা বা সন্তানের জীবন নেবে! বিশ্ব মানবতা এ-দায়ের ভার আর অপরাধ এড়াতে পারে না ।

লেখক : প্রাবন্ধিক।